নীহার ভাবতেন ভাই, বাবু ভাবতেন প্রেমিকা
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী নীহার বানুর সহপাঠী আহমেদ হোসেন বাবুর বিয়ের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে নির্মমভাবে খুন করে পুঁতে ফেলা হয়েছিল। ভয়ংকর ঘটনাটি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছর পরেই ঘটে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এটিকে প্রথম আলোচিত অরাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বলে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে মিনা মঞ্জিল নামের বাড়িতে ১৯৭৬ সালের ২৭ জানুয়ারি খুন হন নীহার বানু। আর সেই বছর ১২ জুন তার লাশ উদ্ধার করা হয়। নীহারের লাশ উদ্ধারের সময় তার পায়ে থাকা স্যান্ডেলে লাল-সবুজের কারুকাজ তখনো বোঝা যাচ্ছিল। গলায় ঝুলছিল চারকোনা রুপার তাবিজ। সাড়ে চার মাসে নীহারের লাশ তখন কঙ্কালে পরিণত হয়েছে।
এ ঘটনায় ১৯৭৭ সালে নীহারের সহপাঠী আহমেদ হোসেন বাবুসহ তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। আহমেদ হোসেন বাবুর বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বানিয়াটিরি গ্রামে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে প্রধান আসামি বাবু ও আহসানুল পলাতক থেকে যান।
দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে ১৯৫৩ সালের ৯ জানুয়ারি নীহার বানুর জন্ম। তার বাবা নজীবুর রহমান ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহীদ হন। নজীবুর রহমান রাজশাহী কো-অপারেটিভ অফিসের সহকারী রেজিস্ট্রার ছিলেন।
পাঁচ বোন এক ভাইয়ের মধ্যে নীহার ছিলেন দ্বিতীয়। বাবার মৃত্যুর পর নীহারের বড় বোন মঞ্জিলা বেগম পরিবারের দেখাশোনা করতেন। তিনি ছিলেন পেশায় চিকিৎসক। বাড়ি দিনাজপুরে হলেও তাঁরা রাজশাহীতে থাকতেন। ১৯৭৬ সালে নীহার স্নাতকোত্তর পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। নওগাঁর এক প্রকৌশলীর সঙ্গে তার বিয়েও ঠিক হয়েছিল।
১৯৭৭ সালের জুলাইয়ে উত্তরাঞ্চলের একমাত্র বিশেষ সামরিক আদালতে নীহার হত্যার বিচারকাজ শুরু হয়। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনের ৩৬৪, ৩০২, ২০১ ও ৩৪ ধারা অনুযায়ী তদন্তকারী সিআইডি পরিদর্শক অভিযোগপত্র জমা দেন।
এতে অভিযুক্ত হিসেবে সাতজনের নাম উল্লেখ করা হয়। তারা হলেন ১. আহমেদ হোসেন বাবু (প্রধান আসামি), ২. মো. আহসানুল হক, ৩. মো. শহীদুল ইসলাম (নীলু), ৪. মো. এনামুল হক, ৫. মো. রুহুল আমীন (ফেতু), ৬. আজিজুর রহমান (আজু) ও ৭. ওয়াহেদুল ইসলাম।
এর মধ্যে বাবু ও আহসানুল ঘটনার সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। মো. শহীদুল ইসলাম একই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান তৃতীয় বর্ষ, এনামুল হক মনোবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষ এবং রুহুল আমীন (মিনা মঞ্জিলের কেয়ারটেকার) ভূগোল প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। আজিজুর ছিলেন রাজশাহী কলেজের অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। আর ওয়াহেদুল ছিলেন স্নাতক পাস।
তবে বিচারের শুরুতে সামরিক আদালতের চেয়ারম্যান বলেন, রাজশাহীর ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মামলার অন্যতম আসামি এনামুলকে ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। মামলার স্বার্থে এনামুলের আবেদনক্রমে সরকারপক্ষ এই আবেদন মঞ্জুর করে। পরে তাকে রাজসাক্ষী করা হয়। তার জবানবন্দিতে উঠে আসে হত্যাকাণ্ডের লোমহর্ষক বর্ণনা।
নীহার বানুর পরিবার এবং বাবু-নীহারের সহপাঠীদের বক্তব্যের ভিত্তিতে বিচিত্রার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভাগে বাবু ফুটবল, সাঁতার ও ওয়াটার পোলো খেলোয়াড় হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। বিভাগে তার প্রতিপত্তি ছিল। ভালো খেলে বিভাগের সুনাম বাড়ানোর জন্য মাঠে অনুশীলনের অনুরোধ জানাতে শিক্ষকেরা তার হল কক্ষ পর্যন্ত গিয়েছিলেন। শিক্ষকের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় কথিত সাজেশন পাওয়ার জন্য বিভাগের অন্য শিক্ষার্থীরা আবার বাবুকে সমীহ করে চলতেন।
নীহারের স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষার আগে তার হাম হয়েছিল। প্রস্তুতি ভালো ছিল না। তাই তিনি পরীক্ষা না দেওয়ার কথা ভাবছিলেন। এমন অবস্থায় নোট আর সাজেশন পেতে বাবুর শরণাপন্ন হয়েছিলেন নীহার। বাবুও তাকে নোট আর সাজেশন দিয়ে সহযোগিতা করেন। ওই পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর নীহারের পরিবারের সঙ্গেও বাবুর ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। নীহারের মাকে তিনি মা বলে ডাকতেন, বড় বোনকে ধর্ম বোন বলতেন।
আরও পড়ুন: ঘুমের মধ্যে না ফেরার দেশে রাবি ছাত্র
আদালতে প্রমাণিত হয়েছে, বাবুর সঙ্গে নীহারের ভাই-বোন ছাড়া ভিন্ন কোনো সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু একসময় শুধু বাবুই একতরফা নীহারকে প্রেমিকা ভাবতে শুরু করেন এবং বিয়ের প্রস্তাব দেন। নীহার এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
তখন বাবু বলেছিলেন, তিনিও আসলে বোনই মনে করেন, কিন্তু নীহারকে পরীক্ষা করার জন্য এমনটা বলেছেন। এমনটা আরও কয়েকবার হয়েছে। বাবু বিয়ের প্রস্তাব দিতেন, নীহার প্রত্যাখ্যান করতেন। প্রত্যাখ্যাত হয়ে বাবু বলতেন, তিনি এমনি এমনি কথাটা বলেছেন। তিনিও আসলে নীহারকে বোনই মনে করেন।
তবে এরপরও ক্যাম্পাসে বাবুর সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক রেখেছিলেন নীহার। বাবু প্রভাবশালী হওয়ায় নীহারের পরিবার তাকে রাগাতে চায়নি। রাজসাক্ষীর বিবরণ অনুযায়ী, হত্যার আগমুহূর্তেও বাবুর বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন নীহার। বলেছিলেন, ‘আপনি এসব কী বাজে কথা ও আবোলতাবোল বলছেন? আপনার সঙ্গে আমার ভাই-বোনের সম্পর্ক।’
১৯৭৭ সালের ২৮ জুলাই নীহার হত্যা মামলার নবম দিনের শুনানিতে রাজসাক্ষী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের ছাত্র এনামুল হক মিনা মঞ্জিলে নীহারকে হত্যার সেই লোমহর্ষক ঘটনা বর্ণনা করেন।
এনামুল বলেন, ১৯৭৬ সালের ২৩ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব আব্দুল লতিফ হলে আহমেদ হোসেন বাবুর কক্ষে একটি বৈঠক হয়েছিল। এনামুল ও বাবু ছাড়াও ওই বৈঠকে বাবুর সহপাঠী আহসানুল এবং বিভাগের ছোট ভাই শহীদুলও উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ২৫ জানুয়ারি নীহারকে দাওয়াত খেতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে মিনা মঞ্জিলে নিয়ে যেতে হবে। সেখানে বাবুর সঙ্গে তার বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হবে। স্বেচ্ছায় রাজি না হলে জোর করে বিয়ে পড়ানো হবে।
এনামুলের ভাষ্য অনুযায়ী, বাবু প্রায়ই নীহার বানু সম্পর্কে তাদের সঙ্গে গল্প করতেন। কিন্তু নীহারকে যে তিনি বিয়ে করতে চান, তা তিনি বলতে পারতেন না। নওগাঁর এক প্রকৌশলীর সঙ্গে নীহারের বিয়ে ঠিক হওয়ার পর বাবু এনামুলকে তার ইচ্ছার কথা জানান। তাদের সহযোগিতা চান।
বাবু বলেছিলেন, নীহারের অন্য কোথাও বিয়ে হয়ে গেলে তা তিনি সহ্য করতে পারবেন না। তার জীবন বৃথা হয়ে যাবে। ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় নিউমার্কেটে বাবু নীহারকে বানিয়ে বানিয়ে বলেছিলেন, ২৫ জানুয়ারি তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে দাওয়াত আছে। নীহারকে সেখানে যেতে হবে।
নীহার বলেছিলেন, ‘দেখা যাবে।’ তবে ২৫ জানুয়ারি নীহার সারদায় বিভাগের পিকনিকে চলে যান। তা শুনে রেগে যান বাবু। পরেরদিন ২৬ জানুয়ারি লতিফ হলে বাবুর কক্ষে আবারও বৈঠক হয়।
এ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, যেকোনোভাবে হোক নীহারকে মিনা মঞ্জিলে নিয়ে যেতে হবে। সেখানে তাকে জোর করেও যদি বিয়েতে রাজি না করানো যায়, তাহলে তাকে মেরে ফেলা হবে। কেন মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, তা আদালতের পক্ষ থেকে এনামুলের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল।
এনামুলের ভাষ্য, বাবু বলতেন, নীহারকে বিয়ে করতে না পারলে তিনি বাঁচবেন না। নীহার অন্য কাউকে বিয়ে করবে, তা তিনি সহ্য করতে পারবেন না।
১৯৭৬ সালের ২৭ জানুয়ারি দুপুরে বাবু ও নীহার দুটি আলাদা রিকশায় করে মিনা মঞ্জিলে পৌঁছান। সেখানে আগে থেকে অপেক্ষা করছিলেন এনামুল, আহসান ও শহীদুল ইসলাম নীলু। নীহার আর বাবু ঢোকার পরপরই মিনা মঞ্জিলের প্রধান ফটক বন্ধ করে দেওয়া হয়। ঘরের দরজা-জানালাও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
এরপর বাবু নীহারকে বিয়ের প্রস্তাব দেন। নীহার তখন রেগে গিয়ে বলেন, ‘আপনি এসব কী বাজে কথা ও আবোলতাবোল বলছেন? আপনার সঙ্গে আমার ভাই-বোনের সম্পর্ক। আপনি আবার যদি ও কথা বলেন, আমি চিৎকার করব।’
নীহার এ কথা বলার পর তার পরনের শাড়ির আঁচল দিয়ে বাবু তার গলা পেঁচিয়ে ধরেন এবং বলতে থাকেন, ‘এখনো রাজি হও। না হলে এখান থেকে আর ফিরে যেতে দেব না।’ অসম্মতি জানালে বাবু আরও জোরে জোরে নীহারের গলায় শাড়ি প্যাঁচাতে থাকেন। একপর্যায়ে বাবুর হাত কামড়ে দেন নীহার।
এরপর এনামুল, আহসান ও শহীদুল মিলে নীহারের হাত চেপে ধরে রাখেন, যেন তিনি নড়াচড়া না করতে পারেন। বাবু তখন আরও জোরে জোরে শাড়ি প্যাঁচাতে থাকেন। শ্বাসরোধ হয়ে নীহার মেঝেতে ঢলে পড়েন।
এনামুলের বর্ণনা অনুযায়ী, ওই সময় নীহারের পরনে ছিল খয়েরি রঙের চেক শাড়ি, বাটার হাই হিল স্যান্ডেল, নীল কোট, হলুদ ব্লাউজ এবং কালো পেটিকোট। বাঁ হাতে ছিল ঘড়ি। চুল ছিল লম্বা বেণি করা। গলায় ছিল চারকোনা রুপার তাবিজ। দুই কানে ছিল ছোট দুল। [সূত্র: প্রথম আলো]