২৫ দিনে ৫৯ ধর্ষণ, আইনের প্রয়োগের অভাব— বলছেন বিশেষজ্ঞরা
অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় সাম্প্রতিক সময়ে নারীর প্রতি সহিংসতা এবং যৌন নিপীড়ন আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সাথে পারিবারিক সহিংসতা ও শিশু নির্যাতনও বেড়েছে। স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানুষের নৈতিকতার চরম অবক্ষয়, বিচার কাজে দীর্ঘ সূত্রিতা, দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হওয়া এবং অনেক ক্ষেত্রে বিচারহীনতার ফলেই একের পর এক ধর্ষণ এবং যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে। এসব অনৈতিক নিকৃষ্ঠ ঘটনা প্রবাহ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নিন্দনীয় এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হলেও বর্তমানে এটি স্বাভাবিক অবস্থায় রূপ নিচ্ছে। সারাদেশেই আশংকাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে ধর্ষণের ঘটনা। এমনকি নিজ পরিবারের মানুষের থেকেও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন নারীরা।
ময়মনসিংহের নান্দাইলের মো. জলিলের ছেলে বুলবুল মিয়া পেশায় একজন ইজিবাইক চালক। প্রায় এক যুগ আগে তিনি বিয়ে করেন পাশের বাড়ির এক কিশোরীকে। তার বিয়ের পর স্ত্রীর চাচাতো বোন অর্থ্যাৎ তার শ্যালিকার জন্ম দেখছেন তিনি। সেই বোনকেই (শ্যালিকা) প্রায় মাস পাঁচেক আগে ঘরে একা পেয়ে ধর্ষণ করেন তিনি। পরে বেকায়দায় পড়ে বুলবুল একপর্যায়ে স্থানীয় মৌলভীকে দিয়ে শ্যালিকাকে বিয়ে করেন।
কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে ধর্ষিতা ভাতিজির গর্ভে জন্ম নেওয়া সন্তানের ডিএনএ পরীক্ষা করে আপন চাচার সম্পৃক্ততা পাওয়া খবর সারাদেশে বেশ আলোড়ন তৈরি করেছে। ধর্ষক আপন চাচা সোহেল (৪৫) তার ১৪ বছর বয়সী কিশোরী ভাতিজিকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। পরবর্তীতে কিশোরী অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় গত জুন মাসের শেষ দিকে সিজারের মাধ্যমে ওই কিশোরী মেয়ে সন্তান জন্ম দেয়। সন্তানের পিতৃ পরিচয় নিয়ে সন্দেহের সৃষ্টি হলে ডিএনএ পরীক্ষা করে আপন চাচা সোহেল জড়িত থাকার কথা নিশ্চিত হয় প্রশাসন।
চাঁদপুররের ফরিদগঞ্জে বাবা কর্তৃক নিজ মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে মেয়ের মা মুক্তা বেগমের লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে রবিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) পুলিশ ধর্ষক বাবা মনির হোসেনকে আটক করে। খোদ রাজধানীতেই মুমূর্ষু স্বামীর জন্য রক্ত জোগাড় করতে গিয়ে গত শুক্রবার (২৫ সেপ্টেম্বর) রাতে মিরপুরের মনিপুরী পাড়ায় ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক নারী। নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে রবিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) নিখোঁজ স্বামীকে খুঁজতে গিয়ে আড়াই বছরের ছেলের সামনে পালাক্রমে ধর্ষণের শিকার হয়েছে এক গৃহবধূ। আর সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে তরুণী গণধর্ষণের ঘটনা বর্তমানে ’টক অব দ্যা কান্ট্রি’ তে পরিণত হয়েছে।
এরকম অসংখ্য ধর্ষণ, ধর্ষণ চেষ্টা, যৌন নিপীড়ন সহ নারীর প্রতি সহিংসতা দিনকে দিন বৃদ্ধিই পাচ্ছে। প্রতিনিয়তই লম্বা হচ্ছে ধর্ষিতার সংখ্যা।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সলিশ কেন্দ্র (আসক) কর্তৃক সম্প্রতি প্রকাশিত হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯৪৮জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে চলতি মাসের প্রথম ২৫ দিনেই ৫৯টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। অর্থ্যাৎ প্রতিমাসে গড়ে ১০৫ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে আবার ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৪১ জন। ধর্ষণের পর মানসিক চাপে আত্মহত্যা করেছেন ৯ জন। আর ধর্ষণ চেষ্টার শিকার হয়েছেন ১৯২ জন। গেল বছর অর্থ্যাৎ ২০১৯ সালের চিত্রটাও ছিলো বেশ ভয়াবহ। পুরো বছর জুড়ে ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন এক হাজার ৪১৩ জন নারী। যাদের মধ্যে ৭৬ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিলো ৷ আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০জন ৷২০১৮ সালে বছর জুড়ে ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ছিলো ৭৩২জনে। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছিলো ৬৩ জনকে। অর্থাৎ, বিষয়টি পরিষ্কার যে ২০১৮ বছরের তুলনায় ধর্ষণের ঘটনা ২০১৯ সালে দ্বিগুণ বেড়েছে। ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৮ জন নারী৷ ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৪৭ জন নারী। আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১১ জন। ২০১৬ সালে ৭২৪ জন নারী ধর্ষণের শিকার হন। এর মধ্যে ধর্ষণের পর ৩৭ জনকে হত্যা করা হয় আত্মহত্যা করেন ৮ জন।
মানবসমাজের দীর্ঘদিনের নীতি নৈতিকতা এবং মূল্যবোধের যে অবক্ষয় ঘটছে এসব ঘটনা তারই ফল—এমনটাই ভাবছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এবং শিক্ষা অধিকার কর্মী রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা বা যৌন নিপীড়ন এটা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নতুন কিছু নয়। আমরা প্রায়ই পত্র-পত্রিকা এবং গণমাধ্যমে এসব ব্যাপারে অনেক সংবাদ দেখতে পাই। বর্তমানে দিনকে দিন এই সমস্যা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে, শতকরা আশি শতাংশ নারীকে জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে ঘরে বা বাইরে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। নৈতিক অবক্ষয় রীতিমতো চরম আকার ধারণ করেছে। আমরা আমাদের প্রজন্মকে প্রকৃত নৈতিকতার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে ব্যার্থ হচ্ছি। এছাড়াও শুধুমাত্র পরীক্ষাকেন্দ্রীক পড়াশোনার দরুন শিক্ষা ব্যবস্থাও মূল্যবোধের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত করতে তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারছে না।
এই মুহূর্তে এসব অনৈতিক কার্যাবলির লাগাম টানতে কি ব্যবস্থা নিতে হবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আমাদের দেশে আইনের অভাব নেই কিন্তু অভাব হচ্ছে যথাযথ প্রয়োগের। একজন নারী যখন ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন বা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন অনেক ক্ষেত্রেই তিনি যথাযথ প্রতিকার পান না। উপরন্তু সামাজিক ভাবেও তাঁকে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকেও অনেকসময় সহযোগিতার বদলে হয়রানির শিকার হতে হয়। এসব বিষয়ে গড়িমসির বদলে সহযোগী এবং দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।”
এছাড়াও আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে যৌন নিপীড়ন বা এর সাথে জড়িত ব্যাক্তিদের কঠোর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা এবং সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকাতে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলেও মনে করছেন তিনি।
সমাজ বিজ্ঞানী এবং ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, “যৌন নিপীড়ন বা নারীর প্রতি সহিংসতা তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর একটি কমন সমস্যা। উন্নত দেশের সাথে তুলনা করলে স্বাভাবিক ভাবেই দেখা যায় নারীদের সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ় না হবার কারণে প্রায়শই তাঁদের নিগৃহীত হতে হয়৷ আবার পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাও এই সমস্যার জন্য অনেকাংশেই দায়ী। এছাড়াও আইনের যথাযথ এবং কঠোর প্রয়োগ না হওয়া, নৈতিকতার অবক্ষয়, সামাজিক সম্প্রীতি বা এলাকাভিত্তিক আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কমে যাওয়াও এর উল্লেখযোগ্য কারণ। সামাজিকভাবে নৈতিকতার অবক্ষয় রোধে সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, কার্যত নীতি নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ বজায় রাখতে এখনি পদক্ষেপ না নিলে পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে হবে এবং সামাল দেওয়া আরো কষ্টসাধ্য হবে।