বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকে হত্যার রোমহর্ষক বর্ণনা সিএনজি চালকের

  © সংগৃহীত

হাতিরঝিল সংলগ্ন কারওয়ান বাজার রেলক্রসিংয়ের ফ্লাইওভার থেকে গত ৬ জানুয়ারি মধ্যরাতে মিজানের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় হাতিরঝিল থানায় নিহতের ভাই আরিফ হোসেন বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলাটি পুলিশ তদন্ত করছে।

এরপর অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের পুলিশ গ্রেফতার করেছে। তাদের নিকট থেকে মিজান হত্যার রোমহর্ষক বর্ণনা পেয়েছে পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ফেসবুক পেজে ওই ঘটনার বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস’র পাঠকদের জন্য সেই বিবরণ হুবহু তুলে ধরা হল-

গত ৫ জানুয়ারি রাত অনুমান ১টা ১২ মিনিটের দিকে অজ্ঞাত একজন পথচারী হাতিরঝিল থানার অফিসার ইনচার্জের অফিসিয়াল মোবাইল নম্বরে ফোন করে জানায়, মগবাজার ফ্লাইওভারের উপরে সোনারগাঁও প্রান্তে রেলক্রসিং বরাবর পড়ে আছে এক যুবকের লাশ। মূহূর্তেই হাতিরঝিল থানা পুলিশ চলে যায় ঘটনাস্থলে।

ঘটনাস্থলে হাজির হলেন তেজগাঁও বিভাগের ঊর্দ্ধতন পুলিশ কর্মকর্তাবৃন্দ। ঠোঁটে একছোপ রক্ত ছাড়া সারা শরীরে কোথাও কোন আঘাতের চিহৃ খুঁজে পাওয়া গেল না। ফ্লাইওভারের যে অংশে মৃতদেহটি পড়েছিল, সেখান থেকে সোনারগাঁও ক্রসিং এবং হলি ফ্যামিলি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী যে প্রান্তে উঠতে হয় ফ্লাইওভারে, পুরো এলাকা খোঁজা হলো তন্নতন্ন করে। যদি মৃতদেহের পরিচয় সনাক্তকরণের কোন আলামত পাওয়া যায়!

রাত ২টা ২৫মিনিটে ফ্লাইওভারের উপরে রেইনবো ক্রসিং থেকে সোনারগাঁও প্রান্তের দিকে সামান্য এগোতেই ফ্লাইওভারের রেলিং ওয়াল ঘেঁষে একটি মানিব্যাগ পাওয়া গেল। মানিব্যাগে পাওয়া গেল একটি জাতীয় পরিচয়পত্র ও জব আইডি কার্ড। জাতীয় পরিচয়পত্র ও জব আইডি কার্ডের ছবির সাথে মিলানো হলো মৃতদেহের মুখাবয়বের। সনাক্ত হলো মৃতদেহটি।

মিজানুর রহমান। বয়স ২৫ বছর। লক্ষীপুর জেলার সদর থানাধীন ছবিলপুর গ্রামে তার জন্ম। তার বাবা আমির হোসেন পেশায় মুদি দোকানদার। বেসরকারী এশিয়ান ইউনিভার্সিটির ছাত্র মিজানুর রহমান শেওড়া এলাকায় একটি মেসে থাকতো। পড়াশোনার পাশাপাশি বনানীতে অবস্থিত হোটেল ‘গোল্ডেন টিউলিপ’ এর ফুডস এন্ড বেভারেজ শাখায় ওয়েটার হিসেবে কাজ করতো মিজানুর রহমান। নিজের পড়াশুনার খরচ চালিয়ে অবশিষ্ট টাকা পাঠাতো গ্রামে। মুদি দোকানদার বাবাকে।

ফেব্রুয়ারিতে জাপানে যাওয়ার কথা ছিল তার। জাপানি ভাষা শেখার কোর্স কমপ্লিট করেছিল। পাসপোর্টও করে ফেলেছিল। জাপানে কোন হোটেলে ভালো বেতনে চাকরি করে ঘুচাতে চেয়েছিল মা-বাবার নিত্যকার অভাব অনটন। অভিনয়েও তার আগ্রহ ছিল যথেষ্ট। মান্না, ডিপজল ও ওমর সানিকে নকল করতে পারতো হুবহু।

তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদারের সরাসরি তত্ত্বাবধানে তেজগাঁও শিল্পানচল জোনের এডিসি হাফিজ আল ফারুকের নেতৃত্বে এসি মঈনুল ইসলাম, হাতিরঝিল থানার ইন্সপেক্টর মহিউদ্দীন, এসআই মবিন, এসআই খায়রুল এএসআই তরিকের একটি টীম ২৩ জানুয়ারি রাত ৮টা ২৫ মিনিটে টঙ্গী এলাকা থেকে নুরুল ইসলাম এবং ২৫ জানুয়ারি গাজীপুরা ও তুরাগ এলাকা থেকে আবদুল্লাহ বাবু ও জালালকে গ্রেফতার করে।

গ্রেফতারকৃত নুরুল ইসলাম মূলত সিএনজি চালক। সিএনজি চালনার আড়ালে তার মূল পেশা ছিনতাই। নুরুল ইসলামসহ আরো আটজন মিলে তারা গড়ে তুলেছে সিএনজি কেন্দ্রীক দুটি ভয়ংকর ছিনতাই ও কিলিং গ্রুপ। রাত আটটার পর থেকে সূর্যোদয় পর্যন্ত আশুলিয়া, আবদুল্লাহপুর, উত্তরা, গুলশান, ভাটারা, খিলক্ষেত, বাডডা, মহাখালী, তেজগাঁও, মগবাজার, রামপুরা, ৩০০ ফিট, মিরপুর, যাত্রাবাড়ি, সাইনবোর্ড এলাকা চলতে থাকে তাদের অপকর্ম।

গ্রেফতারকৃত নুরুল ইসলাম জানিয়েছে, সে ৫-৬ মাস ধরে প্রায় ৬০০ ছিনতাই করেছে। তার সহযোগী ৫-৬ জন আছে যারা প্রায় ৩-৪ বছর ধরে ছিনতাই করছে। অনেকেই ২০০০-২৫০০ ছিনতাই করেছে। রাত আটটায় বের হয়ে সূর্যোদয় পর্যন্ত কমপক্ষে একটি থেকে সর্বোচ্চ ছয়টি পর্যন্ত ছিনতাই করার রেকর্ড আছে।

জিজ্ঞাসাবাদে নূরুল ইসলাম, জালাল ও আবদুল্লাহ বাবু যে তথ্য দিয়েছে তা রীতিমতো রোমহর্ষক। গত বছরের ১০ ডিসেম্বর থেকে গত ৬ জানুয়ারী। রাজধানীর ভিন্ন ভিন্ন ফ্লাইওভারে পাওয়া গেছে চারটি লাশ। প্রত্যেকটি হত্যাকাণ্ডের ধরন একই রকম। সবার গলায় গামছা বা মাফলার পেচিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

গত ১০ ডিসেম্বর আক্তার হোসেন নামের এক স্বর্নকারকে হত্যার পর লাশ ফেলে রাখা হয় কুড়িল ফ্লাইওভারে। ৩১ ডিসেম্বর খিলক্ষেত ফ্লাইওভারে উঠার পথের ডানপাশে এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়। ৩ জানুয়ারি কুড়িল বিশ্বরোড সংলগ্ন ফ্লাইওভারে মনির হোসেন নামে এক ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়। সর্বশেষ ৬ জানুয়ারি মগবাজার ফ্লাইওভারের উপরে সোনারগাঁও প্রান্তে রেলক্রসিং বরাবর মিজানুর রহমানের লাশ পাওয়া যায়।

গ্রেফতারকৃত নূরুল ইসলাম ও তার সহযোগী দুই ছিনতাইকারী চারটি হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে আদালতে স্বীকারাক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে নূরুল ইসলাম। মূলত: সিএনজিতে যাত্রী হিসেবে উঠিয়ে ছিনতাইয়ে বাঁধা দেওয়ায় তাদেরকে হত্যা করা হয়েছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অধিক্ষেত্রের বাইরে দুটি এলাকায় গত দুই মাসে তারা আরো চারটি হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে বলে নূরুল ইসলাম স্বীকার করেছে। পাশাপাশি ছিনতাইয়ের পর অজ্ঞান বা অর্ধমৃত অবস্থায় ৩০-৪০ জন জন যাত্রীকে বিভিন্ন ফ্লাইওভার বা নির্জন অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে সিএনজি থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে স্বীকার করেছে নূরুল ইসলাম। এদের মধ্যে ৮-১০ জন বাস-ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে মারা গেছে। এ চক্রের অন্যান্য সদস্যদের গ্রেফতারের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে।


সর্বশেষ সংবাদ