নিরাপদ সড়ক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অপরাধ খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ
গত বছরের ২৯ জুলাই জাবালে নূর পরিবহনের বাসের চাপায় বিমানবন্দর সড়কের কুর্মিটোলায় শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হন। আহত হন আরও কয়েকজন শিক্ষার্থী ও সাধারণ যাত্রী। ওই ঘটনার প্রতিবাদে রাস্তায় নামে সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বাসচাপায় ‘হত্যার’ বিচারসহ নিরাপদ সড়কের জন্য ৯ দফা দাবিতে চলে টানা আন্দোলন। স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েও ছড়িয়ে পড়ে।
জানা গেছে, আন্দোলন চলার সময় রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ২২ শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরমধ্যে বাড্ডা ও ভাটারা থানায় দায়ের করা মামলায় শিক্ষার্থীদের রিমান্ডে নেওয়া হয়। এছাড়া প্রায় দশ মাস ধরে তদন্ত করেও এখন শিক্ষার্থীদের অপরাধ খুঁজে পাচ্ছেন না তদন্তকারী কর্মকর্তারা। ফলে আদালতে অভিযোগপত্রও দাখিল করতে পারেননি। মামলায় গ্রেফতার হয়ে ১২ দিন কারাভোগের পর ৯ দিন আদালতে হাজিরা দিতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের।
এ অবস্থায় ভোগান্তির শিকার হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রমও ব্যহত হচ্ছে। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের আইনজীবীরা মনে করছেন, মামলাগুলো হয়রানিমূলক ও অনেকাংশে রাজনৈতিক। ফলে এসব মামলা থেকে নিরপরাধ সাধারণ শিক্ষার্থীদের অব্যাহতি দেওয়া উচিত।
আন্দোলন চলাকালে দিন সায়েন্স ল্যাব, জিগাতলা ও ধানমন্ডি এলাকায় গুজব ছড়িয়ে পড়লে সেখানে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষ ঘটে। এ ঘটনার প্রতিবাদে পরবর্তীতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এসব ঘটনায় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের পক্ষে নাশকতার মামলা দায়ের করা হয়। এরপরই বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী পুলিশের হাতে আটক হন। এরমধ্যে বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২২ শিক্ষার্থী ছিলেন। এরমধ্যে ৬ আগস্ট বাড্ডা থানায় দায়ের করা মামলায় ১৪ শিক্ষার্থী ও ভাটারা থানার মামলায় আট জনকে আসামি করা হয়।
তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে ১২ দিন কারাভোগের করার পর ঈদের আগে তারা জামিনে মুক্তি পান। পরদিন ২২ শিক্ষার্থীকে আদালতে হাজির করে দুই দিনের রিমান্ডে আনা হয়। রিমান্ডের পর কারাগারে পাঠান আদালত। তারাও ১২ দিনের কারাভোগ শেষে জামিন পান। জামিনে মুক্তি পেলেও হয়রানি থেকে মুক্তি মেলেনি বলে অভিযোগ করেছেন একাধিক ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবক।
এ প্রসঙ্গে বাড্ডা থানায় দায়ের করা মামলায় আটক হওয়া সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র ইকতিদার হোসেন বলেন, ‘আমরা এ পর্যন্ত ৯ বার আদালতে হাজিরা দিয়ে এসেছি। ক্লাস পরীক্ষা রেখে হাজিরা দিতে সেই পুরান ঢাকা যেতে হয়। সেদিন আর ক্লাস বা পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার সুযোগ থাকে না। কোনও অপরাধ না করেও অপরাধীর মতো ঘুরছি।’
ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ‘কেন গ্রেফতার করা হয়েছিল, আমাদের অপরাধটা কী, জানি না। যে অপরাধের কথা বলা হচ্ছে, এমন কিছু ঘটেনি বা ঘটে থাকলেও আমি এর ধারেকাছে ছিলাম না।’
তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে বাড্ডা থানায় দায়ের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই জুলহাস মিয়া ও ভাটারা থানার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই হাসান মাসুদ গণমাধ্যমকে জানান, ‘মামলার তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে তা আদালতে জমা দেওয়া হবে।’
তদন্তে কোনও নিরপরাধ শিক্ষার্থী যেন জড়িয়ে না যান, সে ব্যাপারে তদন্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) শেখ নাজমুল আলম। তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘শিক্ষার্থীদের বিষয়ে আমাদের অবস্থান শুরু থেকেই নমনীয় ছিল। আমরা চাই না, নিরপরাধ কেউ মামলায় জড়াক। ওই সময় দায়ের করা মামলাগুলোর তদন্ত চলছে। দ্রুত তদন্ত শেষে মামলা নিষ্পত্তি করা হবে।’
এ ঘটনা নিয়ে শঙ্কিত অভিভাবকরাও। সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী অনিকের বোন অনন্যা বলেন, ‘আমার ভাইসহ বেশ কয়েকজনের পড়াশোনা শেষ হয়েছে। কিন্তু তারা চাকরিতে যোগ দিতে পারছেন না মামলার কারণে। মামলার ঝামেলায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বাবা।’ অনিকসহ নিরপরাধ ভাইদের অচিরেই মামলা থেকে মুক্তি দেওয়া হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার আইনজীবী হিসেবে লড়ছেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি তদন্ত দীর্ঘ সময়েও শেষ না হওয়ার প্রসঙ্গে বলেন, ‘আদালতে চার্জশিট যে সময়ের মধ্যে দেওয়ার কথা সেটা কখনোই ফলো করা হয় না। আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি, এই মামলাগুলো হয়রানিমূলক মামলা। মামলা করে তাৎক্ষণিকভাবে হয়রানি করাই ছিল ওই সময়ের উদ্দেশ্য। অন্য কোনও অভিযোগ করার মতো কিছুই এই শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে ছিল না।’
তিনি বলেন, ‘তাদের নিরাপদ সড়কের দাবি ছিল যৌক্তিক। এ কারণেই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করতে দেরি হচ্ছে। গৎবাঁধা কিছু কথা বলা ছাড়া অভিযোগের বিষয়ে বলার মতো কিছু নেই।’ তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে এই হয়রানিমূলক মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করা হোক।’ মামলা থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়ারও আহবান জানান আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।