১৭ মে ২০২৩, ০৮:২৬

রুমমেটের বর্ণনায় বিসিএস ক্যাডার রাসেলের মৃত্যুর আগে যা ঘটেছিল

নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক রাসেল আহমেদ  © সংগৃহীত

কুমিল্লার লাকসামের নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রভাষক ছিলেন রাসেল আহমেদ। তিনি রোববার (১৪ মে) রাতে হঠাৎই হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ইন্তেকাল করেন। এ সময় ১৯২তম বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের অফিস সংযুক্তির অংশ হিসেবে বগুড়া আরডিএ’তে ছিলেন ৩৮তম বিসিএসের কর্মকর্তা (সাধারণ শিক্ষা) রাসেল।

রাসেল আহমেদের রুমমেট ছিলেন মো. শাহ পরান তারেক। তিনি ঘটনার সময়ের বর্ণনা দিয়েছেন এক ফেসবুক পোস্টে। সেটি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-

রাসেল ভাইয়ের কী হয়েছিল?

রাসেল ভাইয়ের বন্ধু-বান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী অনেকেই এই প্রশ্ন করেছেন কমেন্টে/ইনবক্সে। তাই একটা পোস্ট লিখে রাখছি। সময়গুলো একদম কাঁটায় কাঁটায় নাও মিলতে পারে, তবে খুব কাছাকাছি হবে। ওই সময় তো ঘড়ি দেখা যায় না। আরও সঠিক সময় পেলে এডিট করে দেব। এজন্য এই পোস্টটা কয়েকবার এডিট হতে পারে।

আমি তার পূর্বপরিচিত। কাঁচিঝুলি মোড়ে, স্টেশনে আড্ডা দিয়েছি। বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে তার রুমমেট না হলেও সব সময় তার রুমেই শুয়ে-বসে থাকতাম। লাঞ্চ, ডিনার, আড্ডা, ক্লাসে একসাথে বসা, ময়মনসিংহে যাওয়া থেকে সব সময় তার সাথেই থাকতাম। বগুড়ায় রুমমেট ছিলাম। সে আমার বড়ভাই ছিলেন, বন্ধুও ছিলেন। আমাকে অনেক ভালোবাসতেন। ঘটনার রাতে আমি তার পাশে ছিলাম।

১৪ মে রাত ৯.০০
ভাই আর আমি একসাথে ডিনার করলাম। এরপর চায়ের দোকানে গেলাম। তারপর ভাই গেলেন গেমস্ রুমে টেবিল টেনিস খেলতে। আমি কিছুক্ষণ খেলা দেখে আবার ক্যাফেটেরিয়াতে গেলাম রাহাত আর খসরুর কল পেয়ে। কালচারাল কমিটিতে নাটকে অভিনয় করার কথা বললো। আমি রাজি হলাম। তারপর আবার দোকানে গেলাম।

রাত ১০.০৫
রাসেল ভাই কল দিয়ে বললেন দুইটা স্যালাইন নিয়ে আসতে। মোবাইলে আর কিছু বলেননি। টেবিল টেনিস খেলার সময়ই তার একটু একটু ব্যথা শুরু হয়েছিল। তাই সে রুমে এসে পড়েছিল। তার কাছে চাবি ছিল না। আমাকে কল দিলেন। তার ব্যথা খুব সম্ভবত ২০-২৫ মিনিট আগে রাত ৯.৪০ এর দিকে শুরু হয়েছিল। তবে শুরুতে ব্যথা খুব বেশি ছিল না।

রাত ১০.১০
এসে দেখি পাশের রুমে দুইজন তার ঘাড়-পিঠ টিপে দিচ্ছে। শুনলাম সে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। আমিও একটু টিপে দিলাম। তারপর আমরা রুমে গেলাম।

রাত ১০.১৫
ভাই গোসলে ঢুকলেন। খুব দ্রুত গোসল থেকে বের হয়ে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। আমার মনে হলো তখন তার একটু ভালো লাগছে। ২/৩ মিনিট পরেই এপাশ-ওপাশ কাত হতে থাকলেন বিছানায়। আমি বললাম- ভাই, আপনার কি বেশি খারাপ লাগছে? সে বললো, হ্যাঁ। সাথে সাথে আমি বাইরে গিয়ে কয়েকজনকে রুমে ডেকে আনলাম। প্রায় সব ফ্লোরে আমি আর সাদ্দাম ভাই পাগলের মত গিয়ে ডাক্তার খুঁজেছি। পাচ্ছিলাম না।

ডাক্তারদের প্রশিক্ষণ চলছে আরডিএ তে। কিন্তু ডাক্তাররা একটা প্রোগ্রামে গিয়েছিল শুনলাম। একজন মেয়ে ডাক্তার পেলাম। আবাসিক বিল্ডিং এ পুরুষ রোগীকে দেখতে যাবেন না, একজন পুরুষ ডাক্তারকে কল দিয়ে আসতে বললেন। সে অবশ্য খুব দ্রুত এসেছিলেন। আর অন্যান্য অনেক প্রশিক্ষণরত ডাক্তারও এসে পড়েছিলেন।

রাত ১০.২৫
স্যারদেরকে কল দেয়া হলো। অ্যাম্বুলেন্স কল করা হলো। এর মধ্যে ভাইকে সবাই মিলে লিফটে করে নিচতলায় এনে আমরা বসালাম। সে বললো, খুব গরম লাগছে। গায়ের জার্সি খুলে দিলাম।

রাত ১১.৩০
অ্যাম্বুলেন্সে এলো। ভাইকে নিয়ে আমরা চারজন এবং আরডিএ মেডিকেলের একজন রওয়ানা দিলাম শহীদ জিয়াউর রহমান হাসপাতালের দিকে।

১৫ মে রাত ১২.১০
হাসপাতালে পৌঁছালাম। ইমার্জেন্সি থেকে সিসিইউতে যেতে বললো।

আরও পড়ুন: প্রশিক্ষণ চলাকালে না ফেরার দেশে বিসিএস কর্মকর্তা রাসেল

রাত ১২.২০
সিসিইউতে নিয়ে গেলাম। প্রেসার মাপলো ১১০-১৪০। ইসিজি করলো। রিপোর্ট বুঝি না। ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি এড়িয়ে গিয়ে রোগীকে বেডে শুইয়ে দিতে বললেন।

রাত ১২.৩০
প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন। আধা হাঁটা, আধা দৌড় দিয়ে আমি আর আরডিএ মেডিকেলের লোকটা (সে খুব আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেচগে) ওষুধ নিয়ে এলাম খুব দ্রুত।

১২.৪০
ভাইকে মুখে পানি দিয়ে ডাক্তারের বলা অনেকগুলো ওষুধ মুখে ঢুকিয়ে দিলাম। এরপর ইঞ্জেকশন দেয়া হলো। ডাক্তার বললেন, এখনি ঘুমিয়ে পড়বে।

১২.৫৫
ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম- আপনার ঘুম আসছে না? সে বললো- না।

রাত ১.০০
শ্বাসকষ্ট শুরু হলো। নার্স অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে দিলো। সে দেরি করেনি।

রাত ১.১০
শ্বাস বন্ধ হয়ে গেলো। হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। আমার আরেকজন প্রিয় মানুষ চলে গেলেন। চোখ বন্ধই ছিল। মুখ একটু হা করা ছিল। হাত দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিলাম। এরপর অনেকবার মাথা বুলিয়ে দিয়েছি আর হাত ধরেছি। গা ঠাণ্ডা হয়ে ছিল। তবে দেখে মনে হচ্ছিল সাধারণভাবে ঘুমাচ্ছে, অন্য সময় যেভাবে রুমে ঘুমায়।

আরেকটা কথা, আগে রাসেল ভাইয়ের হার্টের কোন সমস্যা জানা ছিল না। তবে কয়েকদিন আগে একদিন বিকালে তিনি বলেছিলেন পিঠে ব্যথা করছে। আর ঘটনার রাতে প্রথমে পিঠে, তারপর দুইহাত, শেষে বুকে ব্যথা শুরু হয়েছিল। তবে রাত ১টার আগে কোন শ্বাসকষ্ট ছিল না।

উল্লেখ্য, ৩৮তম বিসিএসের (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার রাসেল আহমেদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ২০০৭-০৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে থাকতেন। তিনি ফুলপুর পাইলট হাইস্কুল ও ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করেন।