মাস্ক ও থার্মোমিটার নিয়ে দুর্নীতি

নয় কোটি টাকার ক্রয়ে আট কোটিই লোপাট

  © ফাইল ফটো

দেশে চলমান করোনা পরিস্থিতিতে ভাইরাস সংক্রমণ রোধে ৯ কোটি ২০ লাখ ৬০ হাজার টাকার মাস্ক ও ইনফ্রায়েড থার্মোমিটার কেনায় বড় ধরনের দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে র‌্যাব। এতে করোনায় ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যান্ডেমিক প্রিপিয়ার্ডনেস (ইআরপিপি) প্রকল্পের কেনাকাটায় উপেক্ষা করা হয়েছে ক্রয়প্রক্রিয়ার নির্ধারিত নিয়মকানুন।

এতে নিম্নমানের মাস্ক ও থার্মোমিটারের ক্ষেত্রে প্রচলিত বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি দাম দেখানো হয়েছে। ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের এনওসি ছাড়াই চীন থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে এসব পণ্য আনা হয়। সরবরাহকৃত পণ্য টেকনিক্যাল কমিটি অনুমোদনের আগেই দু’দফায় ৮ কোটি ২৮ লাখ টাকাই তুলে নেয়া হয়।

সিম কর্পোরেশন নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পুরো টাকা লোপাটের সঙ্গে জড়িত। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) এরই মধ্যে অনুসন্ধান চালিয়ে এসব পণ্য শনাক্ত এবং অনিয়মের তথ্য পেয়েছে। অভিযানে দুর্নীতিতে জড়িত থাকার দায়ে তিনজন জ্ঞাত এবং অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি দিয়ে মামলা করে র‌্যাব।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এবিএম খুরশীদ আলম বলেন, অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের অনেককে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, এটা অবশ্যই ইতিবাচক। আমি প্রত্যাশা করছি- এই প্রক্রিয়ায় প্রকৃত দোষীরা বিচারের আওতায় আসবে, শাস্তি পাবে। ভবিষ্যতে আর কেউ এ ধরনের অন্যায় করবে না।

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ এ বিষয়ে বলেন, সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতেই একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে অভিযান পরিচালনা হয়। ঘটনাস্থলে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট বুঝতে পারেন এই ঘটনায় বড় ধরনের জালিয়াতি রয়েছে, যা ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সমাধানযোগ্য নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই মামলা করা হয়।

এই প্রকল্পের ৮ কোটি ২৮ লাখ ৫৪ হাজার টাকা যে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় হাতিয়ে নেয়া হয়েছে, তার তথ্যপ্রমাণ র‌্যাবের হাতে রয়েছে।

জানা গেছে, ২৭ আগস্ট রাজধানীর কাফরুল থানায় এ সংক্রান্ত মামলা দায়ের করেন র‌্যাব-১ এর জেসিও শ্রী কিরণ চন্দ্র সরকার।

এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন, চলমান করোনাভাইরাস মহামারী প্রতিরোধে সরকার জরুরি ভিত্তিতে কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যান্ডেমিক প্রিপিয়ার্ডনেস (ইআরপিপি) নামের প্রকল্প চালু করে। এই প্রকল্পের আওতায় সিম কর্পোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান তৎকালীন প্রকল্প পরিচালকের সঙ্গে ১৮ এপ্রিল চুক্তি করে। এতে ২ লাখ ১০ হাজার পিস কেএন-১৯ মাস্ক এবং ১৫৫০ পিস ইনফ্রায়েড থার্মোমিটার সরবরাহের কথা বলা হয়, যার মোট আর্থিক মূল্য ছিল ৯ কোটি ২০ লাখ ৬০ হাজার টাকা। চুক্তিতে বর্ণিত মালামালের দাম প্রচলিত বাজারমূল্যের চেয়ে অনেক বেশি ধরা হয়। এর মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে সরকারি অর্থ নয়-ছয় হয়েছে।

চুক্তির শর্ত অনুযায়ী মালামাল টেকনিক্যাল কমিটির মাধ্যমে গৃহীত হওয়ার পর টাকা পরিশোধের কথা। কিন্তু টেকনিক্যাল কমিটি অনুমোদনের আগেই কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় প্রতারণার মাধ্যমে ১০ মে ২ কোটি ৭৬ লাখ ১৮ হাজার টাকা তুলে নেয়া হয়।

একইভাবে ১৪ জুন ৫ কোটি ৫২ লাখ ৩৬ হাজার টাকা উত্তোলন করে সংশ্লিষ্টরা। দু’দফায় ৮ কোটি ২৮ লাখ ৫৪ হাজার টাকা অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তুলে নেয়া হয়, যা কোভিড-১৯ রেসপন্স ইমার্জেন্সি অ্যাসিসটেন্সের (এডিবি-জিওবি) সাবেক প্রকল্প পরিচালক কর্তৃক স্বাক্ষরিত ও অনুমোদিত হয়।

এই টাকা উত্তোলনের জন্য সিম কর্পোরেশনের নামে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক মহাখালী শাখার অ্যাকউন্ট নম্বর-০৭৪৩৩০০০১০২ ব্যবহার করা হয়।

মামলায় তিনজনকে আসামি করা হয়েছে এবং তাদের পালাতক দেখানো হয়েছে। তারা হলেন- ১. মো. মোস্তফা মনোয়ার মীম (৩৮), পিতা মো. হোসাইন, মাতা মনোয়ারা বেগম। স্থায়ী ঠিকানা: পীরগাছা, রংপুর এবং বর্তমান ঠিকানা: সালেহা প্যালেস, শাহাবাগ ঢাকা।

২. মোহাম্মদ ইশতিয়াক রহমান (৩৩), পিতা মোহাম্মদ মতিউর রহমান, মাতা রাকিফা রহমান, স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা: ১১০ সেন্ট্রাল রোড, নিউমার্কেট, ঢাকা। ৩. সামি-আল-ইসলাম (৩৭) পিতা মো. সফিকুল ইসলাম, মাতা জিনাত মেহের, বর্তমান ঠিকানা: হাউজ-৮, রোড-৪, সেক্টর-৪, উত্তরা, ঢাকা।

তারা সবাই সিম কর্পোরেশনের ম্যানেজিং পার্টনার। এছাড়া এজাহারে অজ্ঞাতনামা আরও ৪-৫ জনকে আসামি করা হয়েছে।

এজাহারে বলা হয়েছে, আসামিরা তাদের অজ্ঞাত সহযোগীদের সহায়তায় চীন থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে প্রতারণা ও বিশ্বাস ভেঙে নিম্নমানের মাস্ক এনেছে, যা কোভিড-১৯ রেসপন্স ইমার্জেন্সি অ্যাসিসটেন্স (এডিবি-জিওবি) প্রকল্পে প্রতারণামূলকভবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য প্রকল্পের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় ঘটনাস্থলে মজুদ করে।

যা দ্য স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট ১৯৭৪ এর ২৫বি (১)(বি)/২৫(ডি)সহ ১৮৬০ সালের পেনাল কোড আইনের ৪০৬/৪১৭ ধারায় আপরাধের পর্যায়ভুক্ত। সিম কর্পোরেশন নামের প্রতিষ্ঠানটির পালাতক ম্যানেজিং পার্টনাররা এবং প্রকল্পের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় মোট ৮ কোটি ২৮ লাখ ৫৪ হাজার টাকা ইতোমধ্যে তুলে নিয়ে গেছে, যা মানি লন্ডারিং আইনের পর্যায়ে পড়ে।

ঘটনার বর্ণনা থেকে জানা যায়, ২৬ আগস্ট র‌্যাবের জেসিও শ্রী কিরণ চন্দ্র সরকার, এসআই মোহাম্মদ জাকির হোসেন, এএসআই মো. মুকুল, কনস্টেবল সুব্রত, মুকলেছ, সিপাহি মো. ফারুক, নায়েক উহ্যা সিং র‌্যাব-১ এর দায়িত্বাধীন মহাখালীর আমতলী এলাকায় টহল দায়িত্ব পালন করছিলেন।

ওইদিন বেলা ১১টা ৪০ মিনিটে তারা গোপন সংবাদ পান। তারা জানতে পারেন কোভিড-১৯ রেসপন্স ইমার্জেন্সি অ্যাসিসটেন্স (এডিবি-জিওবি) প্রকল্পের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের এনওসি ছাড়াই চীন থেকে চোরাই পথে আনা নিম্নমানের মাস্ক কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দিতে মহাখালী ডিওএইচএস-এর ১৯২/বি বাড়ির দ্বিতীয় তলায় মজুদ করছে।

এই টহল দল বিষয়টি তৎক্ষণাৎ তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানান এবং তাদের নির্দেশে ১২টা ৪০ মিনিটে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। সেখানে তারা কোভিড-১৯ রেসপন্স ইমার্জেন্সি অ্যাসিসটেন্স (এডিবি-জিওবি) প্রকল্পের কনসালটেন্ট (মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন) মো. আবদুর রহিম, কম্পিউটার অপারেটর কাম অফিস সহকারী আনোয়ার হোসেন এবং বাসার কেয়ারটেকারের সহায়তায় দ্বিতীয় তলায় অভিযান পরিচালনা করেন।

এ সময় ফ্ল্যাটের ডাইনিং স্পেস ও ওয়াশরুম সংলগ্ন ছোট কক্ষে সংরক্ষিত নিম্নমানের মাস্ক ডাবল কার্টন ১৯০টি, যার প্রতিটিতে ১২০০টি করে মোট ১ লাখ ৩০ হাজার ৮০০টি মাস্ক ছিল এবং সিঙ্গেল কার্টন ৬০টি, যার প্রতিটিতে ৬০০ করে মোট ৩৬ হাজার মাস্ক পাওয়া যায়। প্রতিটি ৪০০ টাকা করে মোট মূল্য ৬ কোটি ৬৭ লাখ ২০ হাজার টাকা, যা এসআই (নিরস্ত্র) মো. জাকির হোসেন জব্দ করেন।

এ সময় অভিযান পরিচালনাকারী দলের পক্ষ থেকে সিম কর্পোরেশনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা এসব মালামাল আনার পক্ষে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের এনওসি, কমপ্লায়েন্স সনদ এবং আনুষঙ্গিক বৈধ কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারেনি। এ ব্যাপারে প্রকল্পের কর্মকর্তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি।

মামলার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজধানীর কাফরুল থানার অফিসার ইনচার্জ ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) মো. সেলিমুজ্জামান বলেন, নিয়মানুযায়ী মামলার তদন্ত চলছে। প্রাথমিকভাবে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। পাশাপাশি আসামিদের গ্রেফতার করতে বিভিন্ন স্থানে তল্লাশি চালানো হচ্ছে।

 


সর্বশেষ সংবাদ