পা কেটে যাওয়ায় জুতা পায়ে দেই, না জেনে মন্তব্য কইরেন না
বরগুনায় রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে স্ত্রী আয়শা আক্তার মিন্নির ভূমিকা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে রিফাতের হত্যাকাণ্ডের নতুন একটি ভিডিও ফুটেজ ছাড়িয়ে পড়েছে গণমাধ্যমে। ফুটেজে দেখা গেছে— হামলার শুরুতে রিফাত শরীফের স্ত্রী মিন্নি আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি স্বাভাবিকভাবে হেঁটে যাচ্ছেন।
ভিডিওতে দেখা গেছে, সন্ত্রসীরা কলেজ গেট থেকে রিফাত শরীফকে টানতে টানতে সামনে নিয়ে যাচ্ছে, মিন্নি তখন স্বাভাবিকভাবে তাদের পেছনে হাঁটছেন। কয়েক সেকেন্ড পর রিফাতকে কোপানোর সময় মিন্নি ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। কখনো নয়ন বন্ড, কখনো রিফাত ফরাজীকে বাধা দিচ্ছিলেন। সন্ত্রাসীরা চলে যাওয়ার পর রিফাত শরীফ হেঁটে রিকশায় ওঠেন। মিন্নি তখন ব্যাগ ও জুতা তুলে রিফাতকে খুঁজতে সামনে এগিয়ে যান।
এ ঘটনার পর নয়নরা যখন পালিয়ে যায় তখন একজন মিন্নিকে তার পার্সটি মাটি থেকে হাতে তুলে দেন। মিন্নি স্বাভাবিকভাবে সামনের দিকে হাঁটতে থাকেন।
নতুন ভিডিওটি নিয়ে মঙ্গলবার সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন মিন্নি। তিনি বলেন, তখন সোয়া দশটা হয়তো, রিফাত আমাকে বলে, আব্বু আসছেন, চলো তোমার সাথে দেখা করবে। আমি ওরে বলছিলাম আমার কাজ শেষ করে বের হই, ও আপত্তি করে বলে, বাবা গেটে অপেক্ষা করছে, আমি তখন ওর সাথে বের হই। গেটের বাইরে এসে এদিক ওদিক তাঁকিয়ে দেখি ওর বাবা কোথাও নেই। তখন আমি বলি— তুমি মিথ্যে বলেছ, চলো রুটিন নিয়ে আসি। আমি ওরে নিয়ে ভেতরে যেতে চাই।
মিন্নি আরো বলেন, ঠিক তখন ১০-১২ জন আমাদের ঘিরে ধরে। রিশান ফরাজী ওর পথরোধ করে বলে, তুই আমার বাবা মা তুলে গালি দিছিস? ও বলে না, তখন রিফাত ফরাজী এসে বলে আমার চোখের দিকে তাঁকিয়ে বল। এরপর আরো কয়েকজন ওকে জোর করে সামনে নিয়ে যায়।
ভিডিও সম্পর্কে মিন্নি বলেন, ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতভম্ব হয়ে ওদের পেছনে হাঁটতে থাকি। পরে ওরা আক্রমণ করলে প্রতিরোধের চেষ্টা করি। অনেকের কাছে হেল্প চাইছি, কেউ আসেনি। ওরা চলে যাওয়ার পর রিফাত নিজেই হেঁটে রিকশায় ওঠে, আমার পা কেটে যাওয়ায় হাঁটতে পারছিলাম না, তাই জুতা পায়ে দেই। তখন একজন আমার হাতে ব্যাগ তুলে দেয়। পরে আমি দ্রুত রিফাতকে নিয়ে হাসপাতালে যাই। ওই সময় দুজন মোটরসাইকেল নিয়ে আমাদের রিকশা ফলো করছিলো।
বিতর্ক প্রসঙ্গে মিন্নি বলেন, কেউ কেউ বিষয়টি ভিন্ন দিকে নেয়ার চেষ্টা করছে। আমি বলবো, বিয়ের মাত্র দুই মাসের মাথায় স্বামীকে নির্মমভাবে খুন হতে দেখেছি। মানসিকভাবে আমি প্রচণ্ড বিধ্বস্ত। আপনাদের কাছে অনুরোধ, আমি তো আপনাদের মেয়ে। আপনারা না জেনে কোনো মন্তব্য কইরেন না। এ মুহূর্তে আমার পাশে কেউ নেই, আমি সবাইকে পাশে চাই।
বরগুনার এসপি মারুফ হোসেন বলেন, এটি একটি নারকীয় হত্যাকাণ্ড। আমরা কাউকে টার্গেট করে না, সার্বিক বিষয় নিয়েই তদন্ত করছি। মিন্নি এ মামলার প্রধান সাক্ষী। তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাড়িতে পাহারা বসানো হয়েছে।
৯ মিনিট ৩ সেকেন্ডের ভিডিও
গত ৬ জুলাই ৯ মিনিট ৩ সেকেন্ডের একটি গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিও ফুটেজটির ৫ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডে দেখা গেছে, নয়ন বন্ড, রিফাত ফরাজীরা রিফাতকে মারধর করতে করতে বরগুনা সরকারি কলেজ থেকে বের হচ্ছে। এদের মধ্যে একজন পেছন থেকে রিফাতকে ধরে রেখেছে। বাকি দুজন দুইহাত ধরেছে। ৫ মিনিট ৪৩ সেকেন্ডে ফুটেজে মিন্নিকে দেখা যায়, তার বাম হাতে একটি পার্স ছিল। সে পার্স হাতে স্বাভাবিকভাবে হাঁটছিল।
৫ মিনিট ৪৯ সেকেন্ডে যখন নয়নের সঙ্গীরা রিফাতের মাথায় হাত দিয়ে আঘাত করেন তখনও স্বাভাবিক ছিলেন মিন্নি। ৫ মিনিট ৫৫ সেকেন্ডে যখন সব বন্ধুরা একসঙ্গে রিফাতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন তখন প্রথমবারের মতো দৌড়ে যান মিন্নি। প্রতিরোধের চেষ্টা করেন। তখন দা বের করে কোপানো শুরু হয়। পেছন থেকে মিন্নিকে প্রতিরোধ করতে দেখা যায়।
এ ঘটনার পর নয়নরা যখন পালিয়ে যায় তখন একজন মিন্নিকে তার পার্সটি মাটি থেকে হাতে তুলে দেন। মিন্নি স্বাভাবিকভাবে সামনের দিকে হাঁটতে থাকেন।
এর আগে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে গণমাধ্যমে মিন্নি বলেছেন, ‘ফেসবুকে তার বিরুদ্ধে লিখে ঘাতকদের বাঁচানোর চেষ্টা চলছে।’ তিনি বলেন, ‘ফেসবুকে আমাকে নিয়ে বিভিন্ন লেখালেখি হচ্ছে। এসব যারা করছেন, তারা সন্ত্রাসীদের বাঁচানোর জন্য আমাকে নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করছেন। এই হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করে এরাও খুনের সঙ্গে জড়িত। প্রধানমন্ত্রী ও দেশের মানুষের কাছে আমার একটিই দাবি, তাদের যেন শাস্তি দেয়া হয়।’
রিফাতকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন জানিয়ে মিন্নি বলেন, ‘আমাদের বিয়ের বয়স দুই মাস। কিন্তু দুই-তিন বছর আমাদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্ক ছিল। আমরা একজন-আরেকজনকে ভালোবাসতাম। বিষয়টি আমাদের পরিবারকে জানালে দুই মাস আগে আমাদের আনুষ্ঠানিক বিয়ে হয়। আমার স্বামীকে সন্ত্রাসীরা চোখের সামনে কুপিয়ে হত্যা করল।’
নয়ন দীর্ঘদিন ধরে উত্ত্যক্ত করে আসছে জানিয়ে মিন্নি বলেন, ‘আমি তো আগেই বলেছি- বিয়ের আগে ও পরে নয়ন আমাকে রাস্তাঘাটে বিরক্ত করত। জোর করে আমার রিকশায় ওঠত। আমার সঙ্গে ছবি তুলত।’ এসব জেনেও যারা রিফাত হত্যায় নয়ন-মিন্নির কথিত সম্পর্ককে দায়ী করছেন, সেসব ফেসবুক স্ট্যাটাসকারীদের উদ্দেশ্যে স্বামীহারা এই গৃহবধূ বলেন, ‘ভাই, আপনারা এসব বাদ দিয়ে একটু খুনিদের ধরতে সহযোগিতা করুন।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বরগুনার পুলিশ সুপার (এসপি) মারুফ হোসেন বলেন, মিন্নি এ মামলার একজন সাক্ষী। তদন্তের স্বার্থে প্রয়োজনে তাকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে।
গত ২৬ জুন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্ত্রীর সামনে সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে রামদা দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর আহত করে রিফাত শরীফকে। তার স্ত্রী আয়শা আক্তার মিন্নি হামলাকারী সাব্বির আহমেদ নয়ন (নয়ন বন্ড) ও রিফাত ফরাজীর সঙ্গে লড়াই করেও তাদের থামাতে পারেননি। গুরুতর আহত রিফাতকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে বিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।