ঢাকায় যেভাবে কোটিপতি হয়ে উঠল কুঁড়েঘরের ‘মুর্কা মুমিন’!
ঢাকা থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গিয়ে গ্রেফতার করে নিয়ে এসেছে ছাত্রলীগের সদ্য বহিষ্কৃত সহ সভাপতি মুমিনকে। তখনই কুঁড়ে ঘরে থাকা তার বাবা-মা জানতে পারেন তাদের ছেলে নাকি ঢাকায় বড় নেতা। তার আছে লাখ লাখ টাকা, বড় বড় মানুষের সাথে ওঠাবসা।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিদ্ধান্ত জালিয়াতি মামলায় সেই মুমিন রয়েছেন তেজগাঁও থানা পুলিশের রিমান্ডে। কোতয়ালী থানায় জালিয়াতির মামলাও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ঢাকার কয়েকজন ব্যবসায়ীর প্রকল্পের কাজের তদবির করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ এই তরিকুল ইসলাম মুমিনের বিরুদ্ধে।
মুমিনের বাবা ফখরুল ইসলাম (৭৫) বলেন, ‘এসব কিছুই জানতাম না আমরা। পড়াশোনার জন্য পাঠিয়েছি ঢাকায়। মাঝে মাঝে বাড়ি আসতো। বলতো ঢাকায় তার বড় কাজ। তবে কী কাজ বলতো না। সবসময় বলতাম, পড়াশোনা করে মানুষ হও।’
তার মা পারভীন বেগম বলেন, ‘এনজিওতে ছোটকাজ করে দুই ছেলেকে বড় করেছি। বড় ছেলের নামে এতোকিছু জানতাম না। হঠাৎ তাকে আটক করে নিয়ে গেলো। বলে গেলো ঢাকায় বড় প্রতারণার হোতা সে।’
ভোলার স্থানীয় ছাত্রনেতা এবং ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান কেন্দ্রীয় নেতারা তার সম্পর্কে জানিয়েছেন নানা তথ্য। তরিকুল ইসলাম মুমিন, নিজের গ্রামে ‘মুর্কা মুমিন’ বলেও পরিচিত। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ২০১১ সালে ঢাকায় আসেন মুমিন। তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডিবেটিং সোসাইটির সভাপতি আশিকের নিকট ভর্তি পরীক্ষার সময় থাকার জন্য আশ্রয় চান।
তখন একই এলাকার হওয়ায় মুমিনকে সূর্যসেন হলের ৫৪১ নম্বর কক্ষে থাকতে দেন আশিক। এরমাঝেই সে শুরু করে ছোট ছোট প্রতারণা। হলের দোকানে ফাও খাওয়া, শিক্ষার্থীদের বকা-ঝকা, তর্কাতর্কিসহ নানা অভিযোগে পরে তাকে হল থেকে বের হয়ে যেতে বলেন আশিক। এবার হলে আশ্রয় নিতে সেই সময়ের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রশীদকে টার্গেট করেন।
পরে কেন্দ্রীয় কমিটিরও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হন মামুন। কয়েকদিন পর মামুন তাকে আশ্রয় দেন সুর্যসেন হলের একটি কক্ষে। তখন থেকেই মুমিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে পরিচয় দেয়া শুরু করেন। সূর্যসেন হলের কয়েকজন নেতার সাথেও পরিচয় হয়। হলের রাজনীতিতে বরিশাল অঞ্চল শক্ত অবস্থানে থাকায় তাদের সাথে মিশে যান মুমিন।
২০১৬ সালে ছাত্রলীগের সোহাগ-জাকির কমিটির সময় মামুনুর রশীদ হল থেকে চলে যান। তখন কক্ষটি দিয়ে যান মুমিনকে। তখন মুমিন সম্পর্ক করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন সভাপতি আবিদ আল হাসানের সাথে। নিজেকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পরিচয় দিতে থাকেন।
কয়েকমাস পর ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে গণহারে পূর্ণাঙ্গ কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করেন সোহাগ ও জাকির। সেই কমিটির সদস্য হন মুমিন। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বৃহত্তর বরিশাল গ্রুপ’র প্রভাবশালী হিসেবেই আত্মপ্রকাশ ঘটে মুমিনের। বাইরে গিয়ে নিজেকে নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় নেতা পরিচয় দিতেন তিনি।
তখন থেকেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ভর্তি, নিয়োগ ও তদবির বাণিজ্য শুরু করেন তিনি। প্রকল্প পাশ করানোর কথা বলে ঠিকাদার, ব্যবসায়ীর নিকট থেকে টাকা নেয়ার কথাও রিমান্ডে বলেছেন তিনি। সবশেষ, নর্থ-সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার নিয়োগে ভয়ঙ্কর জালিয়াতিতে ধরা পড়েন। চাকরি দেওয়ার নামে টাকা নেয়া ও প্রতারণার অনেক অভিযোগও আছে। সদর থানায় তার বিরুদ্ধে আছে কয়েকটি মামলা।
তবে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি আবিদ আল হাসান গণমাধ্যমের নিকট দাবি করেন, ‘মুমিনের সাথে আমার সখ্য ছিল না। সাবেক নেতা মামুনুর রশীদ ও ডিইউডিসের আশিক ভাইয়ের রুমে থাকতো জানতাম। মুমিন এসে মামুন ভাইয়ের আত্মীয় পরিচয় দিতো। সে ক্যাম্পাসের ছাত্র ছিল না, তা জানতাম না।’
তবে আবিদ আল হাসান জানান, মুমিন কেন্দ্রীয় কমিটিতে যাতে জায়গা না পান, সেজন্য জাকির হোসেনকে ২/৩ বার অনুরোধ করেন তিনি’।
আর কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন জানান, ‘মুমিনের ব্যাপারে কয়েকজনকে সাবধান করেছি। কমিটির না হয়েও তার পদ ব্যবহারের কথা শুনেছি। কিন্তু প্রভাবশালী মন্ত্রীর পিএসের তদবিরের জন্যই মৌখিকভাবে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে ঘোষণা করি তাকে’।
ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার বিজয় বসাক তালুকদার মামলা ও রিমান্ড নিয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘স্পর্শকাতর মামলায় সে রিমান্ডে আছে। প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের এক সহকারীকে আটকের পর মুমিনের কথা জানায় সে। রিমান্ডের তথ্য পরে জানানো হবে।’
২০১৮ সালের জুলাইয়ে সোহাগ-জাকির কমিটির বিদায়ের পর আসে শোভন-রাব্বানী কমিটি। মুমিনও হল ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। মুমিনের যাতায়াত তখন শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হলে। নর্থ ব্লকের ২০৮ নম্বর রুমে থাকতেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। তার সাথেসহ বরিশাল অঞ্চলের অনেকের সাথে সখ্যতা হয় মুমিনের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্বরত একটি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা জানান, রাব্বানীর সাথে টাকার বিনিময়ে সখ্যতা হয় মুমিনের। অন্তত ১৮ লাখ টাকা দিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটিতে সহ-সভাপতির পদ পান মুমিন। ওই কমিটির বিরুদ্ধে রাস্তায় নামেন শতাধিক পদবঞ্চিত নেতা।
ওই আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্রলীগের সাবেক কর্মসূচি ও পরিকল্পনা বিষয়ক সম্পাদক রাকিব হোসেন জানান, ‘টাকা দিয়ে পদ দেওয়ায় আমরা যারা আজীবন ত্যাগী কর্মী, তাদের বঞ্চিত করা হয়েছিল। মুমিনের এই ঘটনা তার বড় প্রমাণ। এমন কথা আমরা বারবার বললেও কেউ পাত্তা দেয়নি।’
তবে এসব তথ্য অস্বীকার করে পদত্যাগ করা সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী ফেসবুকের একটি পোস্টে লেখেন, ‘মুমিনের জন্য বড় বড় নেতার তদবির ছিল। সেজন্য তাকে আমি পদ দিতে বাধ্য হই। তাকে একটি উপ-সম্পাদক করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু এমন একজন তাকে সহসভাপতি পদ দিতে রেফারেন্স দেয়, তার কথা উপেক্ষা করতে পারিনি’।
মুমিনের বিষয়ে ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় গণমাধ্যমকে বলেন, ‘কারো না কারো শেল্টারে চলেছে সে। কিন্তু, তার আগে থেকেই পদ থাকায় কিছু করার ছিল না আমাদের। মুমিন এমন জালিয়াতি করেছে যে সবাই স্তম্ভিত। এতোদিন সে যা করেছে তার দায় সগঠন নেবে না। তাকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হয়েছে।’ তার বিচারে করতে ছাত্রলীগও সব সহায়তা করবে বলে জানান তিনি।