শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদকের অপব্যবহার বেড়েছে
১. রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তামিম হোসাইন (ছদ্মনাম)। করোনার প্রাদুর্ভাবে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ যখন দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় তখনই তার পড়াশোনার অস্তমিত ঘটে। পরিবারের হাল ধরে রাখা বাবার চাকরি চলে যাওয়ায় তিনি পড়ে যান বেকায়দায়। ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে হয় গ্রামের বাড়িতে। পরবর্তীতে লকডাউন শিথিল হলেও তামিমের পড়াশোনা আর শুরু করা হয়নি। পরিবারের হাল ধরতে হন্য হয়ে খুঁজছেন চাকরি। এখনও চাকরি মেলেনি, তবে পড়েছেন মরণ নেশা মাদকের ফাঁদে।
তামিম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, লকডাউন শিথিল হওয়ার পর একটি চাকরির খোঁজে ঢাকায় এসে মেসে উঠি। হতাশাগ্রস্ত অবস্থা দেখে এক রুমমেট বলে একটু (ইয়াবা) নিয়ে শুয়ে পর। প্রথমবার না করে দিলাম। তবে একটা চাকরি না হওয়া পর্যন্ত শান্তি মিলছিল না। কিছুদিন পরে ওই রুমমেটকে বলি, ভাই একটু দেন। পরে ওই ভাই ইয়াবা কিভাবে নেয় শিখিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে মাথায় ঝাঁকুনি অনুভব করে শুয়ে পরি। এভাবেই আমার জীবনে নেশার হাতের খড়ি।
তিনি আরও বলেন, এখন ফুড ডেলেভারির একটা কাজ করি তবে নেশা ছাড়তে চেয়েও পারছি না। মাস শেষে বাড়িতে কিছু টাকা পাঠিয়ে যা থাকে তা ইয়াবা কিনতেই চলে যায়। আমার শরীর আর আগের মতো নেই। প্রায়ই জ্বর আসে। রাতে উদ্ভট স্বপ্ন দেখি।
২. গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র হাফিজুর রহমানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় তার তিন বন্ধু ‘এলএসডি’ সেবন করান। এর প্রতিক্রিয়া শুরু হলে তিনি শুধু একটি শর্টস পরে সেখান থেকে বেরিয়ে যান। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে এক ডাব বিক্রেতার ভ্যানে রাখা দা নিয়ে তিনি নিজের গলায় আঘাত করেন। সুরতহাল প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ঘটনার দিন রাত ৯টা ৪০ মিনিটে অজ্ঞাতনামা হিসেবে তার মৃত্যু হয়। এর ৮ দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে হাফিজুরের ভাই তার লাশ শনাক্ত করেন। পরে তার মৃত্যুর ঘটনায় তদন্তে নেমে এলএসডি নামে একটি নতুন মাদকের সন্ধান পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এরপর এই মাদকসহ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তিন শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
শুধু তামিম আর হাফিজুর নয়। সারাদেশে তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাদকের অপব্যবহার বেড়েছে। করোনার কারণে ২০২০ সালের শুরু থেকে দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাকালীন অনলাইন ক্লাসের কারণে তাদের প্রায় সবার হাতে হাতে ছিল মোবাইল, ছিল ইন্টানেট সংযোগের সহজলভ্যতা। একদিকে ঘরবন্দি, অন্যদিকে বেকারত্ব বাড়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে আচরণগত বেশ পরিবর্তন আসছে। ফলে ব্যর্থতার গ্লানি, একঘেয়েমি ও একাকীত্বের কারণে অনেকেই মাদকের দিকে ঝুঁকছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
দেশে মাদকসেবীর সংখ্যা কত, এ সংক্রান্ত কোনো সমীক্ষা নেই মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) কাছে। সংস্থাটির সবশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন-২০২১ এ বলা হয়েছে, ডিএনসির চারটি সরকারি কেন্দ্রে ১০ হাজার ১৪ জন চিকিৎসা নেন। এছাড়াও একই বছরে বেসরকারি মাদকাশক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ৯ হাজার ৮৭৬ জন চিকিৎসা নেন।
এর আগের বছর অর্থ্যাৎ ২০২০ সালে চারটি সরকারি কেন্দ্রে ১৪ হাজার ৯৯২ জন চিকিৎসা নেন। আর বেসরকারি মাদকাশক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ১৫ হাজার ১৮১ জন চিকিৎসা নেন। আর চলতি বছরের জুন পর্যন্ত চারটি সরকারি কেন্দ্রে ৯ হাজার ৯০৪ জন চিকিৎসা নেন। এছাড়াও একই বছরে বেসরকারি মাদকাশক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ৮ হাজার ৮৩০ জন চিকিৎসা নেন।
অন্যদিকে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ বাষিক ড্রাগ প্রতিবেদন (২০২০) বলছে, মাদকসেবীর মধ্যে ১৮.২৭ শতাংশ উচ্চ শিক্ষিত তরুণ। ২০১৯ সালে এ হার ছিল ১৫.৩৬ শতাংশ। কম শিক্ষিত তরুণদের মধ্যেও বাড়ছে মাদকসেবীর হার। ২০২০ সালে ২০.৩০ শতাংশ থাকলেও এর আগের বছর এ হার ছিল ১৭.৫৮ শতাংশ।
বয়সভিত্তিক হিসেবে সবচেয়ে বেশি তরুণদের মধ্যে মাদক নেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ২০২০ সালে ২১ থেকে ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত মাদকসেবীর হার ৫৮.৩৮ শতাংশ। ২০১৯ সালে এ হার ছিল ৫০.১৭ শতাংশ। অর্থ্যাৎ করেনাার সময় এ হার বেড়েছে। যদিও ২০১৮ সালের এ হার ছিল ৫৪.৯৮ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের চিফ কনসালটেন্ট ডা. শোয়েবুর রেজা চৌধুরী জানান, সাম্প্রতিককালে তরুণদের মধ্যে মাদক নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। যার মধ্যে ইয়াবার প্রভাব সবচেয়ে বেশী। তবে সঠিকভাবে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে তরুণ সমাজকে মাদকের এই ভয়ঙ্কর পরিণতি থেকে বের করে আনা সম্ভব হবে।
মাদকদ্রব্যের ভয়াবহ বিস্তার সম্পর্কে জানতে পাঁচটি সংস্থার ১৪ বছরের (২০০৯-২০২২) উদ্ধারকৃত মাদকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করেছে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস। সংস্থাগুলো হলো-মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড (বিজিবি), র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ও বাংলাদেশ কোস্টগার্ড। এ পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া ১২ ধরণের মাদকের মধ্যে ইয়াবা ও গাঁজার বিস্তার সবচেয়ে বেশী। ২০০৯ সালে ইয়াবা উদ্ধার হয়েছিল ১ লাখ ৩২ হাজার ২৮৭ পিস। করোনাকালীন লকডাউনের মধ্যে ২০২১ সালে ইয়াবা উদ্ধারের হার ছিল সবচেয়ে বেশি। ওই বছর ৫ টি সংস্থা মিলে ৫ কোটি ৩০ লক্ষ ৭৩ হাজার ৬৬৫ পিস ইয়াবা জব্দ করে। আর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্তই জব্দকৃত ইয়াবার সংখ্যা ৬২ লাখ ৫৫ হাজার ২৮৮ পিস।
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ইয়াবার সাথে বেড়েই চলেছে গাঁজার চালান। সমাজের সর্বস্তরের মাদকাসক্তদের রয়েছে গাঁজার সম্পৃক্ততা। ২০০৯ সালে সরকারি সংস্থা কর্তৃক জব্দকৃত গাঁজার পরিমাণ ছিল প্রায় ৩২ হাজার ৯৫৫ কেজি। আর তা বেড়ে ২০২১ সালে ৮৬ হাজার ৬৯৬ কেজি হয়েছে। এখন অনেকেই উৎসব মানেই বিয়ারের উপস্থিতি বুঝে। বিগত ১২ বছরের তুলনায় সবচেয়ে বেশি বিয়ারের বোতল জব্দ হয় ২০২১ সালে। ওই বছর ১ লাখ ৩৩ হাজার ৫৪৪ টি বোতল জব্দ করা হয়। এছাড়াও ইয়াবার সাথে ক্রিস্টাল মেথের (আইস) উপস্থিতি অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
ডিএনসির পরিচালক (অপারেশন ও গোয়েন্দা) তানভীর মমতাজ জানান, বিভিন্ন মাদকদ্রব্যের মধ্যে ইয়াবার সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এরই সাথে সাম্প্রতিককালে আইস (ক্রিস্টাল মেথ) আসা শুরু করেছে।
কোন জায়গা থেকে এই মাদকগুলো প্রবেশ করে জানতে চাইলে তিনি জানান, বর্তমানে আলোচিত মাদক ইয়াবা এবং আইস দুটিই আমাদের দেশে পাচার হয় মায়ানমার থেকে। মায়ানমার, বাংলাদেশ আর থাইল্যান্ডের ট্রাই এঙ্গেল দিয়ে এ মাদককদ্রব্য পাচার করা হয়।
বন্ধুবান্ধবের প্ররোচনা কিংবা কৌতুহলের বশে মাদকের সর্বনাশা নেশায় জড়িয়ে পড়েন বেশিরভাগ আসক্তরা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সর্বশেষ বাষিক ড্রাগ প্রতিবেদন বলছে, ২০২০ সালে কৌতুহলের বশে ৪০ শতাংশ এবং বন্ধুবান্ধবের প্ররোচনায় ৫৮.৫০ শতাংশ মাদকসেবী মাদক নিয়েছেন। ২০১৯ সালে এই হার ছিল ৪৯.৪৯ শতাংশ।
মাদক একেবারেই নির্মূল করা অসম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তবে মাদকাসক্ত তরুণদের সংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য কাউন্সেলিংসহ নানান পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মো. রেজাউল করিম সোহাগ বলেন, বেকারত্ব, দারিদ্রতা, সামাজিক অস্থিরতা, ব্যর্থতার গ্লানি, একঘেয়েমি, একাকীত্ব এবং পারিবারিক বন্ধন ভেঙে যাওয়ার কারণে অনেকেই মাদকের দিকে ঝুঁকছে। কৌতুহলের বশে বা বন্ধুবান্ধবের হাত ধরেই মাদকের নেশায় জড়িয়ে পড়েন বেশিরভাগ আসক্তরা।
তিনি আরও বলেন, করোনার সময় প্রযুক্তি আসক্তি এবং আকাশ সংস্কৃতির অপচ্ছায়া গ্রাস করে কোমলমতি হৃদয়গুলোকে। যার ফলে বেড়েছে মাদকাসক্তের সংখ্যা। এ অবস্থায় মাদকাসক্তদের সংখ্যা কমিয়ে আনতে কাউন্সেলিংসহ নানান পদক্ষেপ নিতে হবে।