মুখে কথা নেই, শুধু তাকিয়ে থাকছেন মিন্নি
দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর কারাগার থেকে বাসায় ফিরেছেন আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। স্বামী রিফাত শরীফকে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার হওয়ার পর ১ মাস ১৮ দিন কেটে গেছে কারাগারে। বাসায় ফিরে চুপচাপ হয়ে গেছেন মিন্নি। ফেলফেল করে তাকিয়ে থাকছেন স্বজনদের দিকে। কিছুই বলছেন না। কী যেন একটা চাপা কষ্ট ভর করে আছে তার বুকে। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে চোখ বেয়ে বেরিয়ে আসছে পানি।
আক্ষেপ করে মিন্নির বাবা মোজ্জাম্মেল হক কিশোর বলেন, ‘একদিকে স্বামী হারানোর শোক, অপরদিকে মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলা। সব মিলিয়ে ভালো নেই মিন্নি।’
বরগুনায় চাঞ্চল্যকর রিফাত শাহনেওয়াজ শরীফ হত্যা মামলায় গ্রেফতার তার স্ত্রী ও মামলার প্রধান সাক্ষী মিন্নি গ্রেফতারের ১ মাস ১৮ দিন পর হাইকোর্ট থেকে জামিন পেয়ে মঙ্গলবার বরগুনা জেলা কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান।
বিকাল সাড়ে ৪টায় বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর মেয়েকে নিয়ে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। এ সময় মিন্নির চাচা মো. দুলাল ও আবু সালেহসহ স্বজন এবং আইনজীবীরা কারাফটকে ছিলেন।
বরগুনার জেলার মো. হুমায়ূন কবির মঙ্গলবার বিকালে যুগান্তরকে বলেন, বরগুনার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের রিলিজ আদেশ পেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে বিকাল সাড়ে ৪টায় জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছে।
মিন্নিকে গ্রহণ করে কারাগারের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর। সেখানে স্বজন ও আইনজীবীরা আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলেন। বের হওয়ার পর অ্যাম্বুলেন্সে করে মিন্নিকে নিজ বাড়ি নয়াকাটা মাইঠা গ্রামে নিয়ে যায়।
মিন্নির মা জিনাত জাহান মনি মেয়েকে কাছে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানে উপস্থিত লোকজন ‘জেলখানায় কেমন ছিলেন’ জানতে চাইলে মিন্নি দ্রুত ঘরে ঢুকে যান। পরে মিন্নির বাবা আগত সবাইকে মিষ্টিমুখ করান।
গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা না বলা ও বাবার জিম্মায় থাকার শর্তে জামিন পেয়েছেন মিন্নি। জেলখানা থেকে বেরিয়ে আসার সময় মিন্নিকে সেই শর্তের কথা মনে করিয়ে দেন তার আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলাম। এরপর থেকে চুপ হয়ে যান মিন্নি। বাসায় ফিরে বাবা-মা ছাড়া কারো সঙ্গেই কথা বলছেন না তিনি।
গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো বক্তব্য না দিলেও মিন্নি তার ওপর চালানো পুলিশের অমানুষিক নির্যাতনের কথা বাবাকে জানিয়েছেন।
মঙ্গলবার রাতে মিন্নির বাবা কিশোর গণমাধ্যমকে বলেন, ‘মিন্নি পুলিশের হেফাজতে থাকার সময় তার হাঁটুতে আঘাত করা হয়েছে। সে শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ। যার কারণে তাকে কারাগার থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে বাসায় আনা হয়েছে।’
উন্নত চিকিৎসার জন্য মিন্নিকে ঢাকা অথবা বরিশালে নিয়ে যাবেন জানিয়ে তার বাবা বলেন, ‘বাসা থেকে যখন সাক্ষী হিসেবে মিন্নিকে প্রথমে পুলিশ লাইনে আসামি শনাক্তকরণের কথা বলে নেয়া হয় সেই থেকেই চলে নির্যাতন।
মিন্নিতে পুলিশ হেফাজতে ঘুমাতে দেয়া হয়নি জানিয়ে কিশোর বলেন, আদালতে তোলার আগের রাতে মিন্নিকে ঘুমাতে দেয়া হয়নি। সারা রাত দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। এমন কি প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতেও দেয়া হয়নি।’
এর আগে মঙ্গলবার বিকালে কারাগারে জামিন আদেশ পৌঁছানোর অপেক্ষায় থাকাকালে কারাফটকে কিশোর বলেন, আমি আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করছি। আমার নির্দোষ মেয়েটি বিনা দোষে ১ মাস ১৮ দিন অতি কষ্টে জেলে ছিল।
তিনি আবারও বলেন, আমার মেয়ে ছিল সাক্ষী। একটি প্রভাবশালী মহলের কারণে তাকে আসামি করা হয়েছে। আমার মেয়ে তার স্বামীকে বাঁচানোর জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেইদিন সন্ত্রাসীদের সামনে পড়েছে। অথচ তাকে আসামি করে দীর্ঘদিন জেলে আটকে রাখা হল।
কুচক্রী মহলের কারা জানতে চাইলে মিন্নির বাবা বলেন, ‘যারা বরগুনায় নয়ন বন্ড তৈরি করেছে, ইয়াবা মাদকের সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে, যে প্রভাবশালী মহলের নাম ইতিপূর্বে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে, তারাই আমার মেয়েকে সাক্ষী থেকে আসামির কাঠগড়ায় এনেছে। এমন কি মিন্নিকে ঢাকা থেকে যেন জামিন করাতে না পারি সেজন্য সেই কুচক্রী মহল তখন ঢাকায় অবস্থান করছিল।’
এ সময় মিন্নির আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলাম বলেন, আমি মূলত জেলগেটে এসেছি মিন্নিকে হাইকোর্টের নির্দেশনা জানিয়ে দিতে। হাইকোর্ট নির্দেশনা দিয়েছেন, মিন্নি কোনো গণমাধ্যমের সামনে কথা বলতে পারবেন না।
বরগুনা সরকারি কলেজ গেটের সামনে ২৬ জুন সকালে নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজী ও তার সঙ্গীরা রিফাত শরীফকে কুপিয়ে জখম করে। বিকালে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল হাসপাতালে মারা যান তিনি।
পরদিন রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেন।
জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে ১৬ জুলাই মিন্নিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরদিন আদালত ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলে তা শেষ হওয়ার আগেই ১৯ জুলাই তদন্ত কর্মকর্তা মিন্নিকে বরগুনা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির করেন।
মিন্নি হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। ২১ জুলাই বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মিন্নির আইনজীবী জামিনের আবেদন করলে তা নামঞ্জুর করেন আদালত। ২৩ জুলাই তার আইনজীবী বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে জামিনের আবেদন করেন।
৩০ জুলাই তা নামঞ্জুর হলে ওই আদেশের বিরুদ্ধে ৬ আগস্ট হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করেন আইনজীবী। ৮ আগস্ট হাইকোর্ট রুল দিতে চাইলে মিন্নির আইনজীবী আবেদন প্রত্যাহার করে নেন। পরে হাইকোর্টের অন্য বেঞ্চে আবেদন করেন আইনজীবী।
এর আগে গত ২৯ আগস্ট মিন্নিকে কেন জামিন দেয়া হবে না- মর্মে জারি করা রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্টের বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ দুই শর্ত দিয়ে মিন্নির অন্তর্বর্তী স্থায়ী জামিন মঞ্জুর করে রায় দেন।
শর্ত দুটি হলো- ১. জামিনে থাকাবস্থায় মিন্নি তার বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের জিম্মায় থাকবেন; ২. জামিনে থাকাবস্থায় তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না। এই দুই শর্তের ব্যত্যয় ঘটলে মিন্নির জামিন বাতিল হবে বলে রায়ে উল্লেখ করেন হাইকোর্ট।
এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। হাইকোর্টের দেয়া জামিন স্থগিত চেয়ে করা রাষ্ট্রপক্ষের আপিল আবেদনের ওপর সোমবার নো-অর্ডার (কোনো আদেশ নয়) দেন সুপ্রিমকোর্টের চেম্বার আদালত। ফলে মিন্নির জামিনে মুক্তিতে বাধা কাটে।