পরিচয় লুকাতে পায়েলের মুখ থেঁতলে দেওয়া হয়
সাইদুর রহমান পায়েলের পরিচয় লুকাতে, হানিফ পরিবহনের বাস কর্মীরা অচেতন অবস্থায় সেতু থেকে খালে ফেলে দেওয়ার আগে তার মুখ থেঁতলে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেছে তার পরিবার।
ওই বাসের সুপারভাইজার মো. জনি গ্রেপ্তার হওয়ার পর থানায় তার সঙ্গে কথা বলেন পায়েলের মামা গোলাম সরওয়ার্দী বিপ্লব। জনি বিপ্লবের কাছে ওই ঘটনার বর্ণনা দেন।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ পঞ্চম সেমিস্টারের ছাত্র পায়েলের বাসা চট্টগ্রামের হালিশহর সিডিএ আবাসিক এলাকায়। শনিবার রাতে দুই বন্ধু আকিবুর রহমান আদর ও মহিউদ্দিনের সঙ্গে হানিফ পরিবহনের একটি বাসে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার পথে রওনা হওয়ার পর নিখোঁজ হন তিনি।
সোমবার মুন্সিগঞ্জ উপজেলার ভাটেরচর সেতুর নিচের খাল থেকে পায়েলের লাশ উদ্ধার করে গজারিয়া থানা পুলিশ। হানিফ পরিবহনের ওই বাসের সুপারভাইজার জনিকে ঢাকার মতিঝিল এবং চালক জামাল হোসেন ও তার সহকারী ফয়সাল হোসেনকে আরামবাগ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পরে তারা তিনজনই মুন্সীগঞ্জের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
সেই জবানবন্দির বরাতে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, গজারিয়া এলাকায়গাড়ি যানজটে পড়ায় প্রসাব করার কথা বলে বাস থেকে নেমেছিলেন পায়েল। বাস চলতে শুরু করলে তিনি দৌড়ে এসে ওঠার সময় দরজার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে সংজ্ঞা হারান। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বের হতে দেখে তাকে হাসপাতালে নেওয়ার বদলে দায় এড়াতে ভাটেরচর সেতু থেকে নিচের খালে ফেলে বাস নিয়ে ঢাকায় চলে আসেন চালক ও সুপারভাইজার।
শনিবার পায়েল নিখোঁজ হওয়ার পর সোমবার লাশ উদ্ধার পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় চষে বেড়ান তার মাম বিপ্লব।
তিনি বলেন, গজারিয়া থানা পুলিশ ভাটেরচর সেতুর নিচে খাল থেকে পায়েলের লাশ উদ্ধার করার পর তার প্রথমে তার থেঁতলানো মুখ দেখে চিনতে পারেননি তিনি।
“পরে পায়েলের পরনের শার্ট দেখে আমার ছোট ভাই দিপু জানায় গত ঈদে ও শার্টটা পায়েলকে দিয়েছিল। এরপর ওর আইডি আর লন্ড্রির স্লিপ দেখে আমরা লাশ শনাক্ত করি।”
বিপ্লব বলেন, বাসের সুপারভাইজার জনি ও হেলপার ফয়সাল গ্রেপ্তার হওয়ার পর থানায় তাদের সঙ্গে কথা বলে ‘ঘটনার পুরো বিবরণ’ তারা জানতে পারেন।
জনির বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ভাটেরচর সেতুর আগে বাস যানজটে পড়লে চালককে বলে গাড়ি থেকে নামেন পায়েল। তিনি ফেরার আগেই বাস সামনের দিকে এগিয়ে যায় এবং সেতুর ওপর উঠে দাঁড়ায়।
পায়েল দৌড়ে এসে দরজার কাছে দাঁড়ালে চালক ভলভো গাড়ির দরজা খুলতে সুইচ টিপে দেন। কিন্তু দরজা খোলার সময় ধাক্কা লেগে পায়েল নাকে-মুখে আঘাত পান এবং পড়ে যান।
বিপ্লব বলেন, “পায়েলের নাক-মুখ থেকে রক্ত ঝরতে দেখে চালক কিছুটা সামনে এগিয়ে যায়। এরপর আবার থামে। তখন সুপারভাইজার পায়েলকে দেখে এসে চালককে বলে- ‘ওস্তাদ অজ্ঞান হয়ে গেছে, উঠাই নিব?’
“তখন জামাল হোসেন চালকের আসন থেকে উঠে এসে বলে- ‘বিপদে পড়ে যাবি’। তারপর নিজেই পায়েলের মাথার দিকে অংশ ধরে এবং সুপারভাইজারকে পায়ের দিকের অংশ ধরতে বলে। এরপর পায়েলের মুখমণ্ডল রাস্তায় আছড়ে ফেলে। তারপর সেতু থেকে নিচে পানিতে ফেলে দেয়।”
রোববার সকালে পায়েলের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি জানার পর পরিবারের পক্ষ থেকে খোঁজ খবর শুরু করলে চালক ও সুপারভাইজার মিথ্যা তথ্য দিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করেন বলেও অভিযোগ করেন বিপ্লব।
তিনি বলেন, শনিবার রাতে পায়েল রওনা হওয়ার পর রোববার সকালে তার মা কোহিনুর বেগম ছেলের মোবাইলে ফোন করলে তা ধরে পাশের সিটের থাকা তার বন্ধু আদর। সে জানায় পায়েল গাড়িতে নেই।
“বাসের সুপারভাইজার জনির সাথে যোগাযোগ করা হলে সে প্রথমে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানার মদনপুর গ্রামের ক্যাসেল হোটেলের সামনে এক জায়গার কথা বলে। জনি বলেছিল, ওইখানেই প্রসাব করার কথা বলে পায়েল গাড়ি থেকে নেমেছিল। পরে যানজটমুক্ত হয়ে বাসটি সামনের দিকে এগিয়ে গেলে পায়েল আর গাড়িতে উঠতে পারেনি।”
জনির কথায় রোববার দুপুরে নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানায় গিয়ে ভাগ্নের নিখোঁজ থাকার কথা জানিয়ে জিডি করেন বিপ্লব। কিন্তু সোমবার গজারিয়া থানার ওসি হারুন অর রশীদ ভাটেরচর সেতুর নিচে লাশ উদ্ধারের খবর দেন।
বিপ্লব বলেন, জনি তাকে প্রথমে যে জায়গায় লাশ পাওয়ার কথা বলেছিলেন, সেই জায়গা আসল ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে।
পায়েলের আরেক মামা কামরুজ্জামান বলেন, রোববার সকাল ১০টা পর্যন্ত পায়েলের ফোন না পাওয়ায় তারা ফোন নম্বর যোগাড় করে গাড়ি চালক জামাল হোসেনকে ফোন করেছিলেন।
“সে আমাদের সাথে কোনো কথাই তখন বলেনি। শুধু বলেছে, ‘আপনাদের ভাগ্নে গাড়ি থেকে নেমে গেছে। পরের গাড়িতে ঢাকা আসবে। আপনারা পরিবহনের লোকজনের সাথে যোগাযোগ করেন’।”
খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি চান পায়েলের বাবা
পায়েলের বাবা গোলাম মাওলা ২৬ বছর ধরে কাতারের দোহায় চাকরি করেন। বড় ছেলে গোলাম মোস্তফাও সেখানে থাকেন। পায়েলের মৃত্যু খবর পেয়ে দেশে ফিরেছেন তারা দুজন।
বড় ভাই গোলাম মোস্তফার মেয়ে হওয়ার পর তাকে দেখতে চট্টগ্রামে বাসায় ফিরেছিলেন পায়েল। রোববার ক্লাস থাকায় শনিবার রাতের বাসে করে ফিরছিলেন ঢাকায়।
পায়েলের বাবা গোলাম মাওলা বলেন, রোববার ভোরে ঢাকায় পৌঁছে মাকে ফোন দেওয়ার কথা ছিল তার ছেলের। কিন্তু সেই ফোন আর আসেনি।
“পায়েলের মা বলেছিল, ‘বাবা নামাজের পর ফোন দিয়ে তুমি ঘুমিও’। পায়েল বলেছিল- ‘মা সাড়ে নয়টায় ক্লাস আছে। নামাজ পড়ে আর ঘুমাতে পারব না’।”
ছেলের মৃত্যুর পর থেকে পায়েলের মা কোহিনূর বেগম শুধু সেই কথাই মনে করছেন জানিয়ে গোলাম মাওলা বলেন, “আমার ছেলেটার তো কোনো অপরাধ ছিল না। তাকে কেন এভাবে খুন করা হল? নাক-মুখ থেকে রক্ত পড়ছিল বলে কি কেউ একটা মানুষকে পানিতে ফেলে দিতে পারে? যারা আমার ছেলেকে খুন করেছে তারা তো মানুষ না।”
গোলাম মাওলা বলেন, নাতনির জন্মের পর ভিডিও কল করে পায়েলকে দেখাতে চেয়েছিল তার মা। পায়েল বলেছিল বাড়ি এসে সামনাসামনি দেখবে।
“শনিবার পায়েল বাসা থেকে যাওয়ার সময় আমার নাতনি ঘুমে ছিল। ঘুমন্ত ভাতিজিকে আদর করে বাসা থেকে বের হয় পায়েল। ভাইকে বলেছিল, তার সাথে মিলিয়ে ভাতিজির নাম রাখতে।”
চট্টগ্রামের মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এএসসি এবং সানশাইন কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় পাস করা পায়েলকে অষ্ট্রেলিয়ায় পড়তে পাঠাতে চেয়েছিলেন তার বাবা।
“অষ্ট্রেলিয়া যাওয়ার কাগজপত্রও যোগাড় হয়েছিল। মাঝপথে সে বলে- যাবে না। চট্টগ্রামে যেহেতু আমি আর বড় ছেলে থাকি না, তাই তাকে এখানে পড়তে বলেছিলাম। সে নিজের পছন্দে ঢাকায় পড়তে যায়।”
দোষীদের শাস্তি দাবি করে পায়েলের বাবা বলেন, “এভাবে যেন আর কারও সন্তানের মৃত্যু না হয়। খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই আমি।”