কিনতেই হচ্ছে শিক্ষকদের পছন্দের গাইড বই!
- রাকিব হাসান
- প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০১৯, ০৫:২২ PM , আপডেট: ১২ জানুয়ারি ২০১৯, ০৭:২৬ PM
পহেলা জানুয়ারি বই উৎসবে সরকারিভাবে দেয়া নতুন বই হাতে পেয়ে শিক্ষার্থীরা যতটা উচ্ছ্বসিত হয়, ঠিক ততটাই শংকিত হন অভিভাবকরা। কারণ বিনামূল্যের বই পাওয়ার পরই স্কুলের শিক্ষকরা তাদেরকে ধরিয়ে দেন একগাদা গাইড বইয়ের তালিকা। বাধ্য হয়েই শিক্ষকদের পছন্দের তালিকার এসব নিষিদ্ধ বই কিনতে হয় অভিভাবকদের। চড়া দামের গাইড বই কিনতে গিয়ে হিমশিম খান তারা।
বগুড়ার শেরপুরের চিত্রটা এমন। এখানকার মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল প্রধান এবং মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতি মোটা অংকের টাকা নিয়ে নির্ধারিত প্রকাশনীর সহায়ক নিষিদ্ধ গাইড বই কিনতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এতে লেখাপড়ার প্রকৃত মান নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। শিক্ষার্থীদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিয়ে তৈরি হচ্ছে শংকা।
উপজেলা শিক্ষা অফিস সুত্রে জানা যায়, উপজেলার ১৩৭টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১০৮টি কিন্ডারগার্টেনসহ মোট ২৫৩ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থীকে ২লাখ ১৬ হাজার নতুন বই প্রদান করা হয়। এছাড়া ১২৮টি উচ্চবিদ্যালয় ও মাদ্রাসার ৪৩ হাজার শিক্ষার্থীদের মাঝে ৫ লাখ ৯৩ হাজার নতুন বই বিতরণ করা হয়েছে।
সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন বুক স্টলে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধানদের নির্দেশে শিক্ষার্থীদের সহায়ক ও নিষিদ্ধ গাইড বই কেনার জন্য নির্ধারিত প্রকাশনীর তালিকা ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। যদি কোন শিক্ষার্থী নির্ধারিত তালিকার বাইরে অন্যকোন প্রকাশনার গাইড ক্রয় করে তাহলে তাকে আবারো নতুন করে গাইড কিনতে বাধ্য করা হয়। শেরপুর উপজেলার ৪৮টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে এবং বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদাররেছীন শেরপুর উপজেলা শাখার আওতায় মাদ্রাসা শিক্ষক কর্মচারি কল্যাণ সমিতির অর্ন্তভুক্ত ২২টি এবং সাবেক মাদরাসা শিক্ষক পরিষদের অধীনে ২০টি মাদ্রাসায় প্রকাশনীর লোকজন প্রতি বছর মোটা অংকের টাকা দেয়। বিনিময়ে এই সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় পাঞ্জেরী, লেকচার, অনুপম, জুপিটার, আল ফাতাহ্ ও আল আরাফার মতো প্রকাশনীগুলোর নিষিদ্ধ গাইড বই। এদিকে এনসিটিবি প্রণীত ও অনুমোদিত পাঠ্যপুস্তকের বাইরে এসব সহায়ক ও নিষিদ্ধ গাইড বই মোটা অংকের বিনিময়ে কিনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের।
উপজেলার মাথাইলচাপড এলাকার অভিভাবক আরিফুজ্জামান জানান, তার তিন সন্তানের জন্য গাইড বই কিনতে খরচ হয়েছে ১ হাজার ১০০ টাকা। দহপাড়ার শরিফ আহম্মেদ জানান, তার ছেলের জন্য সহায়ক বই কিনতে ৩০০ টাকা লেগেছে। হাসপাতাল রোড এলাকার আবুল কালাম আজাদ বলেন, আমার দুই ছেলের জন্য পাঠ্যবইয়ের বাইরে স্কুল থেকে নির্ধারিত প্রকাশনীর বাংলা ও ইংরেজি ব্যাকরণ, সাধারণ জ্ঞান ও চিত্রাঙ্কন খাতা কিনতে সাড়ে ৭০০ টাকা লেগেছে।
তারা জানান, নির্ধারিত প্রকাশনীর সহায়ক বই ও নিষিদ্ধ গাইড না কিনলে সংশ্লিষ্ট স্কুলে শিক্ষার্থীদের নানাভাবে হেনস্থা করা হয়। অভিযোগ আছে, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল ও মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রকাশনীর নিষিদ্ধ গাইড কিনতে বাধ্য করছেন শিক্ষকরা। স্কুল পর্যায়ে জুপিটার, পাঞ্জেরী, লেকচার, অনুপম, ফ্রেন্ডস, জনক, ফুলকলি, আল আমিন প্রকাশনী এবং মাদ্রাসায় আল-ফাতাহ্, আল-বারাকা, মিনার প্রকাশনীসহ বিভিন্ন অখ্যাত প্রকাশনীর গাইড কেনার জন্য শিক্ষার্থীদের হাতে তালিকা ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। এসব প্রকাশনীর বিক্রয় প্রতিনিধিরা স্কুল-মাদ্রাসার প্রধান এবং সমিতির নেতাদের বিভিন্ন ধরণের উপঢৌকন ও মোটা অংকের টাকা দিয়ে প্রকাশনীর সহায়ক ও নিষিদ্ধ গাইড বই বিক্রির ব্যবস্থা করেন।
অভিভাবকরা জানান, যেখানে সরকার সহায়ক বইয়ের প্রতি শিক্ষার্থীদের নিরুৎসাহিত করছে, সেখানে সহায়ক ও নিষিদ্ধ গাইড বই কিনতে শিক্ষকরাই বাধ্য করছেন। এসব বই কিনতে ব্যয় হচ্ছে ১ হাজার টাকা থেকে সাড়ে ৩ হাজার টাকা। সাধারণ ও নিম্মমানের ছাপা, ভুলে ভরা চটি আকারের সহায়ক বইগুলোর একেকটির দাম দেড়’শ থেকে ২’শ টাকা।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নাজমুল ইসলাম জানান, এনসিটিবি প্রনীত ও অনুমোদিত পাঠ্যপুস্তকের বাইরে কোনো বিদ্যালয় যদি পাঠ্যসূচিতে অতিরিক্ত কোনো পুস্তক অন্তর্ভুক্ত করে বা শিক্ষার্থীকে তা ব্যবহারে বাধ্য করে তবে সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।