চোর চক্রের গডফাদার যুবলীগ নেতা রানা
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০১৯, ০৮:৩৮ AM , আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৯, ০৮:৩৮ AM
চট্টগ্রামে দুর্ধর্ষ চোর চক্রের গডফাদার যুবলীগ নেতা তরিকুল ইসলাম রানা। তার ছত্রছায়ায় বছরের পর বছর চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন জায়গায় চুরি করে যাচ্ছিল ওরা। চোরাই মালামাল বেশি দামে বিক্রি করার জন্য তাদের রয়েছে একটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানও। এই চোর চক্র বিচারক, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে টার্গেট করা ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বাসায় হানা দেয়। ভবনের পাইপ বেয়ে ১০ তলা পর্যন্ত চোখের পলকে উঠে যেতে পারে চক্রের এক সদস্য। প্রতিদিন যুবলীগ নেতা রানাকে এক হাজার টাকা করে চাঁদা দিতে হতো চক্রটির। গত কোরবানির ঈদে নগরীর কাজীর দেউড়ির সানমার এলিভেরা ভবনের চতুর্থ তলায় বসবাসরত এক ব্যবসায়ীর ফ্ল্যাট থেকে ২০ ভরি স্বর্ণ ও দুই লাখ টাকা চুরির মামলার তদন্তে বের হয়ে আসে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য। চুরির আট মামলার আসামি মো. সোহেল ওরফে সেলুর আদালতে দেওয়া ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও উঠে এসেছে এসব তথ্য-উপাত্ত।
অভিযুক্ত যুবলীগ নেতা রানা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের বিএনপিপন্থি কাউন্সিলর এ কে এম আরিফুল ইসলাম ডিউকের ভাই। তার বাবা সাবেক কাউন্সিলর মরহুম এ কে এম জাফরুল মাস্টার বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) মো. কামরুজ্জামান বলেন, দুর্ধর্ষ চোর সোহেল ওরফে সেলু, আনোয়ার ওরফে মালিঙ্গাদের চক্রটি শহরের ধনাঢ্য ব্যক্তিদের বাসা কিংবা ফ্ল্যাটে পাইপ বেয়ে গ্রিল কেটে ঢুকে চুরি করে। তাদের ধরার পর একাধিক চুরির ঘটনার কথা স্বীকারও করেছে। তাদের এ কাজের 'বড় ভাই' হিসেবে বাকলিয়ার জাফর কমিশনারের ছেলে যুবলীগ নেতা রানার নাম প্রকাশ করেছে তারা। যারাই এ চক্রের সঙ্গে জড়িত আছে, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
অভিযুক্ত যুবলীগ নেতা তরিকুল ইসলাম রানা বলেন, 'মো. সোহেল ওরফে সেলুর বাবা আমাদের বাসার কেয়ারটেকার ছিল। সে আমার পরিচিত। সেলু আমাকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ফাঁসিয়ে দিতে জবানবন্দিতে আমার নাম নিয়েছে। তাদের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।' রানা নিজেকে ১৭ নম্বর বাকলিয়ায় ওয়ার্ড আওয়ামী যুবলীগের সেক্রেটারি হিসেবে দাবি করেন।
দুর্ধর্ষ চোরের জবানবন্দিতে যুবলীগ নেতা রানার নাম : আট মামলার আসামি দুর্ধর্ষ চোর মো. সোহেল ওরফে সেলু স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেন, আমি নগরীর বাকলিয়ায় পুরাতন স্ট্ক্র্যাপের ব্যবসা করি। তিন বছর ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। নগরীর বাকলিয়ার কমিশনার (কাউন্সিলর) জাফরের ছেলে যুবলীগ নেতা রানার সঙ্গে অনেক আমার আগে পরিচয় হয়। তিনি আমাদের 'বড় ভাই'। রানা এলাকার নেতা হওয়ায় তার কথা শুনতে হতো আমাদের। তার কথা না শুনলে এলাকায় ব্যবসা করতে পারতাম না। তাই চুরির মাল বেশি দাম পাওয়ার জন্য আমার কাছে সব সময় বিক্রি করে আসছিল তারা। ঈদের পর আনোয়ার ওরফে মালিঙ্গা, শাকিল ওরফে রেন্ডি, হৃদয়, মাসুম ও নয়ন কিছু চুরির মাল আমার কাছে এনে বিক্রি করে। এ ব্যবসার জন্য রানা প্রতিদিন আমার কাছ থেকে এক হাজার টাকা করে চাঁদা নিত। রানা আমাদের সবার বড় ভাই। তার কথামতো আমরা কাজ করি।'
চলতি বছরের ২৯ আগস্ট চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন চোর সেলু। তিনি কুমিল্লা জেলার মুরাদনগর উপজেলার ধন্যারপাড়ের মৃত মোহন মাঝির ছেলে। থাকেন চট্টগ্রাম নগরীর বাকলিয়া থানার শান্তিনগর বগারবিলে ইসলাম ভিলায়।
পাইপ বেয়ে ১০ তলা উঠে যেতে পারেন মালিঙ্গা :দুর্ধর্ষ চোর চক্রের মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হচ্ছেন আনোয়ার হোসেন ওরফে মালিঙ্গা। ছয় বছর ধরে মালিঙ্গা, সোহেলসহ চক্রটি শহরে এ অপকর্ম করে আসছে। কোতোয়ালি থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) মো. কামরুজ্জামান জানান, এই দুর্ধর্ষ চোর চক্রের মধ্যে আনোয়ার মালিঙ্গা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অপরাধী। মালিঙ্গা টার্গেট করা ফ্ল্যাট কিংবা বাসায় পাইপ বেয়ে প্রথমে ব্যালকনিতে ওঠেন। সেখানে গ্রিল কেটে ফ্ল্যাটে ঢুকে চুরি করে আবার পাইপ বেয়ে নিচে নেমে আসেন। মালিঙ্গা এতটাই ভয়ঙ্কর যে ১০ তলা ভবনেও পাইপ বেয়ে অনায়াসে উঠতে পারেন। নগরীর আন্দরকিল্লায় নবম তলায়, কাজীর দেউড়িতে চারতলায় ভবনে পাইপ বেয়ে উঠে ফ্ল্যাটে ঢুকে চুরি করেন। গ্রিল কেটে ভেতরে ঢুকে ল্যাপটপ, মোবাইল, টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, পোশাক নিয়ে দ্রুত পালিয়ে যান তারা। সোহেল ও মালিঙ্গার কাছ থেকে কাজীর দেউড়ির চারতলার ফ্ল্যাট থেকে চুরি করা তিন ভরি স্বর্ণ, চোরাই ল্যাপটপ ও নগদ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। একটি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলাও দায়ের করেছি। এ মামলায় তাদের সহযোগী দুর্ধর্ষ চোর নাজমুল হাসান শামীম ও মো. রাজ্জাক পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি রয়েছেন।
টার্গেট ধনাঢ্য হলেও বাদ দেননি বিচারকের বাসাও :গত ছয় বছর বড় ভাই যুবলীগ নেতা রানার অধীনে শহরের বিভিন্ন জায়গায় চুরি করে আসছিল তারা। তাদের বিরুদ্ধে ২০১৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত আটটি চুরির মামলা রয়েছে। গত ছয় মাসে তারা ৮ থেকে ১০ বার চুরি করেছে। তাদের টার্গেট ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ফ্ল্যাট কিংবা বাসা হলেও গত ১৪ ফেব্রুয়ারি নগরীর কোতোয়ালি থানার আন্দরকিল্লায় কে বি অর্কিড প্লাজার নবম তলায় চট্টগ্রামের পঞ্চম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ জান্নাতুল ফেরদৌস চৌধুরীর বাসায় চুরি করে। বাসার বারান্দার গ্রিল কেটে চুরি হয়েছে বলে অভিযোগ করে কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। গত ১৯ জুন নগরীর সার্সন রোডে অ্যাঞ্জেলিনা গোমেজের বাসায়, ৯ আগস্ট চট্টেশ্বরী মোড়ে আবদুল হামিদ সওদাগরের বাসায়, ১৪ আগস্টের মধ্যে কাজীর দেউড়ির সানমার এলিভেরা বিল্ডিংয়ে মো. আবদুল্লাহর চতুর্থ তলার ফ্ল্যাটে ও ১৬ আগস্ট সিরাজউদ্দৌলা রোডে রুহুল আমীনের বাসায় চুরি হয়। প্রতিটি চুরির ঘটনায় এ চক্র জড়িত বলে স্বীকার করেছে তারা। ৮ থেকে ১০ জন সদস্য রয়েছে দুর্ধর্ষ এ চোর চক্রে।