১০ জুন ২০১৯, ১৪:২৬

ক্রিকেট বিশ্বকাপ ঘিরে জমজমাট জুয়ার আসর

  © সংগৃহীত

ক্রমেই জমে উঠছে ক্রিকেট বিশ্বকাপ। আর তার সঙ্গে সক্রিয় হয়ে উঠছে অপরাধী চক্রগুলো।ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলাকে কেন্দ্র করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে, এমনকি গ্রামগঞ্জেও চলছে রমরমা জুয়ার আসর। এতে জড়িয়ে পড়েছে শিক্ষার্থীসহ, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে শ্রমজীবীরাও। দিনমজুররাও এ ফাঁদে পা দিচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যারা বাজি ধরেন তাদের বেশিরভাগেরই বয়স ১৫ থেকে ২৫ বছর। যাদের বয়স বেশি, তারাই হলেন ঘরোয়া বাজির মূল খেলোয়াড়। রাজধানীর মিরপুর-পল্লবী, পুরান ঢাকা, যাত্রাবাড়ী, বাড্ডা, টঙ্গী এবং কামরাঙ্গীরচরে বাজিকরদের বিচরণ সবচেয়ে বেশি। তবে নগরীর প্রতিটি পাড়া-মহল্লাতেই এর কমবেশি বিস্তার রয়েছে।

জুয়াড়িদের এ ধান্দায় বাদ নেই নগরীর অভিজাত এলাকাগুলো। ধনীর দুলালরা বাজি ধরেন বিভিন্নভাবে। অভিজাত হোটেলে গিয়ে তারা বাজি ধরেন মোটা অংকের। দলগত হার-জিত নির্ধারণ ছাড়া পাশাপাশি চলে ওভার বা ‘বল বাই বল’ বাজি। পাশাপাশি ম্যাচে পাওয়ার প্লেতে (প্রথম ৬ ওভার) কত রান হবে, পাঁচ থেকে ১০ ওভারে কত রান হবে, টোটাল রান কত হবে, কোন প্লেয়ার বেশি রান করবে সবকিছু নিয়েই চলে বাজি। বিশেষ করে বাংলাদেশের খেলা থাকলে জুয়ার আসর সবচেয়ে বেশি জমে ওঠে।

জানা গেছে, মোটা অঙ্কের বাজিতে হেরে প্রতিদিনই অসংখ্য পরিবার সর্বস্বান্ত হচ্ছেন। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। র‌্যাব-পুলিশসহ আইন রক্ষাকারী বিভিন্ন সংস্থা নানামুখী তৎপরতা চালালেও জুয়ার বড় আসর অনলাইনভিত্তিক হওয়ায় এটি মোকাবেলায় তাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে।

অপরাধ পর্যবেক্ষকদের অভিমত, বিশ্বে পাঁচটি বাজিকর বা জুয়াড়ি অধ্যুষিত দেশের মধ্যে ভারত এবং পাকিস্তানের নাম রয়েছে। আর প্রতিবেশী এ দুটি দেশ থেকেই বাংলাদেশে আইপিএল, বিপিএল, বিশ্বকাপ; এমনকি দেশ-বিদেশের ঘরোয়া লিগগুলোকে ঘিরে বাজিকররা রমরমা বাণিজ্য জমিয়ে তুলেছে। শুরুতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর না হওয়ায় জুয়ারি সিন্ডিকেট এখন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। ফলে অবৈধ আর্থিক লেনদেন দিন দিন বাড়ছেই।

সংশ্লিষ্টরা জানান, বিশ্বকাপ ক্রিকেটের জুয়ার আসর ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে এরইমধ্যে ছোটবড় বেশ কয়েকটি সংঘর্ষ-সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে। তবে ফেঁসে যাওয়ার ভয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে উভয়পক্ষই গোটা বিষয়টি গোপন রেখেছে। গোয়েন্দাদের আশঙ্কা, সহসা বাজিকরদের দৌরাত্ম্য থামানো না গেলে আগামীতে খুনোখুনিসহ নানা ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও ঘটতে পারে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, আন্তর্জাতিক জুয়াড়িদের তৎপরতা আমাদের দেশে তুলনামূলক কিছুটা কম হলেও ঘরোয়া বাজিকরদের বিচরণ ক্ষেত্র যথেষ্ট বিস্তৃত। নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত জুয়াড়িদের জন্য পৃথক সিন্ডিকেটও রয়েছে। এতে জুয়াড়িরা আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী বাজি ধরতে পারে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান জানান, বিশ্বকাপ ক্রিকেট ঘিরে সক্রিয় জুয়াড়িদের ধরতে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। পাড়া-মহল্লা এমনকি অলিগলিতে যেসব স্থানে টিভিতে খেলা দেখানো হয় সেসব স্পটে গোয়েন্দা মোতায়েন করা হয়েছে। জুয়ার সঙ্গে কারও সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেলে তাকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তবে বাসা-বাড়িতে এ ধরনের অপতৎপরতা চললে তা বন্ধ করা দুস্কর বলে মন্তব্য করেন তিনি।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বিশ্বকাপ ক্রিকেট ঘিরে বেশিরভাগ জুয়ার আসর বসছে বিভিন্ন আবাসিক ভবনে। বাজিকররা টিভির স্ক্রিনে খেলা দেখে দাঁও (বাজি) ধরছে। তাদের বেশিরভাগ পরস্পর বন্ধু-বান্ধব কিংবা পরিচিতজন হওয়ায় নগদ টাকার পরিবর্তে এ বাজিতে নানা ধরনের টোকেন ব্যবহার করছে। ফলে অভিভাবকরা এ ব্যাপারে পুরোপুরি অজ্ঞাত থাকছেন।

এদিকে শহর-নগরে গড়ে উঠেছে জুয়ার বাজির ডিলার। এ ডিলাররাই মূলত বাজি নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন ম্যাচকে ঘিরে ডিলাররা জুয়ার একটা রেট দিয়ে দেন। ম্যাচটি যদি সমান সমান কোনো দলের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয় সে ক্ষেত্রে বাজির দরের হেরফের হয় ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। আর শক্তিশালী দলের সঙ্গে দুর্বল দলের খেলা হলে বাজির দরের হেরফের নিম্নে এক হাজার টাকা থেকে কয়েকগুণ বেশি হয়ে থাকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ডিলার জানান, বিশ্বকাপ ক্রিকেট ঘিরে জুয়া বাণিজ্য ভীষণভাবে জমে উঠেছে। তবে এতে লাভ যেমন হচ্ছে, তেমনি অনেক সময় লোকসানের ঝুঁকিতেও পড়তে হচ্ছে। কেননা এ জুয়া বাণিজ্য অবৈধ হওয়ায় স্থানীয় প্রশাসন, থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে চলতে হয়।

তবে নগদ বাজিতে টাকার অংক বড় না হলেও মূল জুয়ার আসর জমে উঠেছে অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন বেটিং সাইটে। যদিও অনেক আগেই বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) খেলাধুলা বিষয়ক অনলাইনে জুয়া খেলার সাইট বেট ৩৬৫ ডটকম, ৮৮ স্পোর্টস ডটকম ও রেবটওয়ে ডটকমসহ ১২টি সাইট বন্ধ করে দিয়েছে। তবে প্রক্সি সার্ভার দিয়ে এখনও ওই সাইটগুলোতে ঢোকা যাচ্ছে এবং জুয়া খেলাও অবাধে চলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিটিআরসি সাইটগুলো বন্ধ করার ফলে প্রথমে অনলাইনকেন্দ্রিক জুয়াড়িরা কিছুটা সমস্যায় পড়েছিল। তবে দ্রম্নতই বিকল্প হিসেবে প্রক্সি সার্ভারের ব্যবহার শুরু হয়। এর ফলে দেশ থেকেও অন্য কোনো অবস্থান দেখিয়ে এসব সাইটে ঢোকা যায়। জুয়াও চলেছে সমানতালে।

সিটিটিসি ইউনিটের সাইবার সিকিউরিটি ও সোস্যাল মিডিয়া স্পেশালিস্ট এর এডিসি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, এসব সাইটের জুয়াড়িরা আর্থিক লেনদেন করে ২৮টি বৈদেশিক মুদ্রায়। ব্যাংকিং থেকে শুরু করে পেপল, মাস্টার কার্ড, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ডে অর্থ লেনদেন হয়। ফুটবল, ক্রিকেট, টেনিস, গলফ, ঘোড়দৌড়সহ আন্তর্জাতিক সব ধরনের ক্রীড়া স্থান পায় এসব সাইটে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের মতো বড় ক্রীড়া আসরে এসব সাইটের ব্যবহার অনেক গুণ বেড়ে যায়।

রাজধানীর উপকণ্ঠ নারায়ণগঞ্জ ও রূপগঞ্জের স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, বিশ্বকাপ ক্রিকেট ঘিরে সেখানকার বিভিন্ন ক্লাব ও চায়ের দোকানের প্রায় ২০০ স্থানে জুয়া খেলা চলছে। একেকটি স্পটে ১০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে লাখ টাকার বাজি চলছে। এ হিসেবে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের প্রতিটি ম্যাচে প্রায় কোটি টাকার খেলা হচ্ছে।