১১ মার্চ ২০২১, ২১:৫১

শুধু মাদ্রাসা নয়, বাংলা-ইংরেজি মাধ্যমেও নির্যাতন হচ্ছে

প্রতীকী

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নিষিদ্ধ ও দণ্ডনীয় অপরাধ। তারপরও নির্যাতন থামছে না। শুধু মাদ্রাসায় নয়, বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের শিক্ষার্থীরাও শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন থেকে রেহাই পাচ্ছে না।

হাটহাজারীর মারকাযুল ইসলামি অ্যাকাডেমি নামের একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকের নির্যাতনের শিকার হয়েছে আট বছরের এক শিশু। ওই নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে পুলিশ প্রশাসন সেখানে ছুটে যায়। কিন্তু প্রথমে শিশুটির বাবা-মা শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা করতে রাজি না হওয়ায় শিক্ষক মোহাম্মদ ইয়াহিয়াকে ছেড়ে দেন তারা। পরে অবশ্য তাকে গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার মুখে।

হাটহাজারী থানার ওসি জানিয়েছেন, শিশুটির বাবাকে বুঝিয়ে মামলায় রাজি করানো হয়। আর ওই মামলায়ই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। শিক্ষক ইয়াহিয়াকে বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে হাজির করার পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

এদিকে ওই ঘটনায় হাইকোর্ট স্বপ্রণোদিত হয়ে বৃহস্পতিবার একটি রুল দিয়েছেন। শিশু নির্যাতনের ঘটনায় কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা স্থানীয় প্রশাসনকে ১৪ মার্চের মধ্যে জানাতে বলা হয়েছে।

আইন কী বলছে?

বাংলাদেশের আইনে ছাত্রদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি দেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ। ২০১১ সালে হাইকোর্টের এক আদেশের পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি বন্ধে নীতিমালা প্রণয়ন করে। আর তাতে শারীরিক ও মানসিক শাস্তির সংজ্ঞাও দেয়া হয়েছে।

শারীরিক শাস্তি বলতে যেকোনো ধরনের দৈহিক আঘাত বলা হয়েছে। মারধর ছাড়াও আইনে কান ধরা, চুল টানা, বেঞ্চের নিচে মাথা রাখতে বাধ্য করাও দৈহিক শাস্তি। আর মানসিক শাস্তির মধ্যে শিশু বা তার পরিবারকে উদ্দেশ্য করে বাজে মন্তব্য বা যেকেনো আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় এই দুই ধরনের শাস্তি দেয়াকেই শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলেছে। যাদের বিরুদ্ধে এই অপরাধ প্রমাণ হবে তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু এরপরও বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শাস্তি দেয়ার প্রবণতা বেশ লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে মাদ্রাসায় এটা প্রকট।

যে তথ্য পাওয়া যায়:

২০১৩ সালে ইউনিসেফের একটি জরিপে প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ৯ জন জানিয়েছে, তারা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক নির্যাতনের শিকার। আর প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৭ জন শিশু জানায়, তারা বাড়িতে অভিভাবকদের হাতে শারীরিক শাস্তি পায়।

ইউনিসেফ বলছে, ২০১০ সাল পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শতকরা ৯১ ভাগ এবং বাড়িতে শতকরা ৭১ ভাগ শিশু শারীরিক শাস্তির শিকার হয়েছে। জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশের স্কুলগুলোতে বেত বা লাঠির ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে এবং ৮৭ দশমিক ৬ শতাংশ ছাত্র এই বেত বা লাঠির শিকার হয়।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী গত বছর (২০২০) সারাদেশে এক হাজার ৭৪১টি শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এরমধ্যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকের হাতে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১২৫টি শিশু। এইসব ঘটনায় মোট মামলা হয়েছে আটটি। এই সময়ে শিক্ষকদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে ১৪ জন শিক্ষার্থী। ছেলে শিশুরাও যৌন হয়রানীর শিকার হয়েছে।

জাতীয় মাননিসক স্বাস্থ্য ইন্সটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও শিশু মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ জানান, করোনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। কিন্তু স্বাভাবিক সময়ে তার চেম্বারে প্রতি মাসে ১০-১২টি শিশুকে তার অভিভাবকেরা নিয়ে আসেন। যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার। আর এখন মাদ্রাসা খোলা থাকায় সেখান থেকেও শিশুদের নিয়ে আসা হয়।

তিনি বলেন, ‘‘আমার অভিজ্ঞতা হলো মাদ্রাসায় শারীরিক নির্যাতন বেশি হয়। আর বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে মানসিক নির্যাতন বেশি হয়। ভাবার কোনো কারণ নেই যে মাদ্রাসার বাইরে নির্যাতন হয় না।

তিনি আরও জানান, মাদ্রাসায় যেমন যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষকদের দ্বারা বুলিং-এর শিকার হন শিক্ষার্থীরা। তার অভিজ্ঞতা বলছে, গড় হিসেবে সব ধরনের নির্যাতন মিলিয়ে মাদ্রাসায় ৬০ ভাগ আর বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ৪০ ভাগ ঘটনা ঘটে।

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, এই দুই ধরনের নির্যাতনের ফলে প্রথমত, শিশুদের ওপর প্রচণ্ড মানসিক চাপ পড়ে। তারা বিষন্নতা উদ্বেগ ও আতঙ্কের মধ্যে থাকে। মানসিক বিকাশ বাধা পায়। তারা স্কুল ও লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আর দীর্ঘ মেয়াদে তারা নেতিবাচক মানসিকতা নিয়ে বড় হয়। ব্যক্তিত্বের বিকাশ হয় না। হীনমন্যতায় ভোগে। আবার সে নিজেও বড় হয়ে নিপীড়ক ও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারে।

কেন এমন হচ্ছে?

শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিপত্র জারি করেই তাদের দায়িত্ব শেষ করেছে। স্কুল গুলোতে চাইল্ড সাইকোলজিস্ট নিয়োগ করার বিধান থাকলেও তা করা হয় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মজিবুর রহমান বলেন, ‘‘এখানে শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার দর্শন অনুযায়ী গড়ে ওঠেনি। নানা ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত। কেউ কেউ মনেই করেন কিছুটা মারপিট সুশিক্ষার জন্য দরকার আছে। আর কওমী মাদ্রাসাগুলো যেহেতু সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই তাই তারা সরকারের নির্দেশও মানতে চায় না।’’

তিনি বলেন, ‘‘ওস্তাদের মার খেলে ওই জায়গাটা বেহেশতে যায়- এটা যদি হয় চিন্তা তাহলে মারপিট থামবে কীভাবে? হাটহাজারীও মাদ্রাসার শিশুটির বাবা এই ধরনের চিন্তার কারণেই প্রথমে মামলা করতে চাননি।’’ তার মতে, সামাজিক এই দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই শিশুদের বলাৎকার করেও কেউ কেউ রেহাই পেয়ে যান। [সূত্র: ডয়চে ভেলে বাংলা]