আলোর পুরীতে আঁধারই ওদের সঙ্গী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্র

প্রয়াত ব্যান্ডশিল্পী আইয়ুব বাচ্চু ‘অন্ধকার মানুষ’ শিরোনামে গেয়ে গেছেন, ‘কেউ জানো না- আমি কি খুঁজি/কেউ বোঝনা- আমার স্বপ্ন; অন্ধকারে থেকেও আমি/অন্তহীন আঁধার খুঁজি।’ আইয়ুব বাচ্চু কীসের ভিত্তিতে আঁধার খুঁজেছেন তা হয়ত জানা যায়নি; কিন্তু ওদের তো আঁধার চাইতে হয় না। আলোর ঝলকানিতে থাকলেও আঁধারই ওদের নিত্যসঙ্গী। গল্পটা এক সময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের।

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম— বাঙালির সব অধিকার আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। অথচ শিক্ষার মতো মৌলিক অধিকার বঞ্চিত হচ্ছেন এই প্রতিষ্ঠানে থাকা ৫ শতাধিক কোমলমতি শিশু। খোঁজে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোর ক্যান্টিন ও খাবারের দোকানগুলোতে কর্মরত কর্মচারীদের অধিকাংশের বয়স ১৫ বছরের কম। সকাল থেকে রাত অবধি কাজ করায় এসব শিশুরা একদিকে যেন পড়ালেখার সুযোগ বঞ্চিত হচ্ছেন, তেমনি শিকার হচ্ছেন নানা ধরণের নিপীড়ন-বঞ্চনার। চলছে কচি হাতে হাড়ভাঙা খাটুনিও।

জাতিসংঘ প্রণীত শিশু অধিকার সনদে ১৮ বছরের কম বয়সী প্রত্যেককে শিশু বলা হয়েছে। আর বাংলাদেশের শ্রম আইন (২০০৬) অনুসারে শ্রমিকের বয়স কোনক্রমেই ১৪ বছরের নিচে হওয়া যাবে না। আন্তর্জাতিক শ্রম আইন সংস্থা (আইএলও) এবং জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী, যখন কোন শ্রম বা কর্মপরিবেশ শিশুর জন্য দৈহিক, মানসিক, নৈতিক এবং সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে অন্তরায় ও ক্ষতিকর হিসেবে গণ্য হবে; তখন তা শিশু শ্রম হিসেবে গণ্য হবে। যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দোকান ও ক্যান্টিনগুলোতে কর্মচারী হিসেবে কর্মরতদের অধিকাংশই শিশু। কম মজুরিতে নিয়োগ দেয়ার উদ্দেশ্যেই এসব শিশুকে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করছেন ক্যান্টিন ও দোকান মালিকরা। যদিও এসব শিশু শ্রম বন্ধে কোন ধরণের ব্যবস্থা নিচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা হল প্রশাসন। 

ভূক্তভোগী বিভিন্ন হলের ক্যান্টিন বয়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নামমাত্র মজুরি দেয়া হয় তাদের। কাজের জন্য নির্দিষ্ট কোন কর্মঘন্টা বা সময়সীমা নেই। ভোরে ঘুম থেকে উঠার পরপরই কাজ শুরু। আর রাতের খাবার বিক্রি শেষে ঘুমাতে যেতে হয় রাত ১১ টার পর। কথা হয় হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের ক্যান্টিনে কর্মরত এক ক্যান্টিন বয়ের সাথে। বাড়ি তার চাঁদপুর, বাবা রিক্সা চালক। সে জানায়, ক্যান্টিনে প্লেট দেয়া থেকে শুরু করে উচ্ছিষ্ট খাবার পরিষ্কার করা, পানি আনা নেয়াসহ বিভিন্ন ধরণের কাজ করতে হয়। ভোর ছয়টা থেকে তার কাজ শুরু হয়। থামে রাত ১১ টায়। কাজ শেষে খাবারের টেবিলের উপরই বিছানা করে ঘুমাতে হয় তাকে। এভাবেই চলছে তার জীবন। 

শুধু মুহসীন হলের ক্যান্টিনেই এ ধরনের শিশুর সংখ্যা ১০ জন। ২০১৪ সালে মুহসীন হলের ক্যান্টিনে গরম ডালের গামলা আনতে গিয়ে সমস্ত গা পুড়ে যায় ১২ বছর বয়সের এক শিশুশ্রমিকের। এরপরও বন্ধ হয়নি শিশুদের দিয়ে কাজ করানো। মুহসীন হলের ভিতরের প্রায় প্রত্যেক দোকানেই কাজ করছে এ ধরণের শিশুরা। থাকা-খাওয়া বাদে মাসে ১ হাজার থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন দেয়া হয় তাদের।

মধুর ক্যান্টিনের রুবেল। তার দাবি, ছাত্রলীগ-ছাত্রদলে আসা ৯৬ পরবর্তী সব নেতা তাকে চেনে

 

‘রুবেল। যখন সে ক্যাম্পাসে পা রাখে; তখন সবে ৭-এ পা দিয়েছে। গায়ে ছিল গেঞ্জি, পরনে হাফ-প্যান্ট। রুবেলের বয়স আজ ২৭। এই ২০ বছরে ছাত্রদলের আজিজুল বারী হেলাল, শফিউল বারী বাবু থেকে ছাত্রলীগের মাহমুদ হাসান রিপন, মাহফুজুল হায়দার চৌধুরী রোটন— সবাই তার হাতে চা খেয়েছে। অথচ তার শিশু থেকে শৈশব, শৈশব থেকে কৈশোরে পা রাখা কারো চোখে পড়েনি।’

মুহসীন হলের ১১ নাম্বার দোকানে কাজ করে ১২ বছরের শিশু নাইম। ওই দোকানের মালিক তৌফিক। কেন এ ধরণের শিশুদের কাজের জন্য নিয়ে আসা হয় এ নিয়ে তৌফিক বলেন, কাজ করতে আসা বেশীরভাগের পরিবার দরিদ্র। তারা এমনিতেই পড়ালেখা করে না। নাইমের আগে এখানে থাকা ছেলেটির মা অসুস্থ ছিল। সে কোনদিনও স্কুলে যায়নি। নাইম ৩য় শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছে। অনেক সময় এদের পরিবারের পড়ালেখা চালানোর সামর্থ্য থাকে না। এক্ষেত্রে এসব ছেলেরা খারাপ লোকজনের সাথে মিশে নষ্ট হয়ে যায়। তার চেয়ে ভালো- আমার এখানে কাজ করছে। তাকে ২ হাজার টাকা করে দিচ্ছি।

কথা হয় সূর্যসেন হলের ভেতরের চায়ের দোকানে কর্মরত রাকিব ও ইব্রাহীমের সাথে। রাকিবের বয়স ১২। সে চা বিক্রির কাজ করে।  খোশগল্প চলাকালে রাকিব বলে, ‘আমার আসল নাম ফয়সাল, ডাক নাম রাকিব। এখানকার সবাই আমাকে একনামে চিনে।’ ইব্রাহীমের বয়স হবে বড়জোর ১১। সে বাড়িতে ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়লেও এখন আর সে সুযোগ নেই।

১৯৯০ সালে বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন পাশ হয়। দেশকে শতভাগ নিরক্ষরতামুক্ত করতে সরকার বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করে যাচ্ছে। এজন্য প্রাথমিক শিক্ষা প্রদান করা হচ্ছে বিনামূল্যে এবং বৃত্তিমূলকভাবে। দেশের নিরক্ষরতা দূরীকরণে সরকারের পক্ষ থেকে এত উদ্যোগ স্বত্বেও ঢাবি প্রশাসনের নাকের ডগায় এমন কাজ চলছে। অথচ এ নিয়ে ভ্রুক্ষেপ নেই কারও।

বিষয়টি নিয়ে ছাত্রদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, শিক্ষা মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। অথচ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করা শিশুরা তাদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এটা কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী হাসান জামিল বললেন, ‘প্রথমত শিশুশ্রম অবৈধ, কিন্তু পারিবারিক অনটনের কারণে যেসব শিশুরা এখানে কাজ করতে আসে তারা যেন নিরক্ষর না রয়ে যায়; সেজন্য সবার এগিয়ে আসা উচিত। এ ক্ষেত্রে  বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এসব ক্যান্টিন ও দোকানের মালিকদের নিয়ম করে দিতে পারে যে, এসব বাচ্চাদের সপ্তাহে অন্তত একদিন স্কুলে পাঠাতে হবে।’ 

বিশ্ববিদ্যালয় ও এর আশপাশের এলাকায় কাজ করা শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের পড়ানোর জন্য বিভিন্ন সময় উদ্যোগ নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। কিন্তু পারিপার্শিক বিভিন্ন কারণে আশানুরূপ সফলতা পাচ্ছেন না তারা। এক্ষেত্রে প্রশাসনিক ও আর্থিক সহযোগিতা পেলে এ কাজটি আরও ত্বরান্বিত হবে বলে মনে করছেন তারা।

ঢাকাতে ছিন্নমূল শিশুদের নিরক্ষরতা দূরীকরণে কাজ করে ‘সেভ দ্যা ফিউচার’ নামের একটি সংগঠন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পরিচালনায় সংগঠনটির ৭টি স্কুল রয়েছে ঢাকায়। সপ্তাহে একদিন করে সেচ্চাশ্রমের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীরা ছিন্নমূল ৫ থেকে ১২ বছরের শিশুদের পাঠদান করে থাকে। ঢাবি এলাকায় কর্মরত শিশুরা কেন এসব কার্যক্রমে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করছেন না তা নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের কথা হয় সংগঠনটির অন্যতম উদ্যোক্তা শরিফ ওবায়দুল্লাহর সাথে।

সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে ক্যান্টিনের সব ধরণের কাজ করানো হয় তাদের

 

তিনি বলেন, ‘সমাজের অধিকার বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা বিস্তারে আমরা কাজ করছি। ক্যাম্পাসের পাশে আমাদের একটি স্কুল আছে; যেখানে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ জন পড়তে আসে। তিনি জানান, চাইলেও ক্যাম্পাসের বিভিন্ন হলের ক্যান্টিন ও দোকানে কর্মরত শিশুরা আমাদের স্কুলে আসতে পারে না। কারণ, সম্পাহের ছুটির দিন আমরা ক্লাস পরিচালনা করি; আর তাদেরকে সেদিনও তাদের কাজ করতে হয়। আমাদের পক্ষেও ব্যাপকভাবে তাদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক এ কে এম গোলাম রব্বানী বিষয়টি নিয়ে বলেন, ‘শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, দেশের আইনে শিশু শ্রম অবৈধ। আমরা খোঁজ-খবর নেব, বিষয়টি কি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জ্ঞাতসারে হচ্ছে না-কি অজ্ঞাতসারে হচ্ছে। এর মাধ্যমে পরবর্তীতে ব্যবস্থা নিতে সহজ হবে।’


সর্বশেষ সংবাদ