ক্যাসিনোর দশ গডফাদাররা এখনও অধরা

  © ফাইল ফটো

হঠাৎ 'ক্যাসিনো-ঝড়ে' লণ্ডভণ্ড অনেকের সাজানো ঘর। তবে এখনও ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন অনেকে। বিশেষ করে ক্যাসিনো-কাণ্ডে আলোচিত 'টপ টেনের' টিকিটি স্পর্শ করা যায়নি। 'ক্যাসিনো-গুরু' ও যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট এবং তার ঘনিষ্ঠদের এখনও গ্রেফতার করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যদিও দীর্ঘদিন ধরে তারাই রাজধানীর ক্লাবপাড়ায় ক্যাসিনো ব্যবসা চালিয়ে কোটি কোটি টাকার বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন।

পুলিশের কিছু সদস্যের যোগসাজশে ক্যাসিনো কারবার নির্বিঘ্নে চালিয়ে আসছিল 'টপ টেন'। তবে যুবলীগ দক্ষিণের বহিস্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, 'ঠিকাদার মোগল' জি কে শামীম ও মোহামেডান ক্লাবের সভাপতি লোকমান হোসেন ভূঁইয়াসহ বেশ কয়েকজন গ্রেফতারের পর এই ১০ রাঘববোয়াল গা-ঢাকা দিয়েছেন। বন্ধ রয়েছে তাদের মোবাইল নম্বর। যদিও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হচ্ছে, সম্রাটসহ কয়েকজন তাদের নজরদারির মধ্যে রয়েছেন। 'সবুজ সংকেত' পেলেই তাদের গ্রেফতার করা হবে।

গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু করে র‌্যাব। গত ১৪ দিনে ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ৪০টি অভিযান চালানো হয়। সর্বশেষ গত সোমবার বিকেলে থাইল্যান্ডে পালানোর সময় অনলাইন জুয়ার রাজা সেলিম প্রধানকে থাই এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট থেকে নামিয়ে আনা হয়। শিগগিরই ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে আরও অনেকে ধরা পড়বে বলে আভাস দিয়েছেন দায়িত্বশীল গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।

সম্রাটকে নিয়ে লুকোচুরি : ঢাকার একাধিক অভিজাত ক্লাব থেকে ক্যাসিনোর টাকা তুলতেন সম্রাট। এর মধ্যে ফকিরাপুলের ইয়ংমেনস ক্লাব অন্যতম। মতিঝিল দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব থেকেও ক্যাসিনোর টাকা পেতেন সম্রাট। ভিক্টোরিয়া ক্লাব ও মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবের ক্যাসিনোর অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন তিনি। সম্রাটের টাকার ভাগ পৌঁছাত আরও অনেকের কাছে। ক্যাসিনো ও দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরুর পর কয়েক দিন কাকরাইলে দলীয় কার্যালয়ে শত শত নেতাকর্মীর পাহারায় ছিলেন সম্রাট। তবে সপ্তাহখানেক ধরে তার খোঁজ নেই নেতাকর্মীদের কাছে। এরই মধ্যে সম্রাটের দেশত্যাগ ঠেকাতে বিমানবন্দর ও সীমান্তে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। তার সব ব্যাংক হিসাব নম্বর জব্দ করা হয়েছে। তবে সম্রাট গ্রেফতার হবেন কি-না, তা নিয়ে রয়েছে নানামুখী আলোচনা। সম্রাটের আরেক ঘনিষ্ঠজন খোরশেদও রয়েছেন আলোচনায়। খোরশেদ সম্রাটের দেহরক্ষীর মতো সারাদিন তাকে আগলে রাখতেন।

এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ : মতিঝিল এলাকার কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ একসময় বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মতিঝিল এলাকায় গাড়ির চোরাই তেলের ব্যবসা করতেন তিনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতার আসার পর সাঈদও ডিগবাজি দেন। 'তেল সাঈদ' হিসেবে পরিচিত সাঈদ হয়ে ওঠেন যুবলীগ নেতা। মতিঝিল এলাকায় গড়ে তোলেন নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী। নিয়ন্ত্রণে নেন পুরো মতিঝিল এলাকা। ওয়ান্ডারার্স ক্লাবসহ কয়েকটি ক্লাবে ক্যাসিনো জুয়ার অন্যতম হোতা সাঈদ ক্যাসিনোবিরোধী চলমান অভিযানের কারণে দেশে ফিরছেন না। বর্তমানে তিনি অবস্থান করছেন সিঙ্গাপুরে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর মমিনুল হক সাঈদ সিটি করপোরেশনেও প্রভাব খাটান। কাউন্সিলর হয়েও তিনি বোর্ড সভায় ছিলেন অনিয়মিত। ক্যাসিনো কারবার ও ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন তিনি।

বিশ্বস্ত তিন সহসভাপতি : কথায় আছে, 'যার নাই কোনো গতি, সে হয় সহসভাপতি'। তবে দক্ষিণ যুবলীগের তিন সহসভাপতির ক্ষেত্রে এমন কথা অচল। সম্রাটের বিশ্বাসভাজন হিসেবে দাপিয়ে বেড়াতেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সহসভাপতি সোহরাব হোসেন স্বপন, সরোয়ার হোসেন মনা ও এনামুল হক আরমান। তিনজনই অল্প সময়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তবে তাদের একজনও সত্যিকার অর্থে আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ 'কর্মী' নন। স্বপন একসময় ফ্রিডম পার্টির ক্যাডার ছিলেন। পরে যোগ দেন বিএনপিতে। ২০০৮ সালে বিএনপি ছেড়ে যুক্ত হন যুবলীগে। সম্রাটের ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণেই তিনি সহসভাপতির পদ পান। আরামবাগ ক্লাবপাড়ার নিয়ন্ত্রণকারীদের মধ্যে তিনিও একজন।

দক্ষিণ যুবলীগের আরেক সহসভাপতি সরোয়ার হোসেন মনাও আরামবাগ ক্লাবপাড়ার ক্যাসিনো দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন। জাতীয় পার্টির মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন তিনি। পরে বিএনপিতে যুক্ত হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে যুবলীগে নাম লেখান। মনার গ্রামের বাড়ি বরিশাল। সম্রাটের আস্থাভাজন হিসেবে মতিঝিল, আরামবাগ ও ফকিরাপুলে ক্যাসিনোর কারবার দেখভাল করতেন তিনি।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সহসভাপতি এনামুল হক আরমানের রাজনীতি শুরু বিএনপির হাত ধরে। ঢাকায় তার কর্মজীবন শুরু লাগেজ ব্যবসার মাধ্যমে। বিএনপি আমলে আরামবাগ ক্লাবপাড়ার অন্যতম নিয়ন্ত্রক ছিলেন তিনি। বিএনপি ক্ষমতা হারালে যুবলীগের প্রভাবশালীদের বিশ্বস্ত হওয়ার চেষ্টা করেন। যুবলীগের মিছিল-মিটিংয়েও অংশ নিতে থাকেন। একসময় সম্রাটের ঘনিষ্ঠদের একজন হয়ে ওঠেন তিনি। ঢাকা দক্ষিণ যুবলীগের পদও বাগিয়ে নেন। ক্যাসিনো থেকে সম্রাটের টাকা সংগ্রহ করতেন তিনি। এ কারণে 'সম্রাটের ক্যাশিয়ার' হিসেবেও পরিচিত তিনি। অবৈধ টাকা বৈধ করতে নামেন চলচ্চিত্র ব্যবসায়। 'দেশ বাংলা মাল্টিমিডিয়া' নামে নিজেই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান খোলেন। আরমানের প্রযোজনায় এ পর্যন্ত একটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে, যার নাম 'মনের মতো মানুষ পাইলাম না'। 'আগুন' নামে তার আরেকটি সিনেমার শুটিং চলমান রয়েছে।

এ যেন 'ক্যাসিনো পরিবার' : ক্যাসিনো জুয়া নিয়ন্ত্রণে রাখতে থানা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পদ বাগিয়ে নেন গেণ্ডারিয়ার এনামুল হক ওরফে এনু ভূঁইয়া ও তার আপন ভাই-ভাতিজারা। এনু ভূঁইয়া গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, তার বড় ভাই রাশিদুল হক রশিদ ভূঁইয়া ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি, আরেক ভাই রুপন ভূঁইয়া গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। রশিদ ভূঁইয়ার ছেলে ওয়ারী থানার অন্তর্গত ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাতেনুল হক বাঁধন ভূঁইয়া এবং রশিদের ভাতিজা তামিম ভূঁইয়া একই এলাকার ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি পদে রয়েছেন। এর আগে তারা নবাবপুর রোডে লেদের একটি ওয়ার্কশপ চালাতেন। তবে ক্যাসিনো কিংবা জুয়ার বোর্ড নিয়ন্ত্রণের পর তাদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন জুয়ার বোর্ড থেকে। রশিদ ভূঁইয়া, এনু ভূঁইয়া ও রুপন ভূঁইয়া বিলাসবহুল গাড়িতে চলাফেরা করেন। তাদের গাড়িতে ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ও আরামবাগ ক্লাবের স্টিকার লাগানো থাকত। গেণ্ডারিয়া এলাকায় নামে-বেনামে তাদের অন্তত ১২টি বাড়ি রয়েছে। গত ২৪ সেপ্টেম্বর র‌্যাব সদস্যরা এনু ভূঁইয়া ও রুপন ভূঁইয়ার গেণ্ডারিয়ার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে পাঁচ কোটি টাকা, আট কেজি স্বর্ণালঙ্কার ও ছয়টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে। এনু, রুপন ও রশিদের বাবা সিরাজুল ইসলাম ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন। ক্যাসিনো কারবারি হিসেবে তাদের খুঁজছেন গোয়েন্দারা।

 

'ক্যাশ আনিস' : গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের ভাবড়াসুর ইউনিয়নের বোয়ালিয়া গ্রামের ফায়েকুজ্জামানের বড় ছেলে কাজী আনিসুর রহমান। যারা যুবলীগের কাজকর্ম সম্পর্কে খোঁজ রাখেন, তাদের কাছে কাজী আনিসুর রহমান পরিচিত 'ক্যাশিয়ার আনিস' হিসেবে। মূলত চাঁদাবাজি, ঠিকাদারির কমিশন, যুবলীগের বিভিন্ন কমিটিতে পদ-বাণিজ্য ও তদবির ছিল তার অর্থ আয়ের সবচেয়ে বড় খাত। যদিও ২০০৫ সালে আনিস যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের বেতনভোগী পিওন ছিলেন। তার বেতন ছিল পাঁচ হাজার টাকা। পরে আনিস যুবলীগের দপ্তর সম্পাদকের পদ ভাগিয়ে নেন। যুবলীগ নেতা খালেদ, জি কে শামীমসহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে গড়ে তোলেন চাঁদাবাজ সিন্ডিকেট। অল্প সময়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হন আনিস। ধানমি ১৫ নম্বর সড়কে প্রায় আড়াই হাজার বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট আছে তার। ধানমি র ১০/এ সড়কেও আছে আরেকটি ফ্ল্যাট। গোপালগঞ্জে আনিসের রয়েছে কোটি কোটি টাকার স্থাবর সম্পত্তি। ২০১৬ সালে প্রায় ৩৪ লাখ টাকায় একটি পেট্রোল পাম্পও কেনেন আনিস। মূলত তিনি যুবলীগের 'ক্যাশিয়ার' হিসেবে বিভিন্ন খাত থেকে চাঁদা তুলে নেতাদের মধ্যে বণ্টন করতেন। এরই মধ্যে আনিসের ব্যাংক হিসাব নম্বর জব্দ করা হয়েছে।


সর্বশেষ সংবাদ