ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

১১ মাসে ৯ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

১১ মাসে ঢাবির নয় শিক্ষার্থী ‘আত্মহত্যা’ করেছেন
১১ মাসে ঢাবির নয় শিক্ষার্থী ‘আত্মহত্যা’ করেছেন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। জ্ঞান, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংগ্রাম, আন্দোলন ও দেশের স্বাধীনতা সব কিছুর সাথে জড়িত এ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা দেশের নানা ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলছে। তবে সম্প্রতি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে আত্মহত্যার প্রবণতা। চলতি বছরে ১১ মাসে নয় শিক্ষার্থী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। একের পর এক শিক্ষার্থীদের এমন আত্মহত্যার খবর প্রকাশিত হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা রয়েছে।

বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচার থিয়েটার ভবনের আর সি মজুমদার অডিটরিয়ামে ‘আত্মহত্যা প্রতিরোধ’ এ করণীয় শীর্ষক সেমিনার হচ্ছিল। আর এ সময়ে রাজধানীর অদূরে টঙ্গীতে নিজ বাসায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র হুজাইফা রশিদ। পরিবারের ধারণা, একাডেমিক হতাশা থেকে সে আত্মহত্যা করতে পারেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিষণ্নতা যখন চেপে ধরে তখন মানুষ মুক্তি চায়। কিন্তু মুক্তি পেতে গিয়ে তারা যে জীবনকে ধ্বংস করে দিচ্ছে তা বুঝে না।পরিবার থেকে শুরু করে বন্ধু-বান্ধবদের ভূমিকাই এ ধরনের আত্মবিধ্বংসী পথ থেকে হতাশাগ্রস্থ ব্যক্তিকে রক্ষা করতে পারে। আপন মানুষের সান্নিধ্যই আত্মহত্যা রুখতে পারে।

চলতি বছর আত্মহত্যা করা এই ৯ জনের মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পারিবারিক সমস্যা, প্রেম গঠিত জটিলতা, বেকারত্ব, পরীক্ষায় কাঙ্খিত ফলাফল অর্জনে ব্যর্থতা এবং সর্বোপরি ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশা-নিরাশা থেকে এসব শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানসিক চাপ, হতাশা, অবসাদ ও হেনস্থার শিকার হয়ে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আবার আর্থ-সামাজিক সমস্যা ও পারিবারিক সংকটের কারণেও অনেকে আত্মহত্যা করে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শদান দফতরের পরিচালক অধ্যাপক মেহজাবীন হক বলেন, ‘পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজনের সাথে বিচ্ছিন্নতার কারণেই ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে। আর সম্পর্ক দূর্বল হয়ে যাওয়ার পেছনে কাজ করছে প্রযুক্তির অগ্রসরতা ও প্রতিযোগিতার মনোভাব। তরুণ তরুণীরা তাদের সমস্যার সমাধান হিসেবে আত্মহত্যাকে বেছে নিচ্ছে আর এধরনের একটি ঘটনা আরেকটি ঘটনাকে প্রভাবিত করছে।’

সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে পরিচালিত এক গবেষণায় তরুণ ও অল্পবয়সীদের আত্মহত্যার এক চিত্রে দেখানো হয়েছে, পারিবারিক সমস্যায় ৪১ দশমিক ২ শতাংশ, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, বৈবাহিক সমস্যায় ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, ভালোবাসায় কষ্ট পেয়ে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, বিবাহবহির্ভূত গর্ভধারণ ও যৌন সম্পর্কের কারণে ১১ দশমিক ৮ শতাংশ, স্বামীর নির্যাতনে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ এবং অর্থকষ্টে ৫ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষ আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিচ্ছে। বিশ্বে গত ৪৫ বছরে আত্মহত্যার ঘটনা ৬০ শতাংশ বেড়েছে। বর্তমানে ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী মানুষের মৃত্যুর প্রধান তিনটি কারণের একটি হলো আত্মহত্যা।

হতাশাগ্রস্থ হয়ে চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারী রাজধানীর হাজারীবাগের একটি নির্মানাধীন ভবনের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী তরুন হোসেন। শিক্ষার্থীদের দেয়া তথ্য মতে, ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ঢাবিতে ভর্তি হওয়া তরুণ সাদাসিধে জীবন যাপনের জন্য বন্ধুদের কাছে নিগ্রহের শিকার হতেন। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ শিক্ষকদের রূঢ় আচরণ ও একটি কোর্সে পরপর দু’বার অকৃতকার্য হওয়াও তার হতাশার উল্লেখযোগ্য কারণ হতে পারে।

৩১ মার্চ ঢাবির এমবিএ ভবনের ৯ তলা থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন সান্ধ্যকালীন কোর্সের শিক্ষার্থী তানভীর রহমান। তার বন্ধুরা জানান, ত্রিশ বছর বয়সী তানভীর রহমান সরকারি চাকুরি না পাওয়ার দুঃখে এ পথ বেছে নিয়েছিলেন। চাকরির বয়স পার হয়ে যাওয়া স্বত্ত্বেও সরকারি চাকরির নাগাল না পাওয়াই তানভীরের আত্মহত্যার কারণ।

দেশের শিক্ষা ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে গত ১৫ আগস্ট রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় আত্মহত্যা করেন ঢাবির সংগীত বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মুশফিক মাহবুব। আত্মহননের আগে স্বাধীনচেতা মুশফিক তার ফেইসবুক ওয়ালে লিখে গেছেন ‘আই ওয়ান্ট ফ্রিডম অ্যাজ এ বাংলাদেশি ইভেন ইফ ইট কিলস মি ফর দ্যা রিজন’ তার বন্ধুদের ভাষ্য অনুযায়ী, কাউকে হতাশায় ভুগতে দেখলে মুশফিক নিজেই সান্ত্বনা দিতো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জীবনের কাছে হেরে গেলেন মুশফিক নিজেই।

গত ১৫ই অক্টোবর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে সুইসাইড নোট লিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র জাকির হোসেন গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ঢাবির মার্কেটিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আফিয়া সারিকা।সেপ্টেম্বর মাসের এক বিকালে বাবাকে পাশের রুমে রেখে গলায় ফাঁস নেন তিনি।

চলতি মাসের ১২ তারিখ রাজধানীর ফার্মগেটের একটি হোস্টেল গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ওই ছাত্রী ফাহমিদা রেজা সিলভি। প্রেমের সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে জানা যায়। এই ঘটনার দুইদিন পর ১৪ নভেম্বর গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন ঢাবি অধিভূক্ত রাজধানীর আজিমপুরের গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী লায়লা আঞ্জুমান ইভা। পুলিশের প্রাথমিক ধারণা অনুযায়ী এই শিক্ষার্থীও প্রেম ঘটিত কারণে আত্মহত্যা করেছেন। সর্বশেষ গত শুক্রবার যশোরের গ্রামের বাড়ীতে আত্মহত্যা করেন ঢাবির ২০১০-১১ সেশনের প্রাক্তন ছাত্রী মেহের নিগার দানি। এ শিক্ষার্থীর মৃত্যুর কারণ এখনও জানা যায়নি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে তরুণ তরুণীরা আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিচ্ছেন। এটা দ্বারা বোঝা যায় সমাজের মধ্যে শূন্যতা-বিচ্ছিন্নতা আছে। কারো একার পক্ষে এটা দূর করা সম্ভব না। সমাজের মানুষকে আরও সহানুভূতিশীল হতে হবে, তারপরই বিষয়গুলো কমে আসবে।’


ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক একেএম গোলাম রব্বানী বলেন, শিক্ষার্থীর মৃত্যু সব সময়ই বেদনাদায়ক। এ ধরনের আত্মহত্যার ঘটনা গুলো প্রতিরোধে পরিবার, শিক্ষক এবং বন্ধুদের সজাগ থাকা জরুরী। শিক্ষার্থীদের কাছে অনুরোধ থাকবে তাদের কোনো সমস্যা হলে তারা যেন নিজ থেকে শিক্ষকদের জানায়।


সর্বশেষ সংবাদ