আত্মহত্যার মিছিলে চলতি মাসে যোগ হলো আরও ১০ শিক্ষার্থী
নভেল করোনাভাইরাসের কারণে গত ১৫ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ঘরবন্দি এই সময়ে সারা দেশে আত্মহত্যা করেছে দেড়শরও বেশি শিক্ষার্থী। আত্মহননের মিছিল যেন থামছেই না। সর্বশেষ চলতি জুনেই আত্মহত্যার মিছিলে যোগ হলো আরও ১০ শিক্ষার্থী।
পড়াশোনা নিয়ে হতাশা, পারিবারিক কলহ, প্রেমঘটিত টানাপোড়েন, আর্থিক সংকট, বেকারত্ব, নি:সঙ্গতা, মানসিক চাপ, তীব্র বিষন্নতা— এসব আত্মহত্যার মূল কারণ।
সংশ্লিষ্টরা মনে করেছেন, গত এক বছরেরও বেশি সময় শিক্ষার্থীরা গৃহবন্দী থেকেছে। এ সময় তাদের মধ্যে নানা কারণে বেড়েছে হতাশা ও বিষণ্নতা। যার নানামুখী প্রভাব পড়েছে মানসিক স্বাস্থ্যে। এসব কারণে কেউ কেউ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। নিয়মিত কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে আত্মহত্যা ও মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।
গত ২ জুন রাতে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় স্মার্টফোন কিনে না দেয়ায় বাবা-মায়ের সঙ্গে অভিমান করে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে রানা মিয়া নামে এক স্কুলছাত্র। উপজেলার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের চন্দ্রখানা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
রানা উপজেলার ফুলবাড়ি ইউনিয়নের চন্দ্রখানা গ্রামের কৃষক নাছির উদ্দিনের ছেলে। রানা ফুলবাড়ি আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন।
গত ৪ জুন দিবাগত রাতে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ উপজেলায় সুতাং বাজারের বাসা থেকে মাঈনুর রশিদ মাহিন নামে এক স্কুলছাত্রের ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। মৃত্যুর আগে দশম শ্রেণির ওই ছাত্র চিরকুটে লিখে গেছে, ‘আমি তোমাদের স্বপ্ন পূরণ করতে পারলাম না।’
পুলিশের বক্তব্য, অভিমান থেকে চিরকুট লিখে আত্মহত্যা করেছে ওই ছাত্র। ফ্যানের সঙ্গে গলায় ওড়না প্যাচানো ঝুলন্ত অবস্থায় মরদেহটি উদ্ধার করে পুলিশ। পরে ময়নাতদন্তের জন্য সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়। নিহত মাঈনুর রশিদ ওই বাজারের আরব আলীর ছেলে। মাধবপুরের শাহজীবাজার পল্লী বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) উচ্চ বিদ্যালয়ের লেখাপড়া করত সে।
ফেসবুক ফ্রেন্ডকে ভিডিও কলে রেখে ঘরের ফ্যানের সিলিংয়ের সঙ্গে গলায় ফাঁস লাগিয়ে মাহিন জামান নামের এক পলিটেকনিক কলেজের ছাত্র আত্মহত্যা করেন। ৪ জুন দিবাগত রাত ১২টার দিকে খুলনা শহরে এ ঘটনা ঘটে। মাহিন ওই এলাকার জামান ফরাজীর ছেলে। তিনি খুলনা ম্যানগ্রোভ পলিটেকনিক কলেজের ছাত্র ছিলেন।
জানা যায়, প্রেমিকার সঙ্গে কলহের জেরে শুক্রবার দিবাগত রাত ১২টা ০৫ মিনিটে অপর এক ফেসবুক ফ্রেন্ড তানভীরের সঙ্গে ভিডিও কলে থাকা অবস্থায় আত্মহত্যা করেন।
৪ জুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী তানমিরা খাতুন শ্বশুরবাড়িতে আত্মহত্যা করেছেন। তার বাড়ি ঝিনাইদহের শৈলকূপা উপজেলার ছড়িয়ার বিল গ্রামে।
শৈলকূপার রাজনগর গ্রামে শশুরবাড়িতে থাকা অবস্থায় আত্মহত্যা করেছেন বলে জানিয়েছেন রাবির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহমুদুর রহমান।
মোবাইল গেম খেলতে না দেওয়ায় গত ৪ জুন সিরাজগঞ্জের বেলকুচিতে মুরছালিন (১৬) নামে এক এসএসসি পরীক্ষার্থী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। ঘটনার দিন বিকেলে উপজেলার ভাঙ্গাবাড়ী ইউনিয়নের চন্দনগাঁতী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নিহত স্কুলছাত্র চন্দনগাঁতী গ্রামের শাহ আলমের ছেলে। সে সরকারি সোহাগপুর এসকে পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল।
৭ জুন দুপুর ২টার দিকে রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে একটি বাসায় গলায় ফাঁস দিয়ে পুষ্পা মনি নামে এক স্কুলছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। পরে অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। পুষ্পা স্থানীয় ওয়াজ উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের ১০ম শ্রেণিতে পড়ে পুষ্পা।
৮ জুন চট্টগ্রামে এক কলেজছাত্রের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। লাশের পাশেই পড়ে ছিল কীটনাশকের বোতল ও আত্মহত্যার চিরকুট। ঘটনার দিন বেলা সাড়ে ৩টার দিকে নগরীর সিআরবি কাঠের বাংলোর দক্ষিণ পাশে লাশটি পড়ে ছিল বলে জানান কোতয়ালি থানার এসআই বাবলু পাল।
অনিক চৌধুরী (২৩) নামের ওই ছাত্র পটিয়ার বাথুয়া ইউনিয়নের দোলন চৌধুরীর ছেলে। পটিয়া সরকারি কলেজের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী অনিক।
বাবলু পাল বলেন, অনিকের মাথার নিচে থাকা ব্যাগে পাওয়া জাতীয় পরিচয়পত্র ও কলেজ আইডি কার্ড দেখে পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। ব্যাগে চিরকুটও পাওয়া গেছে। এ ছাড়া লেবেল লাগানো কীটনাশকের একটি বোতল ঘটনাস্থল থেকে পাওয়া গেছে।
৯ জুন বাবা-মায়ের ওপর অভিমান করে মুবতাসিন ফুয়াদ ওরফে প্রীতম (১৬) নামের এক এসএসসি পরিক্ষার্থী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে। ঘটনার দিন বেলা সাড়ে ১১টায় বগুড়ার শাজাহানপুরের নিজ বাড়ি থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
মৃত প্রীতম উপজেলার আড়িয়া ইউনিয়নের কাঁটাবাড়িয়া মধ্যপাড়া গ্রামের এনামুল হকের ছেলে। সে বগুড়া পল্লী উন্নয়ন একাডেমি ল্যাবরেটরি স্কুল এ্যান্ড কলেজের এসএসসি পরিক্ষার্থী ছিল।
৯ জুন মায়ের উপর অভিমান করে কলেজ পড়ুয়া এক ছাত্রী গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ওই শিক্ষার্থীর নাম তানিয়া আক্তার (২৩)। ঘটনার দিন বিকেলে রাজধানীর খিলগাঁওয়ে এই ঘটনা ঘটে।
তানিয়া খিলগাঁও বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষে পড়তেন। পরিবার নিয়ে তারা খিলগাঁওয়ের মোরাদিয়া জামতলা এলাকায় থাকেন।
মোবাইল ফোন কিনে না দেয়ায় অভিমান করে মাদারীপুরে শফিকুল ইসলাম নামে দশম শ্রেণির এক স্কুলছাত্র আত্মহত্যা করেছে। শুক্রবার (১১ জুন) বিকেল ৪টায় সদরের ঘটমাঝি এলাকায় নিজ বাড়িতে এ ঘটনা ঘটে। সদর উপজেলার ঘটমাঝি গ্রামের কৃষক তালেব আকনের ছেলে শফিকুল স্থানীয় অ্যাডভোকেট দলিল উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আফজাল হোসেন বলেন, আত্নহত্যা মূলত একটা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত; যে আত্নহত্যা করবে সেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে৷ কেউ হয়তো আগে থেকেই অনেক ধরনের মানসিক যন্ত্রণায় ভুগে থাকতে পারে। যখন এই যন্ত্রণাগুলো পরিমাণে বেশি হয় কিংবা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছে যায় যেটাকে আমরা বলি 'তীব্র মনোবেদনা'।
“এটি যখন সহ্য ক্ষমতার বাইরে চলে যায় অর্থাৎ ব্যক্তি মনে করতে পারে আমার বেঁচে থেকে লাভ নেই,নিজেকে মূল্যহীন মনে করে। এভাবে অনেকগুলো মানসিক সমস্যা যখন একত্রিত হয় মনোজগৎকে নাড়া দেয় কিংবা আন্দোলিত করে তখন ব্যক্তি আত্নহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে পারে বা নেয়। করোনাকালে শিক্ষার্থীরা মানসিক বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন ফলে আত্নহত্যাও বেড়েছে।”
তিনি আরও বলেন, আত্নহত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেকগুলো ক্ষেত্র কাজ করে। ব্যক্তি বিশেষে ক্ষেত্রগুলো ভিন্ন হয়ে থাকে। একজন ব্যক্তির যখন নৈতিক মূল্যবোধ একেবারে ফুরিয়ে যায় তখনই সে আত্নহননের পথ বেছে নেয়। আত্নহত্যা মহাপাপ জেনে ও ব্যক্তি তখন আত্নহত্যা করে।
“এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। একটি শিশু তার পরিবার থেকে কি ধরনের মূল্যবোধ নিয়ে বেড়ে উঠছে সেই মূল্যবোধগুলো আঁকড়ে ধরে কিন্তু শিশুকে ভবিষ্যতে পরিচালিত করবে৷ বাবা-মা কর্তৃক গৃহীত আদর্শ শিশুর জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।”