১০ ডিসেম্বর ২০২০, ১১:২৭

নভেম্বরে বলাৎকারের শিকার ২৬ শিশু

শিশু ছাত্র বলাৎকারের অভিযোগে গ্রেপ্তার কয়েকজন  © ফাইল ফটো

দেশে শিশু বলাৎকারের সংখ্যা উদ্বেগজনকহারে বাড়ছে। বছরজুড়েই গণমাধ্যমে এ ধরনের খবর পাওয়া গেলেও বিগত নভেম্বরের পরিসংখ্যান কপালে চিন্তার ভাজ ফেলছে অনেকের। এ মাসে ১৯ ঘটনায় অন্তত ২৬ জন শিশু এ অপরাধের শিকার হয়েছে। এরমধ্যে ২১ জনই মাদ্রাসার, বাকি ৫ জন অন্যান্য স্থানের। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ঘেটে এ তথ্য পাওয়া গেছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি বলে অনেকে মনে করছেন।

দেশে ধর্ষণের ঘটনা সম্প্রতি বেড়ে গেছে। এ অপরাধের শাস্তি আগের চেয়ে কঠোর করেছে আদালত। সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডও নির্ধারণ করা হয়েছে। এরইমধ্যে বলাৎকারের ঘটনাগুলোও সামনে আসছে। ভুক্তভোগী নারী ও মেয়ে শিশুরা যে ভয়াবহ শারিরিক ও মানসিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন, প্রায় একই ধরনের নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন ছেলে শিশুরাও। আর বলাৎকারের ঘটনাগুলোর প্রায় সবগুলোই ঘটছে মাদ্রাসায়। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বলাৎকারের ঘটনা প্রকাশিত সংখ্যার চেয়ে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। আর এ অপরাধের প্রকৃত চিত্র এবং এর প্রভাব আরও করুণ ও ভয়াবহ। ভুক্তভোগী শিশুরা দীর্ঘদিন ধরে প্রচণ্ড মানসিক পীড়ায় থাকেন। অথচ অনেক দোষী অচিহ্নিত এবং বিচারের আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। কঠোর আইন, প্রচার প্রচারণা ও উচ্চ আদালতের নানা ধরনের নির্দেশনার পরও এ ধরনের ঘৃন্য সহিংসতা কমানো যাচ্ছে না। আইনে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকাও এ ধরনের অপরাধের বিচারে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

গণমাধ্যমের খবর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, নভেম্বর লক্ষ্মীপুরে ছয় শিশু ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে মোবারক হোসেন (২৮) নামে এক মাদরাসা পরিচালককে গ্রেফতার করা হয়। টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে চতুর্থ শ্রেণির দুই মাদ্রাসা ছাত্র বলাৎকারের শিকার হয়। আর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে মিজানুর রহমান (২৭) নামে এক মাদরাসা শিক্ষককে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।

এদিকে ময়মনসিংহের গৌরীপুরে এতিমখানার ৮ ও ৯ বছরের দুই শিশুকে বলাৎকারের অভিযোগে মাদ্রাসার শিক্ষক মো. বাকী বিল্লাহ মানিককে (৩৫) গ্রেপ্তার করা হয়। এছাড়া গাজীপুরের শ্রীপুর পৌর এলাকার কেওয়া পশ্চিম খন্ড গ্রামে কোরআন শিক্ষা দেয়ার কথা বলে এক শিশুকে (১২) বলাৎকারের মামলার আসামি ক্বারী মো. মুকবুল হোসেনকে (৫০) গ্রেপ্তার করা হয়। কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ীতে টেলিভিশন দেখার প্রলোভনে এক শিশু বলাৎকারের শিকার হয়।

বগুড়ার শেরপুরে বলাৎকারের শিকার হয় তিন বছরের এক শিশু। ঠাকুরগাঁও সদরে ছাত্রকে বলাৎকারের চেষ্টার অভিযোগে একটি কওমি মাদ্রাসার প্রধান শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়। আর মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় এক কিশোরকে (১৬) সংঘবদ্ধভাবে বলাৎকারের অভিযোগ ওঠে। এছাড়া কুমিল্লার দেবিদ্বার পৌর এলাকার ‘জামিয়া ইসলামিয়া বাইতুন-নূর হাফিজিয়া মাদ্রাসা’র এক শিশুকেও (১৩) বলাৎকারের অভিযোগ উঠেছে।

অপরদিকে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ১০ বছরের মাদরাসা শিক্ষার্থীকে বলাৎকারের অভিযোগে কাউছার আহম্মেদ (২৮) নামের এক শিক্ষককে গ্রেপ্তার করা হয়।
ময়মনসিংহের ফুলপুরে ১২ বছর বয়সী এক মাদরাসা ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে আব্দুর রাজ্জাক মুন্সি (৫৫) নামের এক বৃদ্ধকে গ্রেপ্তার করা হয়। কুমিল্লার নাঙ্গলকোট ১১ বছরের এক মাদ্রাসা ছাত্রকে হাত পা বেঁধে বলৎকারের অভিযোগে আনা মিয়া নামে (৫২) এক ব্যবসায়ী আটক হন। নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার চরজব্বর ইউনিয়নে দশ বছর বয়সী দ্বিতীয় শ্রেণির এক ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগ ওঠে।

এর বাইরে হবিগঞ্জ সদর উপজেলার চাঁনপুরে ক্লাসের ভেতরে ছাত্রকে বলাৎকারের অভিযোগে তারেক মিয়া নামে এক মাদ্রাসাশিক্ষককে আটক করেছে পুলিশ। বরিশালের উজিরপুরে এক শিশুকে বলাৎকারের অ‌ভিযোগে এক মসজিদের ইমামকে গ্রেপ্তার করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২০ বছরের এক যুবককে জুসের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে পাঁচজন মিলে পালাক্রমে বলাৎকারের অভিযোগ উঠেছে।

দিনাজপুরের হিলিতে একটি মসজিদের মুয়াজ্জিন ইব্রাহিম হোসেন (২৫) কর্তৃক আরবি পড়ুয়া আট বছরের এক শিশু ছাত্রকে বলাৎকারের ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া রংপুরের তারাগঞ্জে মসজিদের ইমাম কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১০ বছরের এক শিশু।

এমন জঘন্য অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত বলে মনে করছেন মাদ্রাসা সংশ্লিষ্টরাও। রাজধানীর একটি কওমি মাদ্রাসার সাবেক ছাত্র তাজাম্মুল হোসেন বলেন, ‘এটি অবশ্যই ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ। এর কঠোর শাস্তি হওয়া উচিত। মাদ্রাসার মতো জায়গাকে বিতর্কিত করার কোনো অধিকার তাদের নেই। ভবিষ্যতেও যাতে এ ধরনের অপরাধ না হয়, সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র রাতুল বলেন, ‘এ ধরনের অপরাধ ধর্ষণের চেয়ে কম নয়। এ ঘটনাগুলো মাদ্রাসার মতো স্থানে ঘটছে, যা আরও বেশি স্পর্শকাতর। সেক্ষেত্রে এটি দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার হওয়া দরকার।’

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক তাসলিমা ইয়াসমীন বলেন, প্রথমত আইনি ব্যাখ্যায় ছেলে শিশুর ধর্ষণকে ধারা ৯-এ অন্তর্ভুক্ত করা গেলেও প্রচলিত আইনে যে অস্পষ্টতা রয়েছে তা দূর করা প্রয়োজন। দণ্ডবিধির ধারা ৩৭৫-এ ধর্ষণের সংজ্ঞায় ধর্ষণের শিকার ব্যক্তিকে বুঝাতে নারীর পাশাপাশি ‘শিশু’ শব্দটি যুক্ত করতে হবে। একই সাথে দণ্ডবিধির ৩৭৫-এর সংজ্ঞায় ‘পেনেট্রেশন’ বা ‘প্রবিষ্ট করা’ এই শব্দটির একটি যথাযথ ব্যাখ্যা অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যাতে সমলিঙ্গের মাধ্যমে যৌন সঙ্গমকেও ‘পেনেট্রেশন’ বলা যায়।

তিনি বলেন, এর পাশাপাশি ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে’ ‘শিশু’র সংজ্ঞায় ছেলে, মেয়ে বা অন্য কোন লিঙ্গ পরিচয়ের অনধিক ১৬ বছর বয়সী শিশুর কথা সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা যেতে পারে, যেকোন ধরনের অস্পষ্টতা দূর করার জন্য। যেহেতু অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, বিচার ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই এ বিষয়টি নিয়ে স্পষ্ট ধারণা রাখেন না। তাই থানা পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্য থেকে শুরু করে আইনজীবী, বিচারক এবং পাবলিক প্রসিকিউটরদেরকেও এই বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া প্রয়োজন।

তার মতে, এ ধরণের অপরাধের বিষয়ে জাতীয় পর্যায়েও সচেতনতামূলক পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। এতে করে ছেলে শিশুও যে ধর্ষণের বিচারের বাইরে নয়, সেটি সাধারণের কাছে স্পষ্ট হবে। সর্বোপরি ধর্ষণকে ধর্ষণই বলতে হবে, বলাৎকার নামকরণ করে এই অপরাধের মাত্রা কমানোর কোন সুযোগ নেই বলেও মনে করেন তিনি।