এবার জেলেকে প্রাণনাশের হুমকি আরডিসি নাজিমের
সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানের বাড়িতে মধ্যরাতে হানা এবং তাকে তুলে নিয়ে জেল-জরিমানা দেয়ার ঘটনায় কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (আরডিসি) নাজিম উদ্দীন প্রত্যাহার হওয়ার পর এলাকা ছাড়ার মুহূর্তে এবার জেলেকে র্যাব দিয়ে গ্রেপ্তার ও প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে আবারও সমালোচনায় এসেছেন।
জানা যায়, গতকাল দুপুরে বিশ্বনাথ দাস নমো (৩৬) নামের এক জেলেকে জেলা প্রশাসকের (ডিসি) বাংলোতে ডেকে নিয়ে র্যাব দিয়ে গ্রেপ্তার ও প্রাণে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়েছেন তিনি। এতে মানসিক আঘাত পেয়ে বিশ্বনাথ দাস কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। বিশ্বনাথ দাসকে স্বাভাবিক রাখতে পরিবারের লোকজনকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ ব্যাপারে বিশ্বনাথ দাস বলেন, গতকাল দুপুরে জামিনে কুড়িগ্রাম কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর বাইরে আসলে তাকে ডিসি বাংলোতে ডেকে নিয়ে যান নাজিম উদ্দিন। সেখানে গণমাধ্যমে কোনো কিছু বলা যাবে না মর্মে তার ভিডিও ধারণ করা হয়। এসময় তাকে বলা হয়, “তোমাকে র্যাব খুঁজছে। তুমি যেন ক্রসফায়ারে না পড়, এজন্য আপাতত তুমি কুড়িগ্রামের বাইরে গিয়ে থাক”। এরপর তাকে কুড়িগ্রামের খলিলগঞ্জ এলাকায় নিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে বিশ্বনাথ দাস কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ভর্তি হন।
তিনি আরও বলেন, ‘স্যারকে বলেছিলাম আমি জাতে জেলে। জাল দিয়ে মাছ ধরে পরিবার পরিজন প্রতিপালন করি। এটা আমার পৈতৃক পেশা। সরকারি ঘোষণা মতে খাল-বিলের লিজ পেতে জেলেদের অগ্রাধিকার বেশি।’
‘আমি জাতে জেলে শুনে সাবেক আরডিসি নাজিম উদ্দিন আমার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে বলেন, “বেটা আমাকে আইন শেখাস। তুই জেলে, তোকে বেশি দিন জেলের ঘানি টানাব’, এই বলে হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কাঁদতে শুরু করেন বিশ্বনাথ।
এ বিষয়ে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সুপারিন্টেনডেন্ট ডা. জাকিরুল ইসলাম বলেন, ‘মানসিকভাবে আঘাত পাওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বিশ্বনাথ দাস। তাকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে তিনি যদি মানসিকভাবে আরো আঘাত পান, সেটি তার জন্য বিপজ্জনক হবে।’
এ ঘটনায় স্থানীয়রা জানান, ‘গিরাই নদী বিল’ নামে মৎস্য চাষের সরকারি বিল লিজ নিয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করায় ক্ষুব্ধ কুড়িগ্রামের সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনের নির্দেশে নাগেশ্বরী উপজেলা থেকে দুই মৎস্যজীবীকে বিনা অপরাধে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে বাড়ি থেকে জোরপূর্বক তুলে এনে ডিসি অফিসে মারধর করে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেন নাজিম উদ্দিন। পরে সরকারি কাজে বাধা প্রদানের অপরাধে পেনাল কোডের ১৮৮ ও ১৮৯ ধারায় জেলে বিশ্বনাথ দাস নমোকে ১ বছর ১১ মাস ১ দিন এবং অপর মৎস্যজীবী খালেকুজ্জামান মজনুকে ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
বিশ্বনাথ দাসের স্ত্রী শোভা রানী দাস বলেন, ‘মধ্যরাতে আমার স্বামীকে বাড়ি থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন সাবেক আরডিসি নাজিম উদ্দিন। তার সঙ্গে ৭ থেকে ৮ জন থাকলেও, কোন পুলিশ সদস্যকে আমি দেখিনি।’
‘সেসময় আমি ও আমার ছেলে অনেক কেঁদেছি, কিন্তু নাজিম উদ্দিন আমাদের কান্না শুনেননি’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘স্বামী জেলে থাকায় আমাদের অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয়েছে।’
এদিকে, নাগেশ্বরী উপজেলার অপর মৎস্যজীবী খালেকুজ্জামান মজনু ৬ মাসের দণ্ডাদেশ শেষ হওয়ার পরদিন ২৭ ফেব্রুয়ারি জামিন লাভ করেন।
মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে মজনু জানান, তার স্বজনরা সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনের সঙ্গে যোগাযোগ করায় তার নির্দেশে ২৭ ফেব্রুয়ারি জামিন পান তিনি। জামিনের পর তাকে ডেকে নিয়ে কাগজে মুচলেকা লিখে সাক্ষর নিয়ে ডিসি বলেন, ‘বিলের লিজ নিয়ে যেন কোন ধরনের মাখামাখি করা না হয়।’
‘আমি আর ভয়ে বিলের লিজ নিয়ে ছুটাছুটি করি নাই। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ডিসি ম্যাডাম তার পছন্দের লোককে সেই লিজ পাইয়ে দিয়েছেন’, বলেন তিনি।
ধরে নেওয়ার পর সাবেক আরডিসি নাজিম উদ্দিন তাকে ও বিশ্বনাথকে বেদম মারধর করেছিলেন বলেও জানিয়েছেন মজনু।
বিশ্বনাথ দাসের আইনজীবী অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবীর দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ‘সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে পেনাল কোডের ১৮৮ ও ১৮৯ ধারায় বিশ্বনাথ দাস ও খালেকুজ্জামান মজনুকে মোবাইল কোর্টে সাজা দেন সাবেক আরডিসি নাজিম উদ্দিন। যদিও ১৮৮ ধারায় সাজা প্রদানের সাকুল্য ক্ষমতা ১ মাস থেকে ৬ মাস পর্যন্ত, কিন্তু আইনের ব্যত্যয় ও স্পষ্ট লঙ্ঘন ঘটিয়ে বিশ্বনাথ দাসকে ১ বছর সাজা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অপর ধারায় ১১ মাস ১ দিন সাজা দেন।’
এসব ক্ষমতার অপব্যবহার এবং প্রতিশোধ নিতেই মধ্যরাতে এই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এ বিষয়ে নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘মৎস্যজীবী বিশ্বনাথ দাস ও খালেকুজ্জামান মজনুকে আমি মারধর করিনি। জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন স্যারের নির্দেশে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। সরকারি কাজে বাঁধা প্রদানের অপরাধে বিধি মোতাবেক এই দুই ব্যক্তিকে পেনাল কোডের ১৮৮ ও ১৮৯ ধারায় সাজা প্রদান করা হয়।’
‘জামিনে কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বিশ্বনাথ দাস নিজেই আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। আমি গাড়িতে করে তাকে কোথাও নিয়ে গিয়ে ছেড়ে আসিনি’, বলেন তিনি।
‘যা কিছু হয়েছে, সবকিছুই জেলা প্রশাসনের স্বার্থে সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনের নির্দেশে হয়েছে,’ এমনটি বলে তিনি অনুরোধ করেন তাকে নিয়ে আর লেখালেখি না করতে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নাগেশ্বরী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রওশন কবির বলেন, ‘আমি ২৬ ফেব্রুয়ারি থানাতেই ছিলাম। কিন্তু ওই দিন কোনো মোবাইল কোর্ট দিনে কিংবা রাতে পরিচালনা করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এমনকি আমার থানার কোনো পুলিশ সদস্যও মোবাইল কোর্টে পাঠানো হয়নি।’
নাগেশ্বরী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নুর আহমেদ মাসুম বলেন, ‘আমি আপনার মুখেই প্রথম জানতে পারলাম ২৬ ফেব্রুয়ারি নাগেশ্বরীতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছেন সাবেক আরডিসি নাজিম উদ্দিন। কিন্তু আমার অফিসে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই এবং আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না।’
তবে তিনি বলেন, ‘গিরাই নদী বিল নিয়ে মৎস্যজীবীদের মধ্যে থেকে জেলে বিশ্বনাথ দাস নামে এক ব্যক্তি হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছেন। কেন এবং কী অপরাধে ওই দুই ব্যক্তিকে মধ্যরাতে তুলে নিয়ে গিয়ে মোবাইল কোর্টে সাজা প্রদান করা হয়েছে, তা হয়তো জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ভালো বলতে পারবে।’
সদ্য প্রত্যাহার হওয়া কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের মোবাইলে একাধিকবার কল করেও তিনি না ধরায় এ বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
- অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলা ট্রিবিউন’র কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি আরিফুল ইসলামকে মধ্যরাতে বাড়ি থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে মারধর, এনকাউন্টারে হত্যার হুমকি ও ভ্রাম্যমাণ আদালতে এক বছরের জেল দেওয়ার ঘটনায় কুড়িগ্রাম থেকে প্রত্যাহার হওয়া ডিসি সুলতানা পারভীন ও নাজিম উদ্দিনসহ তিনজন সহকারী কমিশনার গতকাল বিকালে কুড়িগ্রাম ছেড়েছেন বলে জেলা প্রশাসন সূত্র নিশ্চিত করেছে।