অনলাইন ক্লাসের ফাঁকে বাড়ছে পর্নোগ্রাফি সাইট দেখার ঝোঁক

অনলাইনে পড়াশোনা
অনলাইনে পড়াশোনা  © সংগৃহীত

অনলাইনে ক্লাসের বিরতিতেই কিছু পর্নোগ্রাফিক ওয়েবসাইট খুঁজে বের করেছিলো ১৪ বছরের ঋক। সে তাতে আসক্ত হয়ে যাওয়ার পরে মা-বাবা বিষয়টি বুঝতে পারেন। ছেলের আসক্তি কাটাতে অবশেষে মনোবিদের দ্বারস্থ হন তারা। অনলাইনে আচমকাই একজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিলো দশ বছরের তিয়াসার। নিজেকে যুবক বলে পরিচয় দিয়ে যখন পঞ্চাশোর্ধ্ব ওই ব্যক্তি তাকে যৌন ইঙ্গিত দিতে শুরু করে, তখন সচেতন হন শিশুটির মা-বাবা।

উপরের চরিত্র দু’টি কাল্পনিক হলেও, ঘটনাগুলো পুরোপুরি বাস্তব। ইন্টারনেটের সুবিধা থাকায় করোনাকালে যেমন পড়াশোনা থেমে থাকেনি, তেমনই মুদ্রার অন্য পিঠে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইন্টারনেটের অপরিহার্যতা ডেকে এনেছে কিছু বিপদও। লকডাউনের সময়ে উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গিয়েছে অনলাইনে শিশু-কিশোরদের যৌন হেনস্থার শিকার হওয়ার ঘটনা।

সম্প্রতি এই বিষয়ে ভারতের দিল্লি সরকার সেখানকার স্কুলের কর্তৃপক্ষদের সতর্ক করেছেন। সচেতন করা হয়েছে অভিভাবকদেরও। কলকাতার অনেক স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও মনে করছেন, যেহেতু এখনো অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী অনলাইনে ক্লাস করছে, তাই ক্লাসের বিরতিতে তারা ইন্টারনেটের মাধ্যমে অন্য কিছুর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে কি না সেই নজরদারির দায়িত্ব মা-বাবাদেরই নিতে হবে।

হেরিটেজ স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা সীমা সাপ্রু বলেন, পড়ুয়ারা যে মোবাইল ফোন অথবা কম্পিউটারের সাহায্যে অনলাইনে ক্লাস করছে, সেটা অভিভাবকেরাই তাদের দিচ্ছেন। ওই যন্ত্রে যথাযথ চাইল্ড লক বা নজরদারির পদ্ধতি রাখা উচিত।

মহাদেবী বিড়লা স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা অঞ্জনা সাহার কথায়, আমরা স্কুলের তরফে সচেতনতা প্রসারের সব রকম চেষ্টা করি। বিভিন্ন ক্লাসের সময়সূচি এবং ক্লাস শেষ হওয়ার পরে তার রিপোর্ট অভিভাবকদের পাঠানো হয়। যাতে অন্য কোনো সময়ে তাদের ছেলে-মেয়েরা ক্লাস করার অজুহাত দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার করতে না পারে।

শিশু-কিশোরদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে রাজ্য শিশু সুরক্ষা কমিশনও। সুরক্ষিতভাবে ইন্টারনেট ব্যবহারের বার্তা দিয়ে ‘নেটে থাকবো, কিন্তু জালে পড়বো না’- এই শিরোনামে একটি ভিডিও প্রচার করেছে তারা।

‘খুব বেশি অভিযোগ জমা না পড়লেও এমন কিছু কিছু ঘটনা ঘটছে। এই বিষয়ে শিশুদের সচেতন করতে আমরা বিভিন্ন রকম পদক্ষেপ করছি’, বলছেন শিশু সুরক্ষা কমিশনের চেয়ারপার্সন অনন্যা চক্রবর্তী।

অনলাইনে যৌন হেনস্থার মতো ঘটনা প্রভাব ফেলে শিশুদের মনে। বহু ক্ষেত্রে সেই ঘটনার কথা জানাতে সঙ্কোচবোধ করে তারা। সে কারণে নিয়মিত ভাবে মনোবিদের সঙ্গে আলোচনার ব্যবস্থা করেছে হেরিটেজ স্কুল। বিশেষজ্ঞেরা এসে সাইবার অপরাধ সম্পর্কে পড়ুয়াদের সঙ্গে কথা বলেছেন বলে জানালেন প্রধান শিক্ষিকা সীমাদেবী।

অঞ্জনাদেবীও বলেন, আমরা নিয়মিত সাইবার অপরাধ এবং সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে পড়ুয়াদের সচেতন করে থাকি। মনোবিদদের সঙ্গেও ছাত্রছাত্রীদের আলোচনার ব্যবস্থা করা হয়।

কী বলছেন অভিভাবকরা? পঞ্চম শ্রেণির এক পড়ুয়ার মা পৃথা পাল বলেন, যেহেতু আমি এবং আমার স্বামী কাজে বেরিয়ে যাই, তাই অনেকটা সময় মেয়ে একা থাকে। খেয়াল করেছি, ও ক্লাসের মাঝে ইন্টারনেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে এমন কিছু ওয়েবসাইট খুলে ফেলছে, যেগুলো ওর দেখার কথা নয়। আমরা মেয়েকে ওর মতো করে এর বিপদ সম্পর্কে বুঝিয়েছি। কখনো কখনো ওর ভালোর জন্যই আমাদের কঠোর হতে হয়েছে।

সন্তানের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনায় বিশ্বাসী নবম শ্রেণির আর এক পড়ুয়ার মা লোপামুদ্রা মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, এখন তো বাচ্চাদের ইন্টারনেট থেকে দূরে রাখার কোনো উপায় নেই। তাই ওদের সচেতন করার দায়িত্বও আমাদের। বাড়িতে এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে শিশুরা যে কোনো সমস্যার কথা মা-বাবাকে জানাতে পারে।

এই ভাবনার সঙ্গে সহমত মনোরোগ চিকিৎসকরাও। মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায় বলেন, লকডাউনের মধ্যে আমি এমন বহু ঘটনার কথা শুনেছি, যেখানে বাচ্চারা সাইবার যৌনতার মতো অপরাধের শিকার হয়েছে। তা থেকে আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটেছে। ছোট বাচ্চাদের ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে মা-বাবাদের নজর রাখতে হবে।

তার মতে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে অচেনা কারো সঙ্গে তারা যাতে কথা না বলে, সেটা বোঝাতে হবে। কেউ কিছু লুকোতে চাইছে বুঝতে পারলেই সচেতন হওয়া দরকার। বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের খোলাখুলি বোঝাতে হবে সাইবার অপরাধের বিষয়গুলো।

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা


সর্বশেষ সংবাদ