প্রশ্নফাঁস, আত্মহত্যা, আন্দোলন ও ছাত্র নির্যাতনের বছর
বিদায়ের পথে আলোচনা-সমালোচনার বছর ২০১৮। ‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নফাঁস, শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা, ডাকসু নির্বাচন এবং ছাত্র আন্দোলন— সব মিলিয়ে বিদায়ী এই বছরজুড়েই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)।
এ বছরই দেশসেরা প্রতিষ্ঠানটিতে পরিচালিত হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ের সাড়া জাগানো ছাত্র আন্দোলন ‘সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার’। এছাড়াও বিভিন্ন সময়ে সংগঠিত সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ, আন্দোলনরত ছাত্রীদের যৌন হেনস্তা, নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীর ব্যানারে উপাচার্যকে অবরুদ্ধ এবং সর্বশেষ ছাত্র-ছাত্রীদের উপর সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনের হামলার ঘটনা ছিল চোখে পড়ার মত। সবদিক বিবেচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের কাছে হতাশা, অস্বস্তি ও অসন্তোষের বছর ছিল ২০১৮। আবার কোটা সংস্কার চেয়ে বাতিলের বাস্তবায়নে স্বস্তি-অস্বস্তি এবং ডাকসু নির্বাচন নিয়ে নতুন আশাও তৈরি হয় এ বছর।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিগত এক বছর ক্যাম্পাসের ছাত্র রাজনীতি অনেকটা নীরব থাকলেও সবখানেই ছিল ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের একক আধিপত্য। প্রায় এক দশকের ধারাবাহিকতায় এ বছরও ছাত্রদল ছিল ক্যাম্পাসছাড়া। বছরজুড়ে চলা বিভিন্ন আন্দোলন-সংগ্রামে কখনও সমর্থন কখনও খড়্গ হাতে অবস্থান করতে দেখা গেছে সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগকে।
সাত কলেজ অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন: শিক্ষার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১৭ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা রাজধানীর সাতটি সরকারি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। শিক্ষার্থীরা জানান, বড় বড় এসব কলেজের চাপ বাড়ায় ঢাবি শিক্ষার্থীদের পড়তে হয় বিভিন্ন ধরণের ভোগান্তিতে। যার প্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের শুরুতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন দানা বাঁধে। শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে লাগাতার কর্মসূচি ঘোষণা করতে থাকে। যদিও শেষ পর্যন্ত তা বাতিল হয়নি।
জানা যায়, অধিভুক্তি বাতিলের দাবিতে ওই আন্দোলনের অংশ হিসেবে এ বছরের ১৫জানুয়ারি ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে কয়েক’শ শিক্ষার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয়। সে সময়ের ছাত্রলীগ সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ, সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন, ঢাবি ছাত্রলীগ সভাপতি আবিদ আল হাসান ও সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন প্রিন্সের নেতৃত্বে বিভিন্ন হলের ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ঘিরে ফেলে। একপর্যায়ে ছাত্রলীগ নেতারা আন্দোলনের সমন্বয়ক মশিউর রহমানকে তুলে নিয়ে উপাচার্য কক্ষে মারধর ও জিজ্ঞাসাবাদ করেন। ছাত্রলীগ নেতারা অবস্থানরত ছাত্রীদের গালাগালা দেন। এ সময় কর্মরত সাংবাদিকদের উপরও হামলা চালায় তারা।
উপাচার্যকে অবরোধ ও ছাত্রলীগের উদ্ধার: উপাচার্য কার্যালয়ের সামনে ছাত্রলীগ কর্তৃক আন্দোলনের সমন্বয়ক মশিউর রহমানকে তুলে নিয়ে পুলিশে দেয়া এবং ছাত্রী হেনস্তার প্রতিবাদে জোরদার হয় নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন। তারা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচারের দাবিতে প্রশাসনকে ৪৮ ঘন্টার আল্টিমেটাম দেয়। আন্দোলনের অংশ হিসেবে ২৩ জানুয়ারি নিপীড়নবিরোধী শিক্ষার্থীরা উপাচার্যকে অবরোধ করেন। ৪ ঘন্টা অবরোধের পর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা উপাচার্যকে উদ্ধার করেন। এ সময় তারা শিক্ষার্থীদের উপর নৃশংস হামলা চালায়। ছাত্রলীগের হামলায় এদিন অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী মারাত্মকভাবে আহত হয়। ওই আন্দোলনে এক ছাত্রলীগ নেত্রী কর্তৃক আন্দোলনরত শিক্ষার্থীর বস্ত্র হরণের ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে তা সমালোচনার জন্ম দেয়।
এহসান রফিকের উপর নির্যাতন: এ বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি সলিমুল্লাহ মুসলিম (এসএম) হলে ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের নির্যাতনের শিকার হন দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী এহসান রফিক। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার উপর হামলা চালায় তারা। এতে ওই শিক্ষার্থীর একটি চোখের কর্নিয়া গুরুতর জখম হয়। পরে এই ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ই ছেড়ে যান।
ডাকসু নিয়ে আলোচনা: চলতি বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বৈঠকে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র মৈত্রী, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী ও জাসদ ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা উপস্থিত হন। বৈঠক শেষে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী ও ছাত্রদল সভাপতি রাজিব আহসানের কোলাকুলির একটি ছবি ছাত্র রাজনীতি নিয়ে ইতিবাচক আশার সঞ্চার করে।
‘ঘ’ ইউনিটের প্রশ্নফাঁস ও পুন:পরীক্ষা: এ বছরের ভর্তি পরীক্ষাও জালিয়াতিমুক্ত করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। প্রথম দিকে কয়েকটি ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা জালিয়াতিমুক্ত হলেও পরবর্তী পরীক্ষাগুলোতে সক্রিয় হয়ে ওঠে জালিয়াতচক্র। ভর্তি-ইচ্ছুক থেকে শুরু করে বেশ কয়েকজন জালিয়াতচক্রের সদস্যকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটে এ বছরের ১২ অক্টোবর ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার দিন। ওইদিন পরীক্ষা শুরুর পৌনে এক ঘণ্টা আগেই প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ পায় গণমাধ্যমকর্মীরা। কর্তৃপক্ষ প্রশ্নফাঁসের কথা অস্বীকার করলে পুন:পরীক্ষা নেয়ার দাবিতে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। পুন:পরীক্ষা নেয়া ও জড়িতদের শাস্তির দাবিতে ৫৪ ঘন্টা অনশন শুরু করেন ঢাবির আইন বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী আখতার হোসেন। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনও এগিয়ে আসে পুন:পরীক্ষা নেয়ার দাবি। এরপর কর্তৃপক্ষ উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে পুন:পরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পুন:পরীক্ষা হয় ১৬ নভেম্বর ।
আত্মহত্যা: বছরজুড়েই ঢাবি শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার খবর আসে। এ বছর কমপক্ষে ৯ জন শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায় গণমাধ্যমে প্রকাশিত তখ্য ঘেঁটে। এর মধ্যে ফিন্যান্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষের মেধাবী শিক্ষার্থী তরুণ হোসেনের আত্মহত্যা, শিক্ষা ও রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে সংগীত বিভাগের ৪র্থ বর্ষের মুশফিক বাবুর নিজ বাসার ছাদ থেকে লাফ, পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে সুইসাইড নোট লিখে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র জাকির হোসেনের নিজ ঘরে ফাঁস ও প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ফাহমিদা রেজা সিলভির আত্মহত্যার ঘটনা ছিল উল্লেখযোগ্য।
কোটা সংস্কার আন্দোলন: ঢাবিতে পুরো বছরের সবচেয়ে আলোচিত ও বড় ঘটনা ছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন। সব ধরণের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের প্রচলিত ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জানুয়ারি থেকেই আন্দোলন সংগঠিত হতে থাকে। আস্তে আস্তে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশব্যাপী। শিক্ষার্থীরা সারাদেশব্যাপী ‘বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’-এর ব্যানারে সংগঠিত হয়। আন্দোলনের অংশ হিসেবে ৮ এপ্রিল সকাল থেকে শাহবাগের রাস্তা অবরোধ করে অবস্থান নেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দিনভর অবস্থান করে সড়কেই রাত্রি যাপনের পরিকল্পনা করে তারা। রাতে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারসেল ও ফাঁকা গুলি ছোড়ে পুলিশ। এতে করে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে শিক্ষার্থীদের। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে ঢাবির পুরো এলাকায়। হলের গেট ভেঙ্গে বেরিয়ে আসেন শিক্ষার্থীরা। ভাঙচুর করা হয় ঢাবি ভিসি অধ্যাপক ড. আখতারুজ্জামানের বাসভবন। সেই রাতে পুলিশ ও ছাত্রলীগের সমন্বিত হামলায় প্রায় অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়।
পরদিন ৯ এপ্রিল দেশব্যাপী শুরু হয় তুমুল ছাত্র আন্দোলন; যাতে একাত্মতা ঘোষণা করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রাতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়েদুল কাদেরের সঙ্গে আলোচনার পর আন্দোলন স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষার্থীরা। তবে সেদিন সংসদে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে কটূক্তি করায় আবারও রাস্তায় নামে শিক্ষার্থীরা। তীব্রতর হয় আন্দোলন। এদিন বিকেলেই সংসদে ‘সব চাকরিতে প্রধানমন্ত্রীর কোটা তুলে নেয়ার’ ঘোষণায় আন্দোলন সাময়িকভাবে থামে। কোটা বাতিলের ঘোষনার পরও প্রজ্ঞাপনের দাবিতে থেমে থেমে চলে আন্দোলন। পরে মন্ত্রী পরিষদ সচিবের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে সব ধরনের কোটা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
এবারও কোণঠাসা ছিল ছাত্রদল
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এবারো কোণঠাসা ছিল ছাত্রদল। গত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় এ বছরো তারা ক্যাম্পাসে আসতে পারেনি। যদিও ডাকসু ইস্যুতে আলোচনা সভায় অংশ নিয়েছিল তারা। ওই সভা শেষে ছাত্রদল সভাপতি রাজিব আহসানের সঙ্গে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর কোলাকুলি দৃশ্য ছাত্র রাজনীতিতে কিছুটা আশার সঞ্চার করে। বাম ছাত্র সংগঠনগুলোকেও বেশকিছু ইস্যুতে সরব দেখা গেছে এবার। এর মধ্যে চোখে পড়ার মত কর্মসূচি ছিল ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদ ও ঘ ইউনিটের পরীক্ষা বাতিলের দাবি।