১৯ মার্চ ২০২৩, ১২:৩৯

পড়ালেখা করেছেন অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত, আরাভের উত্থানের গল্প বিস্ময়কর

আরাভ খান  © সংগৃহীত

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার রবিউল ইসলাম ভারতে গিয়ে নাম পরিবর্তন করে হয়ে যান আরাভ খান। পুলিশ বলছে, এই আরাভ খানই মূলত ঢাকার স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যা মামলার পলাতক আসামি। তিনি এখন দুবাইয়ের বড় স্বর্ণ ব্যবসায়ী। হঠাৎই বড় ব্যবসায়ী বনে যাওয়া আরাভের উত্থানের গল্প বিস্ময়কর।

দরিদ্র পরিবারের সন্তান আরাভ খান গ্রামবাসীর কাছে পরিচিত রবিউল ইসলাম ওরফে আপন নামে। কীভাবে তার নাম পাল্টে ‘আরাভ খান’ হলো এ নিয়েও গ্রামবাসীর মধ্যে কৌতূহলের শেষ নেই। শুধু তাই নয়, অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা যায়নি আরাভ খানের বাবা-মা বা অন্য কোনো আত্মীয়-স্বজনের কাছেও। 

এলাকাবাসী জানান, আশুতিয়া গ্রামে আপনের কেউ এখন আর থাকেন না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলেছেন, আপন অবৈধভাবে এই অর্থ-সম্পদ অর্জন করে থাকলে তাকে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করা উচিত।

সরেজমিনে আশুতিয়া গিয়ে দেখা যায়, সেখানে আপনদের পাকা দেয়ালের টিন শেডের একটি ঘর রয়েছে। ঘরের দরজায় তালা দেয়া। এদিক-ওদিক খোঁজ করেও পাওয়া যায়নি তার কোনো আত্মীয় স্বজনকে। কথা হয় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আতীয়ার রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, পত্রিকায় তাকে (আরাভ খান) নিয়ে যে প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে, তা পড়ার পর আপনাদের সঙ্গে কথা বলাটা বিব্রতকর।

আরও পড়ুন: দুবাই গেলেও অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী মঞ্চে উঠেননি সাকিব

এরপর এই প্রতিবেদকের কয়েকটি প্রশ্নের জবাবে আতীয়ার রহমান বলেন, ‘আপনের বাবা মতিউর রহমান মোল্লা একসময় খুলনায় ফেরি করতেন। পরে জীবিকার প্রয়োজনে তিনি কোটালীপাড়া চলে আসেন। এরপর কৃষিকাজ ও মাছ ধরাই ছিল মূলত তার পেশা। পরে এখানে তিনি জমি কিনে বাড়ি করেন।

আতীয়ার জানান, তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার বড় ছিল আপন। লেখাপড়ায় সে ছিল অমনোযোগী। যতদূর জানি অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সে পড়ালেখা করেছে। এরপরই জড়িয়ে পড়ে নানা অপকর্মে। পরে তাকে ঢাকা পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেটাও ১৮-১৯ বছর আগে। এই বাড়িতে আপন স্ত্রী-সন্তান শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে থাকতেন। তবে কয়েক মাস হলো বাড়িতে তাদের কাউকেই দেখা যাচ্ছে না।

৩৫ বছর বয়সী আরাভ তিন ভাই-বোনের মধ্যে বড়। তার বাবা জীবিকার তাগিদে যুবক বয়সে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় এসেছিলেন। সেখানে সিলভারের হাঁড়ি-পাতিল কাঁধে বহন করে ফেরি করতেন। সংসারের অভাব দেখে ঢাকায় চলে আসে আরাভ।

এরপর মূলতঃ উচ্চবিত্ত শ্রেণির নারীদের টার্গেট করতে থাকে সে। বিয়ে করেন একাধিক। ৫-৭ জন নারী এলাকায় তার স্ত্রী দাবি করেছিলেন। এ নিয়ে নানা সময়ে সালিশও হয়।

স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রায় ১০ বছর আগে আরাভ নিজের টাকায় গ্রামে একটি পাকা ওয়ালের টিনশেড বাড়ি করেন। সেখানে আরাভের একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তার বাবা-মা বসবাস করতেন। গ্রামের বাড়ি গেলে বড় অংকের অর্থ খরচ করে বিভিন্ন উৎসবের আয়োজন করতেন। দুবাইয়ে তার স্বর্ণের দোকান উদ্বোধনের আগেই একমাত্র ছেলে, বাবা-মা এবং দুই বোনকে সেখানে নিয়ে যায়। বর্তমানে তাদের গ্রামের বাড়ি ফাঁকা। আরাভের বিরুদ্ধে একাধিক মামলায় তার মা এবং দুই বোনকেও আসামি করা হয়।

স্থানীয় হিরণ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাজহারুল আলম পান্না বলেন, আরাভ ওরফে সোহাগের ১৫টিরও বেশি বিয়ের তথ্য আমরা জেনেছি। স্থানীয়ভাবে প্রায় ৫-৭ জন নারী বিয়ের অভিযোগ এনে নালিশ করলে সেটা আমি মীমাংসা করে দেই। সম্প্রতি ওমরাহ্‌ হজ করতে গেলে সেখানে এলাকার লোকজন আমাকে সংবর্ধনা দিতে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আরাভও এসেছিলেন। এরপর তিনি সেখানে প্রায় আধাঘণ্টার মতো অবস্থান করে চলে যান।

আরও পড়ুন: সাকিবকে ধন্যবাদ জানালেন হত্যার আসামি আরাভ খান

তিনি বলেন, দুবাইতে তার স্বর্ণের দোকান উদ্বোধনের আগে আমাকে ফোন দিয়ে সেখানে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানায়। অনুষ্ঠানে ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানসহ অন্য তারকারা উপস্থিত থাকবেন বলে আমার জন্য দুবাই ভ্রমণের টিকেট পাঠাতে চাইলে আমি অস্বীকৃতি জানাই। জনপ্রতিনিধি হওয়ার কারণে আরাভকে বরাবরই এড়িয়ে চলতাম।

মাজহারুল আলম বলেন, সম্প্রতি তার বিরুদ্ধে একের পর এক সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরে তার বাড়িতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- বাবা-মা, ছেলে এবং দুই বোনকে দুবাই নিয়ে গেছেন। এর কিছুদিন আগে আমার স্ত্রীর সঙ্গে ওর মায়ের কথা হয়। এ সময় তিনি জানান, আমরা বিদেশ চলে যাবো। ছেলের কাছে দুবাই যাবো। এর কিছুদিন পর দেখি ফাঁকা বাড়ি। কেউ নেই। সম্ভবত তারা ছেলের কাছেই আছেন। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের সময় আরাভ এলাকায় এসেছিলেন। এরপর আর তিনি বাড়ি আসেননি।

পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) পরিদর্শক মামুন ইমরান খানকে ২০১৮ সালে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। সেই হত্যা মামলার ৬ নম্বর আসামি রবিউল ইসলাম আপন ওরফে আরাভ খান। এ ঘটনায় তার ভাই ডিএমপির বনানী থানায় ২০১৮ সালের ১০ জুলাই একটি মামলা করেন। ওই মামলায় ২০১৯ সালে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশ। মামলার এজাহার অনুযায়ী আরাভের আসল নাম রবিউল ইসলাম আপন ওরফে সোহাগ ওরফে হৃদয়। আরাভ অবশ্য এক ফেসবুক লাইভে এ হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।