পরীক্ষা ছাড়াই কর্মকর্তাদের প্রথম শ্রেণিতে পদোন্নতি
রাজশাহী মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তাদের পরীক্ষা ছাড়াই প্রথম শ্রেণিতে পদোন্নতির ঘটনা ঘটেছে। লিখিত পরীক্ষা, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন ছাড়াই শুধু সিলেকশন কমিটির মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে ৯ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের এক তদন্তে এসব অসংগতি উঠে এসেছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) বিভাগের আলাদা দুই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এ তদন্ত করা হয়। গত বছরের ২৩-২৫ নভেম্বর পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি সরেজমিন এসব নিয়ে তদন্ত করে।
উচ্চ আদালতের এক পর্যবেক্ষণে চারটি মানদণ্ডের ভিত্তিতে পদোন্নতির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো কর্মকর্তাদের বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা। কিন্তু শুধু মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে ওই মেধাতালিকাটি করা হয়। বোর্ডে ৪৮ কর্মকর্তার কোনো বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনও নেই। তবে কারও কারও সার্ভিস বুক চালু আছে। তদন্ত কমিটি দেখেছে, সার্ভিস রেকর্ডে নিয়মিত তথ্য সংযোজন করা হয় না। সার্ভিস রেকর্ডে ফ্লুইড ব্যবহার করে ঘষামাজাও রয়েছে, যা সার্ভিস রুলের পরিপন্থী। তবে জানা যায়, পদোন্নতি পাওয়া মুঞ্জুর রহমান খান ও দুরুল হোদা তদন্ত কমিটির কাছে তাঁদের সার্ভিস বুকও দেখাতে পারেননি।
আরও পড়ুনঃ ফ্রি-ফায়ার খেলতে নিষেধ করায় স্কুলছাত্রের আত্মহত্যা
তদন্ত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, শিক্ষা বোর্ডের সাবেক দুই চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ ও অধ্যাপক মকবুল হোসেনের আমলে পদোন্নতি নিয়ে এসব তুঘলকি কাণ্ড ঘটেছে। দুই দফায় ১৫ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দিতে নানা অনিয়ম করেছেন তাঁরা। সিলেকশন কমিটিও প্রথমে নিয়ম না মেনে ৯ জনকে পদোন্নতির সুপারিশ করেছিল বলে তদন্তে উঠে এসেছে। শুধু তা-ই নয়, পদোন্নতির অন্য তিন মানদণ্ড (লিখিত পরীক্ষা, শিক্ষাগত যোগ্যতা ও বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদন) আমলে না নিয়ে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, সিলেকশন কমিটির মৌখিক পরীক্ষার পর ৪৮ জনের মেধাতালিকা করা হয়। সিলেকশন কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ওই ৪৮ জনের মধ্যে প্রথমে ২০১৭ সালের ৯ জুলাই ৯ জনকে পদোন্নতি দেওয়া হয়। এই ৯ জন হলেন উপকলেজ পরিদর্শক নেসার উদ্দিন আহমেদ, উপবিদ্যালয় পরিদর্শক মানিক চন্দ্র সেন, উপসচিব (প্রশাসন) ওয়ালিদ হোসেন, উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (সনদ ও রেকর্ডস) মুঞ্জুর রহমান খান, ক্রীড়া কর্মকর্তা লিটন সরকার, হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম, অডিট কর্মকর্তা সেলিনা পারভীন, উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (মাধ্যমিক) জাহিদুর রহমান ও উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (উমা) হোসনে আরা আরজু। এঁদের পদোন্নতি দিতে সিলেকশন কমিটি ২০১৭ সালের ২১ এপ্রিল বোর্ডের চেয়ারম্যানের কক্ষে ৪৮ জন কর্মকর্তার মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ করে। কমিটির সভাপতি ছিলেন বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ।
ওই মেধাতালিকা থেকে ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান মকবুল হোসেন আরও ছয়জনকে পদোন্নতি দিতে চিঠি ইস্যু করেন। এই ছয়জন হলেন উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (জেএসসি) ফরিদ হাসান, উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (স্ক্রিপ্ট) রুবী, উপসচিব (ভাণ্ডার) দুরুল হোদা, উপসচিব (প্রটোকল) খোরশেদ আলম, উপবিদ্যালয় পরিদর্শক (রেজি) মো. নুরুজ্জামান ও লাইব্রেরি অ্যান্ড ইনফরমেশন ডকুমেন্টেশন কর্মকর্তা সুলতানা শারমিন আক্তার। প্রথমে বিতর্কিত ওই মেধাতালিকা থেকে ১-৯ নম্বর ক্রমিকের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হলেও দ্বিতীয় পদোন্নতির ক্ষেত্রে এই ক্রমিকও অনুসরণ করা হয়নি। দ্বিতীয় দফায় পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে ক্রমিকের ১২, ১৩, ২০, ২১, ২৫ ও ৩৮ নম্বরে থাকা কর্মকর্তাদের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমি কয়েক দিন আগে তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেয়েছি। প্রতিবেদনে আসলে কী আছে, সেটা এখনো আমার বিশ্লেষণ করে দেখা হয়নি। এটা নিয়ে এখন বোর্ডসভায় আলোচনা হবে। কেন অনিয়ম করে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল, সে বিষয়েও পর্যালোচনা করা হবে। তারপর তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
আরেক সাবেক চেয়ারম্যান মকবুল হোসেন বলেন, ‘এটা একটা বায়াজড (পক্ষপাতদুষ্ট) তদন্ত কমিটি ছিল। তদন্ত প্রতিবেদনও সে রকম হয়েছে। আগের ৯ জনকে কীভাবে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছিল, সেটা আমি বলতে পারব না। তবে আমি যে ছয়জনকে পদোন্নতি দিয়েছিলাম, তা পরে স্থগিত করেছি। বোর্ডের কোনো আর্থিক ক্ষতি হয়নি।’
ওই তদন্ত কমিটিতে ছিলেন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ মো. আজমতগীর, শিক্ষা পরিদর্শক আজিজুর রহমান, মনকিউল হাসনাত, হেমায়েত উদ্দীন এবং অডিট কর্মকর্তা চন্দন কুমার দেব। চলতি মাসে তদন্ত কমিটি দুদক ও মাউশিতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডেও দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদন।