চারজনকে হত্যার পর ২ ভাইয়ের আত্মহত্যা, যা ছিল সুইসাইড নোটে

নিহত পরিবারের সদস্যরা
নিহত পরিবারের সদস্যরা  © ফাইল ফটো

যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ডালাস সংলগ্ন অ্যালেন শহরে এক বাংলাদেশি পরিবারের ৬ সদস্যের মরদেহ উদ্ধার করেছে স্থানীয় পুলিশ। টেলিফোন পেয়ে সোমবার (৫ এপ্রিল) স্থানীয় সময় ভোরে ওই বাসায় গিয়ে মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তদের ধারণা, গত শনিবার (৩ এপ্রিল) নৃশংস এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

প্রাথমিক বর্ণনায় পুলিশ জানায়, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই ভাই মিলে তাদের মা-বাবা, নানী এবং একমাত্র বোনকে হত্যার পর নিজেরাও আত্মহত্যা করেছেন।

নিহতরা হলেন ১৯ বছরের ফারহান তৌহিদ ও ফারবিন তৌহিদ, তাদের একমাত্র বোন পারভিন তৌহিদ (১৯), মা আইরিন ইসলাম (৫৬), বাবা তৌহিদুল ইসলাম (৫৪) এবং তাদের নানী ৭৭ বছরের আলতাফুন নেসা।

পুলিশের সার্জেন্ট জন ফেলী জানান, পরিবারটির কোনও একজন সদস্য আত্মহত্যা করেছেন বলে তাদের এক পারিবারিক বন্ধু পুলিশকে জানায়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে যান তারা।

এই ঘটনার আগে ইনস্টাগ্রামে দীর্ঘ একটি সুইসাইড নোটে ফারহান জানায়, নবম শ্রেণি থেকেই হতাশা আর বিষণ্ণতার বিরুদ্ধে তার লড়াই অব্যাহত রয়েছে। এ থেকে উত্তরণের পথও খুঁজছে সে। কিন্তু নিজে আত্মহত্যা করলে অন্যরা সারা জীবন কষ্ট পাবে বিধায় বড় ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে পরিবারের সবাইকে নিয়ে মারা যাবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয় সে। পরে দুই ভাই মিলে বন্দুক কিনতে যায়।

পোস্টে ফারহান আরও জানায়, সে তার ছোট বোন ও নানীকে হত্যা করবে। আর তার বড় ভাই খুন করবে তাদের মা-বাবাকে। সবাইকে শেষ করে দেওয়ার পর তারা নিজেরা আত্মহত্যা করবে। ফলে কষ্ট পাওয়ার মতো আর কেউ থাকবে না।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব নর্থ টেক্সাসের সেক্রেটারি নাহিদা আলী জানান, এমন সংবাদে সকলেই হতভম্ব। শোকাচ্ছন্ন গোটা কমিউনিটি। তৌহিদুল ইসলাম খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। তার স্ত্রী আইরিন ইসলাম নীলাও আসতেন কমিউনিটির অনুষ্ঠানে। সব সময় তারা দুই পুত্র তানভির তৌহিদ এবং ফারহান তৌহিদকে নিয়ে উচ্ছ্বাস করতেন। একইভাবে মেধাবী কন্যা পারভিন তৌহিদকে নিয়েও তার অহংকারের শেষ ছিল না। পারভিন পড়তেন নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে। সপ্তাহখানেক আগে তাকে নিউইয়র্ক থেকে বাসায় নেয়া হয়। ফারহান গত বছর ভর্তি হয়েছিলেন অস্টিনে অবস্থিত ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসে। তানভিরও পড়তেন ইউনিভার্সিটি অব টেক্সাসের অস্টিনে। তার এবারই গ্র্যাজুয়েশনের কথা। তবে ফারহান আর পারভিন ছিলো যমজ। এমন একটি পরিবারের সকলেই একইসাথে নিঃশেষ হয়ে যাবে-এটি কল্পনারও অতীত ছিল। সাথে তৌফিকের শাশুড়ি আলতাফুন্নেসাকেও মৃত্যুবরণ করতে হলো।

তৌহিদের পরিচিত ও ট্র্যাভেল ব্যবসায়ী শাহীন হাসান জানান, কোনো কারণে তৌহিদের দুই পুত্রই বিষন্নতায় আক্রান্ত ছিল। আত্মহত্যার সেই নোটে সে (ফারহান) উল্লেখ করেছে, ২০১৬ সালে  নবম গ্রেডে পড়াবস্থায় আমি বিষন্নতায় আক্রান্ত হয়েছি বলে চিকিৎসক জানায়। এজন্যে আমি পরীক্ষায় ফেল করেছি। আজ আমি নিজের শরীর দু’বার কেটেছি। খুবই কষ্ট পেয়েছি। আমার মনে আছে ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট, কাঁচির মত ধারালো অস্ত্র দিয়ে শরীরে কেটেছিলাম। অনুভব করেছি কতটা অসহনীয় যন্ত্রণা। এরপর প্রায় দিনই শরীরে রান্নাঘরের চাকু দিয়ে কেটেছি। বিষন্নতার দুঃখবোধ লাঘবের পথ খুঁজেছি। এ অবস্থায় আমার ঘনিষ্ঠ তিন বন্ধু আমাকে ত্যাগ করেছে। এমনি হতাশার মধ্যেই আমাকে ভর্তি করা হয় ইউনিভার্সিটি অব অস্টিনে কম্পিউটার সায়েন্স ডিপার্টমেন্টে। এরপর আমি ভেবেছি যে, এবার জীবনটা সঠিক ট্র্যাকে উঠেছে। বাস্তবে তা ঘটেনি। বিষন্নতায় জর্জরিত হয়ে পুনরায় আমি নিজের শরীর রক্তাক্ত করি এবং কাঁদতে কাঁদতে বিছানায় ঘুমাতে যাই। সান্ত্বনা খুঁজি যে, আমি সুস্থ হয়েছি। অন্যদের মতই স্বাভাবিক। কিন্তু সেটি সত্য বলে কখনোই মনে হয়নি।

এক পর্যায়ে সে লিখেছে, আমি যদি আত্মহত্যা করি তাহলে গোটা পরিবার সারাটি জীবন কষ্ট পাবে। সেটি চাই না। সেজন্যে পরিবারের সকলকে নিয়ে মারা যাবার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে বড়ভাইকে সামিল করলাম। দু’ভাই গেলাম বন্দুক ক্রয় করতে। আমি হত্যা করবো ছোটবোন আর নানীকে। আমার ভাই করবে মা-বাবাকে। এরপর উভয়ে আত্মহত্যা করবো। কেউ থাকবে না কষ্ট পাবার।

আত্মহত্যার প্রাক্কালে লেখা ওই নোটে সে আরও উল্লেখ করেছে, বন্দুক ক্রয়ের ব্যাপারটি খুবই মামুলি। বন্দুক নিয়ন্ত্রণ আইনের নামে তামাশা চলছে সর্বত্র। বড়ভাই গেলেন দোকানে। বললেন যে, বাড়ির নিরাপত্তার জন্যে বন্দুক দরকার। দোকানি কয়েকটি ফরম ধরিয়ে দিলে সেখানে স্বাক্ষর করলেন ভাই। এরপর হাতে পেলাম কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি, যা দিয়ে নিজের কষ্ট এবং পরিবারের কষ্ট সহজে লাঘব করা যাবে।


সর্বশেষ সংবাদ