১২ নভেম্বর ২০১৮, ২৩:০৪

#মি টু: এবার মুখ খুললেন ঢাবির প্রাক্তন ছাত্রী

মুমতাহানা ইয়াসমিন তন্বীর ফেসবুক ওয়াল থেকে  © সংগৃহীত

এবার ‘মি টু’ হ্যাশট্যাগ দিয়ে যৌন হয়রানি নিয়ে মুখ খুললেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মুমতাহানা ইয়াসমিন তন্বী নামের প্রাক্তন এক ছাত্রী। বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ২০১১-১২ সেশনের এ ছাত্রী বতর্মানে জার্মানিতে থাকেন। সোমবার ফেসবুকে যৌন হয়রানি নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন তিনি। 

যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে মি টু হ্যাশট্যাগ দিয়ে বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ চলছে কয়েক বছর ধরে। কোনো বাংলাদেশীর বিরুদ্ধে অপর বাংলাদেশীর মি টু হ্যাশট্যাগ দিয়ে যৌন হয়রানির অভিযোগ সর্বপ্রথম উঠে গত অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে। ২০১৪ সালের মিজ আয়ারল্যান্ড মডেল মাকসুদা আক্তার প্রিয়তি রংধনু গ্রুপের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন। 

এরপর চলতি নভেম্বর মাসে  শুচিস্মিতা সিমন্তি নামে আরেকজন তাঁর মায়ের এক সময়কার বন্ধু-সহকর্মী সাংবাদিক প্রনব সাহার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করেন। প্রনব সাহা ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে সেই অভিযোগ অস্বীকার করেন। আর এ সপ্তাহেই পাঠক সমাবেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শহিদুল ইসলাম বিজুর বিরুদ্ধেও একই ধরণের অভিযোগ উঠেছে। তার বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ তুলেছেন ট্রান্সজেন্ডার শিল্পী তাসনুভা আনান শিশির। বিজুও ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সবগুলো অভিযোগই প্রকাশ্যে এসেছে ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে। 

মি টু হ্যাশট্যাগ দিয়ে সর্বশেষ অভিযোগ তুললেন মুমতাহানা ইয়াসমিন তন্বী। পাঠকের জন্য তাঁর স্ট্যাটাস হুবহু তুলে ধরা হলো- 

“#Me_Too......

তখন সম্ভবত সপ্তম-অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। ছোট বেলা থেকেই প্রচন্ড দূরন্ত আর ছটফটে মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমি ছিলাম বড্ড আনাড়ি। নবম-দশম শ্রেণীতে থাকাকালীনও আমাকে পঞ্চম/ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্রীর মত দেখতে লাগত। ছোট-খাট শুকনা একটা মেয়ে ছিলাম আমি। আমার ছোটমামা আমাকে আদর করে লিলিপুট ডাকত। এমনকি আমার পিরিয়ডও হয়  অনেক দেরিতে।

এসএসসি পরীক্ষার কিছুদিন আগে মাত্র। এজন্যই হয়ত নারী-পুরুষের জৈবিক ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে আমার কোন ধারনাই হয়নি তখনও। ধর্ষণ, যৌন-হয়রানি, টিজ এসব শব্দের সাথে পরিচিত নই তখনও। আমি আগেও বলেছি কয়েকবার, আমি খুবই অজপাড়াগাঁয়ের মেয়ে।

প্রথম ঘটনা: 
সময়কাল (২০০৪-২০০৫)

যে অমানুষ টার কথা আমি বলব, তার নামটা সঙ্গত কারণেই নিচ্ছি না। নাম নিলে লোকে জানবে, কিন্তু কেউ তাকে অপরাধী বলবে না। সম্পর্কে সে আমার 'আংকেল' শ্রেণীর।

কোন একদিন শুক্রবারের সকাল। ধরি, অমানুষটার নাম 'শুয়োর' (বয়সে আমার থেকে ১৫-১৬ বছরের বড় হবে) ছোটবেলা থেকে এই শুয়োরের কোলে পিঠে বড় হয়েছি। শুক্রবার হওয়ায় ঐ দিন স্কুল ছুটি। খেলা করতে শুয়োরদের বাড়িতে গিয়েছি। শুয়োরের বাড়ির কেউ একজন বললেন দেখ তো তোর আংকেল এখনও ঘুম থেকে উঠেনি, ডেকে দে। আমি ডাকতে গেলাম শুয়োর কে। শীত থাকায় আমাকে বলল, আয় লেপের ভেতর ঘুমা, এত সকালে উঠে কাজ নাই। আমি তখন তসলিমা নাসরিন পড়িনি। তাই আমি জানিনা, শুয়োর প্রজাতি ঘরে ও থাকে। আমার সেই ছোট্ট শরীরে সে কী করেছিল তা আমি ঠিক বলতে পারব না। শুধু বলতে পারব, আমি ব্যাথা পেয়েছিলাম।

ফেসবুক স্ট্যাটাস

ঘটনা দুই : 
সময়কাল ( ২০০৮-২০০৯)

আমি তখন কলেজে পড়ি। আমাকে এখন দেখে হিসেব মিলাতে কষ্ট হবে জানি, তবুও বলি, এই আমি তখনও আঁতলামি পর্যায়ের কেউ ছিলাম। কলেজের হোস্টেলে থাকতাম যশোরে।

আমার ছোট আন্টি তখন চাকরির সুবাদে যশোর থাকত। আমি প্রায়ই আন্টির বাসায় যেতাম। যেহেতু শুয়োর নামের লোকটি আমাদের পরিবারের লোক, তাই সেও মাঝে মাঝে যশোর আসলে আমার হোস্টেলে আসত। আম্মু খাবার টাবার দিত, তাই নিয়ে আসত।

আমি পূর্বের ঘটনার জন্য তাকে তখনও কেন জানি দোষী মনে করিনি, বা খারাপ মানুষ মনে করিনি। কারণ তখনও আমি বুঝে উঠতে পারিনি, সে আমার সাথে যা করেছে তা জঘন্যতম আচরণ।

তখন নতুন নতুন প্রেম প্রেম ভাব হয়েছে একটা ছেলের সাথে। কেমনে কেমনে শুয়োর জেনে গেল আমি প্রেম করি। যেহেতু আমি প্রেম করি, সেহেতু আমি খারাপ মেয়ে। সুতরাং আমার সাথে আরো খারাপ কিছু করা যায়।

ছোট আন্টির বাসায় আমার আরেকজন কাজিন (আমার সমবয়সী) এসেছে। আমার কাজিনের শখ আমার হোস্টেল দেখবে। ওকে নিয়ে শুয়োর আমার হোস্টেলে আসলো। আন্টি আমাকে ফোন করে বলল, ওদের সাথে যেন আন্টির বাসায় চলে আসি।

আমার তিনজন রিক্সাতে উঠব। আগেই বলেছি, আমি দেখতে তখনও অনেক ছোটখাট পিচ্চি ছিলাম। তিনজন রিক্সাতে উঠতে হলে আমাকেই কোলে বসতে হবে। রিক্সাতে কিছুক্ষণ বসার পর টের পেলাম, শুয়োরের হাত আমার শরীরের স্পর্শকাতর জায়গাতে। আমার ছোট্ট শরীরটা রিক্সার বিশ মিনিট সময়ে ভেঙে চুরে চুরমার হয়ে গিয়েছিল।

আমি আজও রাগে-দুঃখে ফেটে পড়ি কেন সেদিন আমি রিক্সা থেকে নেমে পড়িনি, কেন প্রতিবাদ করিনি। আমার চোখ ফেঁটে কান্না বের হয়ে আসে আজও, এখনও। বুকের ভেতরটা তছনছ হয়ে যায়, একটা শুয়োর প্রজাতির মানুষ আমার শরীর স্পর্শ করছে এটা ভাবতেই আমার গা গুলিয়ে আসে।

নাহ! আমি সেদিনও কাউকেই বলতে পারিনি সেসব কথা। প্রতিবাদ ও করতে পারিনি আমি। অথচ এমন কোনদিন যায়নি আমার যেদিন আমি ঘৃণায় কুকড়ে গেছি। অথচ তারপরও আমি সেই শুয়োর লোকটির সাথে কথা বলেছি, স্বাভাবিক আচরণ করেছি।

ঘটনা তিনঃ
সময়কাল(২০১১, ৫/৬ ফেব্রুয়ারি)

আগেও একদিন বলেছিলাম, ঢাকায় প্রথম এসে আমি একটা বাসায় সাবলেট ছিলাম। রুমে আরেকজন আপু ছিল, যে কিনা রাত দশ-এগারটায় তার বয়ফ্রেন্ডকে রুমে ডেকে নিয়ে আসত।

আমার অস্বস্তি হয়, এটা জানালেই তার সাথে আমার ব্যাপক কথাকাটাকাটি হয়। ঘটনার দিন মেয়েটি আমাকে জানালো তার বয়ফ্রেন্ড রাতে থাকবে। তারা নিচেই ঘুমাবে, আমি খাটে ঘুমাব।।

ভয়ে আমি বাসা থেকে রাত প্রায় দশটার দিকে বের হয়ে প্রথমেই ফোন দিই আমার ফুফাত ভাই (ধরি তার নাম 'শুয়োর-২') কে। যে কিনা আমার আপন ভাইয়ের মত। ঢাকায় পড়াশুনা+চাকরি করে। সে আমার থেকে বয়সে ৬/৭ বছরের বড় হবে।

শুয়োর-২ কে ফোন করে খুব কান্নাকাটি করে ঘটনা খুলে বললাম। আমার থাকার জায়গা নেই, সে আমাকে তার বড় ভাই-ভাবির বাসায় রেখে আসতে পারবে কিনা, বা কোন বাসে উঠতে হবে আমাকে বলতে পারবে কিনা এটা বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম।

শুয়োর জানায়, সে পুরান ঢাকার আশেপাশেই আছে। সে আমাকে এসে নিয়ে যেতে পারবে। তাকে আমি ভরসা করি, আমার আব্বুর আরেক ছেলে সে। (এখানে বলে রাখা ভাল, আব্বু তার তিন ভাগনেকে কলিজার টুকরো মনে করে)

তার জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে অপেক্ষা করি আমি। রাত এগারটা বাজে। সে এসে আমাকে নিয়ে বাসে উঠল।

(এখানে আরেকটা কথা বলা উচিৎ। ঢাকায় তখন নতুন এসেছি আমি। ভর্তি, বাসা ভাড়া সব মিলে অনেক টাকা খরচ হয়েছে আব্বুর। আমরা মোটামুটি গরীব পরিবার। যেখানে টুকিটাকি সংসার চলে আমাদের, সেখানে আমার বাপের শখ করে মেয়েকে ঢাকা শহরে পড়ানোর মত মেধাবী হয়ে গিয়েছিলাম আমি। তবুও আমি খুব দায়িত্বশীল মেয়ে। আব্বুর খুব বেশি টাকা খরচ হয়েছে আমি বেশ বুঝতে পারি। যাতে বেশি খরচ না হয়, তাই দিনে একবেলা-দুবেলা খাই। নতুন এসেই টিউশনি খুঁজি। মাসদুয়েক ঢাকায় এসে শুকিয়ে কেমন যেন রোগাটে হয়ে গিয়েছি আমি। তাছাড়া গত কয়েকদিন ধরে রুমমেটের সাথে ঝামেলা হওয়াতে ঠিকমত খাওয়ার সময়টাও পাইনি, এমন একটা পরিস্থিতি আমার)

আমার মোশন সিকনেস আছে। গাড়িতে উঠলে বমি হয়। সদরঘাট থেকে গুলিস্তানে আসতেই কয়েকবার বমি হয়ে গেল আমার। ক্লান্ত আমি শুয়োর নামক ভাইয়ের কাঁধেই ঘুমিয়ে গেলাম। আমার ভাই, আহা কত নিশ্চিন্ত জায়গা!

ঘুম থেকে উঠলাম রামপুরা-বাড্ডা এলাকাতে। শুয়োর নামক ভাইয়ের অফিস সম্ভবত ঐ এলাকাতে। আমি তখনও ঢাকার কিছুই চিনি না। জিজ্ঞেস করলাম মিরপুর পৌঁছাতে আর কতক্ষণ? যেহেতু তখন অনেক রাত, (বারটার বেশি) সে আমাকে বলল, মিরপুরের রাস্তায় জ্যাম অনেক। তাছাড়া হুটহাট করে কেউ বাসায় গেলে ভাবি বিরক্ত হয়। তাছাড়া মিরপুরে গেলে সকালে উঠে অফিস যেতে পারবে না। আর তার বাসায় আরো ছেলেরা থাকে (মেস) সুতরাং সেখানেও যাওয়া যাবে না। 

ঢাকায় আমার আর কেউ নাই। আমি অসহায়ের মত বললাম, তাহলে আমাকে গাবতলীতে কোন একটা বাসে তুলে দেন। আমি বাড়ি চলে যাই।৷

শুয়োর বলে, এমনি এমনিই চলে যাবি? তোর ঐ বদমাশ রুমমেটকে কিছু না বলেই চলে যাবি কেন? আমি কাল তোকে নিয়ে ওই বদমাশ মেয়েটার সাথে কথা বলতে যাব, তার এত সাহস হয় কেমনে।

কিন্তু থাকব কোথায়? সে বলে পাশেই একটা আবাসিক হোটেল আছে, আজকের রাত এখানে থাক। হোটেল শুনে ভয় পেয়ে গেলাম। ভাইটি আমার মাথায় হাত রেখে বলল, মনি এত ভয় পেলে চলে? (আমাকে সে মনি বলেও ডাকত।) জীবনটা খুব কঠিন। কখন কি হয় তার মোকাবেলা করতে হবে।

আমার ভাই সে। আপন নাহোক, ভাইতো!! অপরিচিত রুমমেট এর বয়ফ্রেন্ডের সাথে একবাসায় থাকতে সমস্যা, কিন্তু এ তো আমার ভাই। মায়ের পেটের নাহোক, আমার ভাই। ঢাকায় আপাতত এই ভাইটিই আমার একমাত্র আপন।

আমার কাছে তো বেশি টাকাও নাই, সেও খুব ভালোভাবেই জানতো তার মামার গরীবি হাল। আমাকে বলে, এখন ঢাকায় এসেছিস ভালো জামাকাপড়, ভাল জুতা না পরলে হয়? কী জুতা পরেছিস, ছিড়ে গেছে প্রায়!! আচ্ছা কাল আমি অফিস থেকে ছুটি নিয়ে তোর রুমমেট কে গিয়ে ঠিক মত ঝাড়ি দিয়ে আসব, আর আমি তো জানি মামার এখন টাকা পয়সার সমস্যা চলছে, তোকে আমি শপিং করে দিব।

বড় ভাই আমার!! আমার কত আপনজন!! আমার কত খেয়াল করে!! চোখে আমার পানি চলে আসলো। ছোটবেলা থেকেই গরীবি হালে বড় হয়েছি। কেউ কিছু দিলে খুশিতে চোখ জ্বলজ্বল করত।

বড় ভাই আমার, অভিভাবক আমার। তার সাথে বাড্ডার একটা হোটেলে উঠলাম। একটাই রুম!! এটাই আমার সেদিনের রাতের সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা, নিরাপদ মানুষের সাথে।

জ্বী! আমার এখনকার জ্ঞান দিয়ে আমার সেই সতের/আঠার বছরের আমিকে বিচার করবেন না আশা রাখি।

আমার কাছে এটাই স্বাভাবিক ছিল। রুমে একটাই বিছানা, আরেকটা সোফা আর একটা টিভি। ভাই বলল, তুই কোনটাই শুবি? আমি বললাম আমি টিভি দেখি। আপনি বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েন।

(আমাদের বাড়িতে টিভি ছিল না, তাই টিভির প্রতি আমার বেশ আকর্ষণ ছিল, টিভি পেলে আমি সারা রাত দিন কাটিয়ে দিতে পারতাম)

ভাই শুয়ে পড়ল। আমি বসে বসে টিভি দেখি। হঠাৎ তার কী মনে হল সে আমাকে টানতে টানতে খাটে নিয়ে গেল। আমার চিৎকার আমার আর্তনাদ তার কানেই গেল না। আমি হতবাক হয়ে গেলাম৷সমস্ত শক্তি দিয়ে আমি চিৎকার করলাম।

আমার সামান্য চুপ থাকাতে কলেজে রিক্সার ভেতর শুয়োর নামের লোকটি যে আচরণ আমার সাথে করেছিল, সেটা আমি দ্বিতীয় বার আমার সাথে ঘটতে দিতে পারিনা।

আমি সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে ঠেলে ফেলে রুমের সাথে এটাস্ট বাথরুমে গিয়ে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলাম। ধস্তাধস্তিতে অনেক শব্দ হয়েছিল। সাথে সাথেই হোটেল কর্তৃপক্ষ দরজাতে করাঘাত করতে থাকলো। দরজা খুলে সে হয়ত বলতে চেয়েছিল কিছু হয়নি, তৎক্ষনাৎ বুদ্ধি খাটিয়ে আমিও বাথরুমের দরজা খুলে ঐ লোকটিকে বললাম ঘটনাটা।

ভয় ছিল, না জানি এই লোকটা আমাকে বিশ্বাস করবে কিনা। লোকটির হয়ত আমার নিরীহ চেহারা দেখে মায়াবোধ হল। সে আমার পরিস্থিতি বুঝলো। একটা বারও বলল না, আমি নিজেই তো তার সাথে হোটেলে আসলাম। সুতরাং, এটা আমারই দোষ। অথচ এখনও একটা মেয়ের সাথে অনাকাঙ্ক্ষিত কোন ঘটনা ঘটলে শিক্ষিত শ্রেণীর লোকেরাও মেয়ের দিকে আঙ্গুল তোলে!!

সেই রাতে হোটেলের অপরিচিত লোকটার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ, সে আমাকে বিশ্বাস করল। আমার হয়ে শুয়োর নামের ভাইটিকে একটা থাপ্পড় মেরেছিল। 

সে এই শিক্ষিত নামধারী শুয়োর নয়। ঐ লোকটি আমার পরিস্থিতি বুঝল। আমাকে আলাদা রুমে পাঠিয়ে, সে হোটেলের আর দুইটা মহিলা কর্মচারিকে ডেকে আমাকে সাহস দিলেন।

ইতোমধ্যে আমার সাবেক প্রেমিক এবং আমার বড় ভাইয়ের এক বন্ধুকে ফোন দিলাম। তারা ঢাকায় থাকাতে আমাকে নিতে আসলো, সেই রাত দুইটার দিকে। ভয়ে আমি জ্ঞান হারিয়েছিলাম। জ্বরে গাঁ পুড়ে যাচ্ছিল। ঐ রাতটা আমার জন্য কতটা ভয়ংকর ছিল, কতটা কালোরাত ছিল, তা হয়ত আমার লেখাতে বোঝা গিয়েছে কিনা জানিনা। তবে গত একসপ্তাহ ধরে আমি লিখছি আর ভাবছি , আমি ভেবেই যাচ্ছি, আমার সাথে তিন তিনবার এই ঘটনা ঘটল। আমার জীবনের সর্বশেষ কালোরাত সেটা।

★★★
তারপর অনেক দিন, অনেক গুলো মাস, বছর পেরিয়েছে। আমিও একটু একটু করে বড় হয়েছি, কঠোর হয়েছি, শক্তিশালী হয়েছি, সাহসী হয়েছি। আমি সেই ছোট্ট ভোলাভালা মেয়েটি থেকে কঠিন আমি হয়েছি।

এই যে আমি এত সাহসী, এত স্পষ্টভাষী, এত নিষ্ঠুর, এত তেজি এটা আসলে একদিনে হইনি। আমাকে হতে হয়েছে। আর এই তেজি মেয়েটিকে যেই মানুষটা আরো বেশি সাহসি বানিয়েছে, সেই মানুষটি জাহিদ। সবাই জানে আমি জাহিদ বলতেই পাগল। আসলে সবাই সবটা জানে না।

জাহিদও হয়ত সবটা জানে না, এই তেজি, সাহসি আর নিষ্ঠুর মেয়েটা তাকে অসম্ভব ভালোবাসে। সেই যে আমার স্বপ্ন দেখা মানুষটি, যার জন্য আমি সব ছেড়ে দিতে পারি!!!

এরপর অনেক দিন গিয়েছে। এইসব ঘটনা আম্মুকে বলতে পেরেছি কিছুদিন আগে। অথচ আম্মুর ভীতসন্ত্রস্ত প্রথম প্রশ্ন ছিল, জাহিদকে বলেছিস নাকি?

আমি বললাম, কেন বলব না?

আম্মুর ভয়, জাহিদ জানলে কবে না জানি খোঁটা শুনাবে। যদি আমাকে ছেড়ে যায়।

আমি মনে মনে হাসলাম, পৃথিবীতে শুয়োর প্রজাতির পুরুষ ছাড়াও আরো এক প্রজাতির পুরুষ আছে। যারা এই ক্ষত-বিক্ষত, পঁচা দূর্গন্ধ সমাজ থেকে কয়েক মিলিয়ন মাইল দূরত্বে বসবাস করে।

হয়ত জাহিদ কোনকালে আমাকে ছেড়ে গেলেও যেতে পারে, হয়ত আমরা আলাদা হয়ে যেতেও পারি, সম্ভাবনা থাকতেও পারে, কিন্তু আমি জানি সেটা এই কারনে নয়। তবুও আমি জাহিদকেই ভালোবাসবো। ওকে সম্মান করব। এই যে আমাকে তুলতুলে মেয়ে থেকে কঠিন মেয়ে হতে সাহায্য করেছে, তার জন্য আমার সম্মান চিরকাল থেকে যাবে।

তারপরও আরো দিন গিয়েছে..... আমি জানি জাহিদ আমাকে সম্মান করে। এই যে আমি আজ মুখ ফুটে বলতে পেরেছি, তাতে জাহিদ আরো সম্মানিত বোধ করবে, ওর অর্ধাঙ্গী সাহসী। ওর গর্ব হবে, আর কোন পুরুষ নামক শুয়োর ওর প্রেমিকাকে ছুঁতে পারা তো দূরে থাক, চোখ দিয়ে কুদৃষ্টি ও দিতে পারবে না। পুরুষ নামক শুয়োর দের শাস্তি দেবার মত ক্ষমতা জাহিদের প্রেমিকার আছে।

এরপর আরো দিন যাবে, কোন মা ভয় পাবে না। কোন মা মেয়েকে চুপ করিয়ে দিবে না। তোর বরকে বলিস না বলে আদেশও দিবে না।

মায়েরা সন্তানের পাশে দাঁড়িয়ে ধর্ষকদের শাস্তি দিবে। এই সমাজ এই রাষ্ট্র সবাই ধিক্কার জানাবে, শাস্তি দিবে, ঘৃণা করবে তাদের ময়লা ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলবে। আমি জানি। আমি বেশ জানি।” 

আন্তর্জাতিক অঙ্গণ থেকে বাংলাদেশে #মি টু

২০০৬ সালে আফ্রো আমেরিকান সামাজিক আন্দোলনের কর্মী তারানা বুরকি নারী অধিকার নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নারীর উপর যৌন নিপীড়নের বিষয়ে প্রথমবারের মতো ‘মি টু’ ধারণার কথা বলেন, পরে একই নামে একটি প্রামাণ্যচিত্রও নির্মাণ করেন।

এরই ধারাবাহিকতায় পরে হলিউড অভিনেত্রী অ্যালিসা মিলানো প্রযোজক হার্ভে উইনস্টেইনের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে #মি টু আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। এরপর একে একে মুখ খুলতে থাকেন হলিউডের অভিনেত্রীরা। নীরবতা ভেঙে যৌন নিগ্রহের কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানান দিতে থাকেন নারীরা। 

সম্প্রতি এর ধাক্কা এসে লাগে ভারতেও। শুধু রুপালি জগতেই নয়, রাজনীতিসহ অন্যান্য মাধ্যমেও যৌন নিপীড়নের কথা মুখ ফুটে বলতে শুরু করেছেন তারা। সেই ঢেউ বাংলাদেশেও আছড়ে পড়া শুরু হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকে।