একা নির্জন কনডেম সেলে মিন্নি, দেওয়া হয়েছে দুই সেট পোশাক
বরগুনায় আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিসহ অপর ছয় আসামিকে জেলা কারাগারের কনডেম সেলে রাখা হয়েছে। এই কনডেম সেলে রিফাত হত্যার ছয় আসামি ছাড়া অন্য কোনো বন্দিই নেই বলে জানিয়েছেন বরগুনা জেলা কারাগারের তত্ত্বাবধায়ক (জেল সুপার) মো. আনোয়ার হোসেন।
মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, এই মুহূর্তে বরগুনার কারাগারে নারী বন্দিদের মধ্যে একমাত্র মিন্নিই নির্জন কনডেম সেলে আছেন। মিন্নি ব্যতীত বরগুনার কারাগারের কনডেম সেলে অন্য কোনো নারী বন্দি নেই। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর পাঁচ আসামিকেও কনডেম সেলে রাখা হয়েছে। রিফাত হত্যায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামি ছাড়া কনডেম সেলে আপাতত অন্য কোনো বন্দী নেই।
মিন্নিসহ বাকি আসামিরা কনডেম সেলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন জানিয়ে এই জেল সুপার আরো বলেন, কারাবিধি অনুযায়ী ছয় বন্দিকেই কনডেম সেলে থালা, বাটি ও কম্বল দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া প্রতি আসামিকে কারাগারের পক্ষ থেকে দুই সেট পোশাক দেওয়া হয়েছে। এ পোশাক তারা পরিধান করবেন।
গতকাল বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। মৃত্যুদণ্ডের পাশাপাশি ছয় আসামির সবাইকে ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছেন আদালত। এ হত্যার ঘটনায় পুলিশ ২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিলেও তার মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিচার চলে এ আদালতে।
গত বছর বরগুনা জেলা শহরের কলেজ রোডে প্রকাশ্যে রিফাত শরীফকে তিন যুবকের রামদা দিয়ে কোপানোর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে স্তম্ভিত হয়ে যায় গোটা দেশ। দাবি ওঠে আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামি হলেন- রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজী (২৩), আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আকন (২১), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রেজোয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় (২২), মো. হাসান (১৯) এবং রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি (১৯)। এ ছাড়া হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পাওয়া চার আসামি হচ্ছেন- মুসা (২২), রাফিউল ইসলাম রাব্বি (২০), সাগর (১৯) ও কামরুল হাসান সায়মুন (২১)।
এর মধ্যে মুসা এখনো পলাতক। গতকাল রাতে খালাস পাওয়া চার আসামির মধ্যে কারাগারে থাকা তিনজন মুক্তি পেয়েছেন। এ মামলার অন্যতম আসামি সাব্বির আহমেদ ওরফে নয়ন বন্ড পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল তাকে। রিফাতের স্ত্রী বরগুনার সরকারি কলেজের ডিগ্রি প্রথম বর্ষের ছাত্রী মিন্নিকে হামলার মুখে স্বামীকে বাঁচানোর প্রাণপণ চেষ্টা করতে দেখা গিয়েছিল ভিডিওতে। তিনি ছিলেন মামলার এজাহারের এক নম্বর সাক্ষী। কিন্তু তদন্তের পর হঠাৎ পুলিশ মামলার অভিযোগপত্রে মিন্নির নাম যুক্ত করে আসামির তালিকায়।
রায়ে আদালত বলেছেন, মিন্নিও যে তার স্বামীকে হত্যার ষড়যন্ত্রে যুক্ত ছিলেন, প্রসিকিউশন তা প্রমাণ করতে পেরেছে। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, ‘রিফাত হত্যা মামলার আসামিদের নির্মম বর্বরতা ও নির্মমতা মধ্যযুগীয় কায়দাকেও হার মানিয়েছে। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে তাদের অনুসরণ করে অন্য যুবকরাও ধ্বংসের পথে যাবে। এসব আসামি সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।’
রায় ঘোষণার সময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ভুবন চন্দ্র হাওলাদার এবং মিন্নির পক্ষে আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলাম। এ ছাড়া আসামিপক্ষের অন্য আইনজীবীরাও উপস্থিত ছিলেন। চাঞ্চল্যকর এ মামলার রায় ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গতকাল ভোর থেকেই বরগুনার আদালত এলাকায় নেওয়া হয় কড়া নিরাপত্তাব্যবস্থা। বাড়ানো হয় পুলিশি টহল। বসানো হয় নিরাপত্তা চৌকি।
সকাল ৮টা ৫২ মিনিটের দিকে বাবার সঙ্গে মোটরসাইকেলে বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আসেন মামলার সাক্ষী থেকে আসামি হওয়া আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। এরপর সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে বরগুনা জেলা কারাগার থেকে প্রিজন ভ্যানে মামলার আট আসামিকে বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে নিয়ে আসা হয়। রায় ঘোষণার পর মিন্নিকে কালো রঙের মাইক্রোবাসে করে আদালত থেকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। দণ্ডিত বাকি আসামিদের কারাগারে নেওয়া হয় প্রিজন ভ্যানে।
গত বছরের ২৬ জুন সকালে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে কিশোর গ্যাং বন্ড বাহিনী কুপিয়ে গুরুতর জখম করে রিফাত শরীফকে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওই দিন বিকেলেই বরিশাল শেরেবাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন রিফাত। পরদিন ২৭ জুন রিফাতের বাবা মো. আবদুল হালিম দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো পাঁচ থেকে ছয়জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। ঘটনার ছয় দিন পর ২ জুলাই ভোররাতে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন এ মামলার আলোচিত প্রধান আসামি সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড।
তদন্ত শেষে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ২৪ জনকে অভিযুক্ত করে প্রাপ্তবয়স্ক এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক দুই ভাগে বিভক্ত করে দুটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে পুলিশ। এর মধ্যে ১০ জন প্রাপ্তবয়স্ক আসামি এবং ১৪ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক। নয়ন বন্ড বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ায় অভিযোগপত্রে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় তাকে। পরে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে মামলাটির বিচার শুরু হয়। ৮ জানুয়ারি থেকে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি এ মামলার ৭৬ জন সাক্ষীর জবানবন্দি নেওয়ার মধ্য দিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের বিরুদ্ধের সাক্ষ্য গ্রহণ সম্পন্ন করেন আদালত। ১৬ সেপ্টেম্বর উভয় পক্ষের যুক্তি-তর্ক শেষে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির রায় ঘোষণার জন্য ৩০ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করা হয়।