অন্ধকার জগতের ভয়ংকর এক মাদক এলএসডি, কিভাবে আসে বাংলাদেশে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুর রহমানের আত্মহত্যার কারণ খুঁজে বের করার তদন্তে উঠে এসেছে লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড বা এলএসডি নামে এক ধরনের ভয়ানক মাদকের নাম। যদিও হাফিজুরকে এই মাদক দেয়া হয়েছিল কিনা সে বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নয় পুলিশ। সম্প্রতি রাজধানী থেকে এই মাদকের ২০০ ব্লট জব্দ করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের রমনা বিভাগ।
গত বৃহস্পতিবার (২৭ মে) ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি জানান, গত বুধবার (২৬ মে) রাজধানীতে হাফিজুরের তিন বন্ধুকে ২০০ ব্লট এলএসডিসহ গ্রেফতার করা হয়। তারা ভার্চুয়াল মাধ্যমে যোগাযোগ করে টিম নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে নেদারল্যান্ডস থেকে এলএসডি নিয়ে এসেছেন।
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এই এলএসডি মাদক জব্দ করা হয়েছে বলে তিনি জানালেও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর বলছে, এবারই প্রথম নয়। ২০১৯ সালেও এলএসডি জব্দ করা হয়, গ্রেফতার করা হয় রেদোয়ান আনান ও সৈয়দ আহনাদ আতিফ মাহমুদ নামে দুজনকে।
এলএসডি মাদক অনেক পুরোনো হলেও বাংলাদেশে এর ব্যবহার নতুন। এ মাদক অনেক বেশি ব্যয়বহুল। কয়েক বছর ধরে এলএসডি উচ্চবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ডার্ক ওয়েবের মাধ্যমে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের মাদক কারবারির সঙ্গে যোগাযোগ করে কুরিয়ারের মাধ্যমে এই মাদক দেশে আনা হচ্ছে। স্টিকার বা তরল পানি শোষণ করে রাখে এমন কাগজ ব্যবহার করে এটি দেশে আনা হয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এ মাদকের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে।
এলএসডি কী
এলএসডি মস্তিষ্কে এমন এক প্রভাব সৃষ্টি করে যা হ্যালুসিনেশনে (সম্মোহন) সাহায্য করে। ফলে যারা এ মাদক ব্যবহার করে তারা বিভিন্ন রকম রঙ এবং আকৃতির জিনিস দেখে, যার অস্তিত্ব পৃথিবীতে নেই। এছাড়া এই মাদক মানব মস্তিষ্কের এমন সব স্নায়ুর কার্যক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়, যা অনেক সময় অতীত স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। এমনকি এই মাদক মানুষকে তার জন্মকালীন স্মৃতিও মনে করাতে সক্ষম।
মুখে নিয়ে এলএসডি গ্রহণ করলে ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট পর এর কার্যকারিতা শুরু হয়। মাদকের প্রতিক্রিয়ার পিক হয় দুই থেকে চার ঘণ্টা পর্যন্ত সময়ে। এটি ১২ ঘণ্টারও বেশি সময় মানুষের মধ্যে কার্যকর থাকে। এলএসডির কার্যকারিতা একেকজনের ক্ষেত্রে একেক রকম হয়। এলএসডির হ্যালুসিনেশন তৈরি করার প্রবণতা থেকে অনেকেই এটি ব্যবহার শুরু করে। এমনকি ষাটের দশকে এই মাদক থেকে নতুন একটি সাইকেডেলিক কালচার তৈরি হয়। জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী ও ব্যান্ড সদস্যরা এই মাদক সেবন শুরু করেন।
১৯৬৮ সালে বিশ্বব্যাপী এলএসডি নিষিদ্ধ করা হয়। নিষিদ্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ এই মাদক ব্যবহার করেছিল। বর্তমানেও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে রিক্রিয়েশনাল ড্রাগ হিসেবে এলএসডি ব্যবহৃত হয়। এ মাদক ভারতে এখনো গোপনে ব্যবহার হয়।
ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, ‘উদ্ধার এলএসডিগুলো দেখতে স্ট্যাম্পের মতো। এগুলো যে মাদক তা দেখে বোঝার উপায় নেই। এলএসডি সেবকরা ঠোঁটের নিচে এলএসডি রেখে দেয়। এলএসডি নতুন, ব্যয়বহুল এবং অতিরিক্ত ক্ষতিকারক মাদক (ব্যাড ড্রাগ)।’
তিনি বলেন, ‘এটি সেবন করে সেবনকারী নিজেকে অনেক শক্তিশালী ভাবে। সেবনকারী চিন্তা করে, সে উড়তেও পারবে। তার অতীত স্মৃতি চলে আসে। অনেকে বলেছে, এটি সেবনের পর তারা মনে করে যে, তারা ট্রেনেও ধাক্কা দিতে পারবে।’
যেভাবে আসে এলএসডি
গত বুধবার (২৬ মে) রাজধানীর লালমাটিয়া ও ধানমন্ডি থেকে সাদমান সাকিব রুপল (২৫), আসহাব ওয়াদুদ তূর্য (২২) ও আদিব আশরাফ (২৩) নামে তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়। এরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হাফিজুরের বন্ধু। তাদের কাছ থেকেই জব্দ করা হয় এলএসডির ২০০ ব্লট।
সাদমান সাকিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর বহিষ্কৃত ছাত্র। বর্তমানে তিনি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএতে (শেষ বর্ষ) পড়াশোনা করছেন। তিনিই মূলত বছরখানেক আগে টেলিগ্রাম অ্যাপের মাধ্যমে নেদারল্যান্ডস থেকে এ মাদক অর্ডার করেন।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সাদমান জানান, তিনি টেলিগ্রাম অ্যাপে যোগাযোগ করে টিম নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে নেদারল্যান্ডস থেকে এলএসডি আনেন। সেজন্য প্রতি ব্লটে খরচ হয় এক হাজার টাকা। কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ওই মাদক দেশে এসেছে।
সাদমান ডিবির কাছে দাবি করেন, তাকে ঢাবি থেকে বহিষ্কার করা হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ার পর তিনি ঢাবি ছেড়ে এসেছিলেন। প্রথমদিকে ‘আপনার আব্বা’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ খুলে সাদমান ও তার তিন বন্ধু এলএসডি বিক্রি করছিলেন। পরে ‘বেটার ব্রাউনি অ্যান্ড বিয়ন্ড’ নামে আরেকটি গ্রুপ খোলেন। এসব গ্রুপ থেকে তারা গাঁজার নির্যাস মিশ্রিত কেকও (ব্রাউনি) বিক্রি করেন।
এ বিষয়ে ডিএমপির গোয়েন্দা (ডিবি) রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হক বলেন, ‘ওই এলএসডি এসেছে নেদারল্যান্ডস থেকে, টিম নামের এক ব্যক্তি কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ওই চালান বাংলাদেশে পাঠিয়েছেন।’