প্রতিবাদী নুসরাতকে নিয়ে তারানা হালিমের আবেগঘন স্ট্যাটাস
ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে টানা ১০৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে থামতে হলো নুসরাতকে। বুধবার রাত সাড়ে ৯টায় আইসিইউতেই মারা যান ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি।
বৃহস্পতিবার মো. ছাবের সরকারি পাইলট হাইস্কুল মাঠে সন্ধ্যা ৫টা ৫০ মিনিটে তার নামাজের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজার নামাজের ইমামতি করেছেন নুসরাতে বাবা মাওলানা এ কে এম মুসা।
মৃত্যুর আগে লাইফসাপোর্টে থেকে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে গেছেন নুসরাত। তার চলে যাওয়ায় শোকে ডুবেছে জাতি। ভাষাহীন সচেতন নাগরিকরা। তবু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নুসরাতকে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত বলে আখ্যা দিচ্ছেন সকলে।
নুসরাতকে নিয়ে ফেসবুকে আবেগঘন স্ট্যাটাস দিয়েছেন সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট তারানা হালিম। আজ তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেয়া স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো—
‘নুসরাত, তোমার অগ্নিদগ্ধ শরীর, অসীম সাহসিকতার সঙ্গে অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, ব্যান্ডেজে বাঁধা শরীরের মাঝে বেরিয়ে থাকা ফুটফুটে সুন্দর মুখ আর পা-জোড়া, তোমার “ডায়িং ডিক্লারেশন” – এর দৃপ্ত উচ্চারণ –‘এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করব’- আবারও এই সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করল যে সমাজের বিবেক এখন লাইফ সাপোর্টে, তুমি নও।
তুমি বরং লাইফ সাপোর্ট থেকে এই অচল সমাজের অমানবিকতাকে প্রতিবাদ করতে বলে শান্তির জগতে চলে গেছ। নারী-শিশু ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির ঘটনা এখন সড়ক দূর্ঘটনার মতই কেবল সংখ্যা হয়ে যাচ্ছে। এটি হতে দেয়া যাবে না। মাদ্রাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানীর প্রচেষ্টার অভিযোগ করার জন্য তোমার ভাষ্যমতে, মিথ্যা কথা বলে কয়েকজন নারী তোমাকে ছাদে নিয়ে মামলা প্রত্যাহারের চাপ দিলে তুমি তাতে রাজী না হয়ে ‘এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করব’ বললে তোমার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
তুমি তাদের ‘নারী কন্ঠে’র কথা বলেছ। দুঃখ এটাই যে, কাকের মাঝে ‘নারী-কাক’ বা ‘পুরুষ কাক’-এমন লিঙ্গ বিভাজন করি না আমরা। কিন্তু মানুষ বিভাজিত হয়ে যায় নারী ও পুরুষে। একটি কাক বিদ্যুৎপৃষ্ট হলে মারা গেলে অনেক কাক কোথা থেকে যে এসে জড়ো হয়। তাড়স্বরে আওয়াজ করে। ওরা চীৎকার করে, না কাঁদে জানি না। কিন্তু কিছু একটা করে। আর আমরা? যখন তোমার ডায়িং ডিক্লারেশনে কয়েকজন নারী তোমার গায়ে আগুন দিয়েছে বলো-তখন মনে হয় মানুষ কি কাকের মত হতে পারে না? মানুষ নাই হোক। কারণ আমরা মানুষতো নই, কাকও নই।
তুমি যখন তোমার মাদ্রাসার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুললে তখন মাদ্রাসার অন্য শিক্ষকরা ও ছাত্রছাত্রীরা তোমার পক্ষে লড়ে গেলে তুমি শক্তি পেতে। কিন্তু তা হয় নি। যখন ফায়ার সার্ভিসের লড়াকু সোহেল জীবন বাঁচাতে জীবন দেয়, জসিম নামের মানুষের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া ছেলেটি, চারতলার গ্রিল বেয়ে উঠে বনানীর এফ আর টাওয়ারের আগুন থেকে নারীর জীবন বাঁচায়, তখনই একদল মানুষ আরেক নারীর গায়ে আগুন দেয়। এত ছোট একটি জীবন কেবল মানুষের ভালো করার জন্য বড় সংক্ষিপ্ত। সেই জীবনে এত হিংসা, এত লোভ, এত প্রতিহিংসা, এত অমানবিকতা, এত পাষন্ডতা!
নুসরাত, তুমি বলেছ- প্রতিবাদ করে যাবে, তোমার কাজ তুমি করেছ। তোমার কাছ থেকে শিখে, এবার নারী পুরুষ নির্বিশেষে আমাদের প্রতিবাদ করার পালা। শেষ থেকে শুরু হোক,নতুন করে পুরনো প্রতিবাদ। এই প্রতিবাদে তোমার সহযাত্রী হবে-বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট।’
৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি পরীক্ষা দিতে গেলে দুর্বৃত্তরা তার গায়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। গুরুতর আহত অবস্থায় ওই দিন রাতে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। গতকাল বুধবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নুসরাত জাহান রাফি মারা যান।
এর আগে গত ২৭ মার্চ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মামলা করেন নুসরাতের মা। এ মামলা তুলে নেওয়া এবং অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে নুসরাত যা অভিযোগ করেছিলেন সব মিথ্যা তা বলার জন্য চাপ দিতে থাকে দুর্বৃত্তরা। এতে নুসরাত ও তাঁর পরিবার রাজি হয়নি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে লাইফ সাপোর্টে যাওয়ার আগে নুসরাত চিকিৎসকদের কাছেও জবানবন্দি দেন।