৩১ জুলাই ২০২৫, ১৪:৩০

‘হারুনের ভাতের হোটেল’ বন্ধ হওয়ার দিন আজ

‘হারুনের ভাতের হোটেল-এ খাবার খেয়েছেন রাজনীতিবীদ থেকে অভিনেত্রী পর্যন্ত সবাই  © টিডিসি সম্পাদিত

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ তার ‘ভাতের হোটেল’ কাণ্ডের জন্য ব্যাপক আলোচিত হয়ে ওঠেন। ডিবি কার্যালয়ে ডাকা বিভিন্ন ব্যক্তিকে ভাত খাওয়ানোর দৃশ্য ভিডিও করে ছড়িয়ে দিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন তিনি। পরে অনেকেই এই কর্মকাণ্ডকে ‘দুষ্টুমি’ হিসেবে অভিহিত করে ‘হারুনের ভাতের হোটেল’ নামকরণ করেন। হারুন নিজেও বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকারে এই নাম উপভোগ করেছিলেন।

২০২২ সালের জুলাইয়ে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নেন হারুন। পরে ২০২৩ সালের ২৯ জুলাই আওয়ামী লীগবিরোধী আন্দোলনের সময় বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে ডিবি কার্যালয়ে এনে নিজ হাতে ভাত খাওয়ানোর ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন তিনি। এরপর থেকেই শুরু হয় বিতর্কের ঝড়। সেই ভিডিওর পর থেকেই ডিবি কার্যালয়ে নানা অতিথিকে ভাত খাওয়ানোর ঘটনা নিয়মিত হয়ে ওঠে। হারুন একে ‘মানবিকতা’ দাবি করলেও গোয়েন্দা বাহিনীর ভাবমূর্তি চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়। হাস্যরসের প্রতীকে পরিণত হয় গোটা গোয়েন্দা বিভাগ।

আবার ‘হারুনের ভাতের হোটেল’ এর খাবারের মান নিয়েও অনেকের অভিযোগ ছিল। আলোচিত কনটেন্ট ক্রিয়েটর আশরাফুল ইসলাম ওরফে হিরো আলম হত্যার হুমকির অভিযোগ নিয়ে ১৩ সেপ্টেম্বর ডিবিপ্রধান মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের সঙ্গে দেখা করেন। ওইদিন দুই সহযোগীসহ ডিবি কার্যালয়ে দুপুরের খাবার খান তিনি। তবে ডিবি কার্যালয় থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের কাছে পুলিশ কর্মকর্তাদের আপ্যায়ন নিয়ে প্রশ্ন না তুললেও খাবার নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন হিরো আলম। 

তিনি বলেন, ‘আমাদের আলুভর্তা আর ডাল দেওয়া হয়েছে। এটা ঠিক না। দুরকম খাবার দিচ্ছেন, ঠিক নাকি? অপু বিশ্বাস এলে অনেক খাবার দিছেন, নেতা এলেও অনেক কিছু খেতে দিছেন। আর আমারে খালি আলুভর্তা, ডাল, ভাজি দিছেন। এ সময় হিরো আলম বলেন,‘আমাদের আলুভর্তা আর ডাল দেওয়া হয়েছে। এটা ঠিক না। দুরকম খাবার দিচ্ছেন, ঠিক নাকি? অপু (অপু বিশ্বাস) এলে অনেক খাবার দিছেন, নেতা আসলেও অনেক কিছু খেতে দিছেন। আর আমারে খালি আলুভর্তা, ডাল, ভাজি দিছেন।’

সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনা ঘটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়। আন্দোলনের ছয় সমন্বয়কারীকে নিরাপত্তা দেওয়ার কথা বলে ডিবি কার্যালয়ে ডেকে এনে তাদের ২৪ ঘণ্টার বেশি আটকে রাখেন হারুন। পরে আন্দোলন প্রত্যাহারের ভিডিও ধারণ করে তা প্রচার করেন। এমনকি তাদের সঙ্গে নিজের ভাত খাওয়ার ছবিও সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেন। বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালত তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘জাতিকে নিয়ে মশকরা কইরেন না, যারে ধরেন, খাবার টেবিলে বসাইয়া দেন।’ পরে ১৪ দলীয় জোটের এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনা হয়। সেখানেই হারুনকে ডিবি থেকে সরানোর সিদ্ধান্ত হয়। আজকের এই দিনে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে গোয়েন্দা বিভাগ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

হারুন অর রশীদ বিসিএস পুলিশ ক্যাডারের ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তা। তিনি কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা। আলোচনায় আসেন ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগে অতিরিক্ত উপ-কমিশনার থাকাকালে, ২০১১ সালে সংসদ ভবনের কাছে তৎকালীন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নাল আবেদীন ফারুককে মারধরের ঘটনায় তার নাম উঠে আসে।

পুলিশ সুপার হিসেবে গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে দায়িত্ব পালনকালে একাধিক বিতর্কে জড়ান তিনি। ২০১৬ সালের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের দুই দিন আগে নির্বাচন কমিশন তাকে গাজীপুর থেকে প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে পুনরায় সেখানে পদায়ন করে। নারায়ণগঞ্জে দায়িত্ব পালনকালে পারটেক্স গ্রুপের চেয়ারম্যান এম এ হাশেমের ছেলে ও আম্বার গ্রুপের চেয়ারম্যান শওকত আজিজ রাসেলের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন হারুন। রাসেলের গাড়ি, চালক, এমনকি তার স্ত্রী-সন্তানকেও আটক করে গাড়ি থেকে মাদক ও গুলি উদ্ধারের দাবি করেন তিনি। কিন্তু পরে বাসা থেকে তুলে নেওয়ার সিসিটিভি ফুটেজ প্রকাশ পেলে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। এরপর ২০১৯ সালের নভেম্বরে তাকে প্রত্যাহার করে পুলিশ সদর দপ্তরে বদলি করা হয়।

২০২১ সালে অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে ডিবি উত্তর, সাইবার ও স্পেশাল ক্রাইম বিভাগে যুগ্ম কমিশনার হন হারুন। এক বছরের মধ্যেই ডিআইজি পদে পদোন্নতি পান এবং পরে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হিসেবে গোয়েন্দা বিভাগের দায়িত্ব পান। সেই থেকেই ‘ভাতের হোটেল’ কাণ্ডসহ একাধিক বিতর্কে জড়ান।

ডিবিতে দায়িত্ব পালনের সময় বিকৃত সুরে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়ায় হিরো আলমকে আটক করে আবারও সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। এ ঘটনা আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও প্রচারিত হয়, যা নিয়ে পুলিশ প্রশাসনের উচ্চপর্যায়েও অস্বস্তি তৈরি হয়।

গয়েশ্বর চন্দ্র রায়কে রাস্তায় পিটিয়ে আহত করার পর ডিবিতে এনে ভাত খাওয়ানোর ভিডিও প্রচার ছিল আরেক আলোচিত কাণ্ড। সাধারণ নাগরিক ও বিভিন্ন তারকাকে ডেকে এনে তাদের সঙ্গে ভাত খাওয়ার ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে আলোচনায় থাকতেন তিনি। এমনকি ব্লগার ও টিকটকারদের দিয়ে নিজের পক্ষে ভ্লগ বানিয়ে প্রচার করতেন।

ডিবির এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, আলোচিত এমপি আনার হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকে ডিবি থেকে সরানোর পেছনেও হারুনের ইন্ধন ছিল। নিয়মিত যারা তার কাছে দেখা করতে যেতেন না, তাদের তিনি অপছন্দ করতেন।

ডিবির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সরকারের বিশেষ আনুকূল্য লাভের আশায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ছয় নেতাকে তুলে আনার নির্দেশ দেন হারুন। এরপর তাদের নিয়ে প্রচার চালান নিজের স্বার্থে। ফলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতেই শেষ পর্যন্ত হারুনকে ডিবি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের পর শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটে। এর পর থেকেই ডিবি হারুনের আর কোনো খোঁজ মেলেনি। তবে তার কর্মকাণ্ড ও ‘ভাতের হোটেল’ আজও মানুষের মনে রয়ে গেছে।