১০ বছরে ২৭৪৮ অভিযোগ প্রশাসনে, যৌন কেলেঙ্কারির শাস্তি ওএসডি!
জামালপুরের জেলা প্রশাসক আহমেদ কবীরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দুটি যৌন কেলেঙ্কারির ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর নানা ধরণের তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। অভিযোগ উঠেছে, প্রশাসনে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠলেও শাস্তি হচ্ছে সামান্যই। শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সহকর্মী ও সেবাগ্রহীতা নারীরা অভিযোগও দিচ্ছেন নিয়মিত, আদালতে মামলাও হয়েছে।
এর সর্বশেষ সংযোজন জামালপুরের জেলা প্রশাসক আহমেদ কবীরের সাথে এক নারীর আপত্তিকর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছড়িয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে। জামালপুরে নতুন ডিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন পরিকল্পনা মন্ত্রীর একান্ত সচিব (উপসচিব) মোহাম্মদ এনামুল হক। তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করবেন।
এ ছাড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের যুগ্ম সচিব (জেলা ও মাঠ প্রশাসন অধিশাখা) মুশফিকুর রহমানকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। অথচ তাকে চলতি বছর বিভাগীয় পর্যায়ে সেরা হিসেবে শুদ্ধাচার পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল।
অভিযোগ উঠেছে, এ ধরণের অপরাধের বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থা বিভাগীয় তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রতিবেদন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠালেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। জনপ্রশাসনে এসব গুরুতর অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি ‘ওএসডি’।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, বিগত ১০ বছরে দুই হাজার ৭৪৮ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নারী কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। এরমধ্যে তদন্ত করে মাত্র ৩৬৫ জনের বিরুদ্ধে প্রাথমিক সত্যতা পায় মন্ত্রণালয়। পরে সংশ্নিষ্ট বিধিমালার আলোকে ৩৬৫ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়।
পড়ুন: স্বামীহারা সাধনার জীবন ছিল উশৃঙ্খলতায় ভরা
এ নিয়ে ৪৪০টি বিভাগীয় মামলায় ১০ বছরে ৬৭ জন কর্মকর্তাকে গুরুদণ্ড, ১২৬ জন কর্মকর্তাকে লঘুদণ্ড, ২০৩ জন কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট ৪৪টি বিভাগীয় মামলার কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
জানা গেছে, গত অক্টোবরে নাটোরের তৎকালীন জেলা প্রশাসক (ডিসি) গোলামুর রহমানের বিরুদ্ধে এক নারী ম্যাজিস্ট্রেটকে যৌন হয়রানির অভিযোগ ওঠে। কুপ্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ায় তাকে হয়রানির অভিযোগ ওঠে। পরে ওই ম্যাজিস্ট্রেট জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ করলে এক মাস পর গোলামুরকে ওএসডি করা হয়।
ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে দীর্ঘদিন ধরে এক কলেজছাত্রীকে ধর্ষণ করেন উপসচিব একেএম রেজাউল করিম রতন। এ ঘটনার মামলায় চার্জশিট প্রকাশের পর তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
এর আগে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার অভিযোগ ওঠে সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসিফ ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে। প্রতারণার শিকার নারী সুবিচার প্রার্থনা করে ওই সময়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে লিখিত আবেদন করে। দুই দফা তদন্ত শেষ হলেও ইমতিয়াজের বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
জানা যায়, মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এ ধরণের অভিযোগ বেশি। লঘুদণ্ড হিসেবে বেশিরভাগের শাস্তি হয়েছে মৌখিক সতর্কতা। কয়েকজন কর্মকর্তার দুটি করে ইনক্রিমেন্ট দেওয়া হয়নি। অনেকে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের বিচারে সন্তুষ্ট না হয়ে হাইকোর্টেও যাচ্ছেন।
অবশ্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তাধীন থাকলে পদোন্নতি বন্ধ থাকে। এ ছাড়া অভিযোগ প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হলে সাময়িক বরখাস্ত করা হয় বলে জানা গেছে। তবে বেশিরভাগ অভিযোগ তদন্ত পর্যায়ে নিষ্পত্তি হওয়া, বিভাগীয় মামলায় দায়সারা শুনানি শেষে শাস্তি ছাড়া নিষ্পত্তি এবং অভিযোগ আমলে না নেওয়ায় নারী কেলেঙ্কারির ঘটনা বাড়ছে বলে অনেকে মনে করছেন।
জামালপুরের ডিসির বিষয়ে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছেন, ‘ডিসি একটি জেলার অনুকরনীয় ব্যাক্তি। তার কাছে এরকম অনৈতিক কর্মকান্ড কাম্য না। তার বিরুদ্ধে তদন্তের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমুলক ব্যাবস্থা নেয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘তাকে এর আগে শুদ্ধাচার পদক দেয়া হয়েছিলো। সেটা ফিরিয়ে নেয়া হবে।’ আগামীতে ডিসি নিয়োগের ক্ষেত্র নৈতিকতা বিবেচনা করে নিয়োগ দেয়া হবে বলেও জানান তিনি। প্রতিমন্ত্রী বলেন, জামালপুরের ডিসি অনৈতিক কাজ করেছে। প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে তার বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেয়া হয়েছে। অধিকতর তদন্তের ভিত্তিতে পরবর্তীতে আইনানুগ ব্যাবস্থা নেয়া হবে।
এ ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলি ইমাম মজুমদার গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ওএসডি একটি প্রাথমিক পদক্ষেপ। এটি আইনগত কোনো শাস্তি নয়। তদন্তের পর অভিযুক্ত হলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অন্যায়ের অভিযোগ এলে তা তদন্ত করে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া উচিত। এটি না হলে প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ে।’ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের বিচার না হওয়া একটি খারাপ দৃষ্টান্ত বলেও উল্লেখ করেন তিনি।