ডাক্তারকে ওষুধ বিক্রেতার ধাক্কা, সিভিল সার্জনের কাছে বিচার ও অসহায়ত্ব
ইমার্জেন্সিতে ছিলাম। ছয় মাস বাড়ি যাই না। সেই যে সরকারি চাকরি পেলাম, আর ছুটি নেই। করোনার সময় থেকে একদিন জীবনের নিরাপত্তা পেলাম না। সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে আমার পোস্টিং। আজ টানা আঠারো ঘণ্টা ডিউটি ছিলো। বিকাল ৩টা থেকে পরদিন সকাল ৯টা। এক রোগী এসে বললো, স্যার একটা ঔষধ লিখছে, দোকানি আরেকটা দিছে। নার্সরা চেঞ্জ করে আনতে বলছে। চেঞ্জ করতে গেলে দোকানি বললো, বিক্রি জিনিস ফেরত হয় না।
আমি বললাম, আবার যান, বলেন ইমার্জেন্সি ডাক্তার বলছেন। ওই গরীব রোগী আবার গিয়েও ঔষধ চেঞ্জ বা টাকা ফেরত পেল না। আমি মানুষটার দিকে তাকালাম। নিতান্ত গরীব মানুষ। কত কষ্ট করে কিছু টাকা জোগাড় করে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করাচ্ছে। আমি বললাম, এট তো ঠিক না। চলেন তো দেখি।
হাসপাতালের উল্টো পাশেই দোকান। ইমার্জেন্সিতে একজনকে বসিয়ে ওই দোকানে গেলাম। দোকানে একজন লম্বা মানুষ। পাশে আরেকজন। জিজ্ঞেস করলাম, ঔষধটা সম্ভব হলে বদল করে দেন। দোকানের মালিক বললেন, বিক্রি জিনিস আমরা ফেরত নেই না। আমি বললাম, দেখেন গরীব মানুষ। আর যে ওষুধ লিখেছে, ওইটা তো দেন নাই।
দোকানি ক্ষুব্ধ হয়ে গেলেন, আপনি কে?
- আমি ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার।
উনি তাচ্ছিল্য করে বললেন, ও কমিশন খেতে আসছেন?
আমি বললাম, দেখেন টাকাটা ফেরত দেন অসুধ না থাকলে।
দোকানি চিৎকার করে উঠলেন, বাড়ি কই আপনার?
আমি বললাম, ফরিদপুর।
-ফরিদপুর হয়ে সাতক্ষীরায় রংবাজি করেন! বলেই আমাকে বুকে একটা ধাক্কা দিলেন।
এরপর বললেন, আমাকে চিনেন? যান যান। ক্যাশে টাকা নাই।
আমি বললাম, এত বড় দোকানে ক্যাশে টাকা নেই? দ্বিতীয়বার ধাক্কা দেয়ায় আমার একটা শার্টের বোতাম ছিড়ে গেল।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে বৃদ্ধকে বললাম চলেন যাই।
তখন বাজে ৫টা। আমি ইমার্জেন্সিতে এসে সাড়ে পাঁচটায় সিভিল সার্জন স্যারকে ফোন দিলাম। উনি বললেন ইফতার শেষে কথা বলবেন। ইফতার শেষে আবার ফোন দিলাম, উনি বললেন দোকানি বেশ ক্ষমতাশালী।
আমি হতবাক হয়ে গেলাম।
স্যারকে বললাম, তাই বলে আমাকে মারবে!
উনি বললেন, তুমি থাকো। আমি দেখতেছি।
আমি এরপর আরো কয়েকবার তাকে ফোন দিয়েছি। কিন্তু ৯টায় আমার ইভিনিং ডিউটি শেষ হবার আগে পর্যন্ত তিনি আমাকে দেখতে আসেননি। আমার প্রতিষ্ঠানের আরএমও হাসপাতালেই ছিলেন। তিনিও একবারও আমাকে দেখতে আসেননি। আমি আহত হৃদয়ে ইমার্জেন্সি থেকে ৯টায় বের হয়ে আসি। এরপর খেয়াল করলাম, জামার দুইটা বোতাম ছিড়ে গেছে।
আমি ছোট একজন মেডিকেল অফিসার। এজন্য আমার খোঁজ নিল না। জানি একজন বড় সিভিল সার্জন আমি নই। তাকে মারলে হয়ত দুনিয়া উল্টে যেত। হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যেত। আমার জন্য কিছুই হয়নি। সবই চলছে। হয়ত কালও চলবে। এই তো সেদিনও মা ফোন দিয়ে বললেন, তুমি বাসায় চলে আসো।
আমি হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে বসে বলি, আর যে কবে দেখা হবে! আম্মা আবেগি কণ্ঠে বলেন, কাজ করতে হবে না। তুমি বেঁচে থাকো। ছোট ছেলেটা দেশের বাইরে। তোমার কিছু হয়ে গেলে...
শুনি আর হাসি। এক জীবনে এমন কতো ভালোবাসা যে আমাদের ঘিরে থাকে, আমরা তা টেরও পাই না। আমি ধরা গলায় বলি, চলে আসবো ঠিক একদিন দেইখেন। বলেই বুকে ধক করে ওঠে। মনে ভয় জাগে, যদি না ফিরতে পারি! যদি এমন হয় আমার কাছে আমার মা কে আসতে না দেয়া হয়! আঞ্জুমানের কাছে চলে যায় দেহটা! বাবার সাথে শেষ দেখাটা নাও তো হতে পারে। কিন্তু শত ভয়ের মধ্যেও আমরা ডিউটি করি।
আমার একজন বড়ভাই ছিল। দুই বছর বয়সে হাইড্রোকেফালাস নিয়ে মারা গেছেন। আজ ভাবি, তিনি বেঁচে থাকলে হয়ত এভাবে মার খেতে হতো না। দুঃখ একটা আমার ঢাকা মেডিকেলের বড় ভাই যিনি আমার সিভিল সার্জন তাকে আমি বড় ভাই বলতে পারলাম না। চারঘণ্টায় তিনি এক কিলোমিটার রাস্তা গাড়িতে বসে আমাকে দেখতে আসেননি। আমার জীবনে আমি প্রথমবারের মত নিজের বড়ভাইকে মিস করলাম।
একসময় দেখেছিলাম, বাংলাদেশ নামের দেশটির বেশিরভাগ শিশুরই রাস্তায় জন্ম হয়। কোন পিতামাতা থাকে না। আজ জানলাম, আমি একজন সরকারি মেডিকেল অফিসার। আমারও কোন পিতামাতা নাই। হয়ত করোনার এই দিনে আর কোনদিন বেঁচে থাকবো না। কিন্তু জেনে গেলাম, এদেশের সবার জীবনের মূল্য আছে বলেই আমি ঈদের ছুটি পাইনি। কিন্তু আমার জীবনের মূল্য নেই।
মাগো, ভাল থেকো, জেনে রেখো, তোমার ছেলে বলে কেউ নাই। যেদিন সাতক্ষীরায় সিভিল সার্জন হুসাইন শাফায়েতের সাথে কাজ করতে এসেছি, সেদিন থেকে তোমার আর কোন ছেলে নেই। মরে গেছে।
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
লেখক: মেডিকেল অফিসার, সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল