মায়ের অপহরণের দাবি ‘মিথ্যা’ — বললেন মরিয়ম মান্নান
‘মায়ের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়েছে মা জীবনের প্রতি বিরক্ত, নিজেই আত্মগোপনে ছিল। তিনি অপহরণ হননি। সে চলে গিয়েছিল সারা জীবনের জন্য। এটার দায় আমারও। আমরা তো তার সন্তান।’-এমনি বলেছেন খুলনার আলোচিত তরুণী মরিয়ম মান্নান।
আদালত ও পুলিশের কাছে রহিমা বেগম ‘অপহৃত হয়েছিলেন’ বলে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা মিথ্যা বলেও স্বীকার করছেন মরিয়ম। তিনি জানিয়েছেন, মায়ের জবানবন্দি পরিবর্তনের জন্য আদালতে আবেদন করা হবে।
ফরিদপুরের পাশাপাশি বান্দরবানেও মায়ের অবস্থানের তথ্য পেয়েছিলেন তিনি। তবে সেটি প্রকাশ না করে পরদিনও তিনি ময়মনসিংহের অজ্ঞাতপরিচয় নারীর মরদেহকে মায়ের দাবি করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন।
মরিয়ম এখন দাবি করছেন, অজ্ঞাতপরিচয় নারীর মরদেহকে মা ভাবার কারণে তিনিসহ অন্য ভাইবোনেরা ‘স্বাভাবিক অবস্থায়‘’ ছিলেন না। এ কারণেই তারা রহিমা বেগমের বান্দরবান ও ফরিদপুরে অবস্থানের তথ্যকে ‘গুরুত্ব দেননি’।
মরিয়ম বৃহস্পতিবার জানান, ময়মনসিংহ থেকে গত শুক্রবার ঢাকা ফেরার পথেই বান্দরবানে তার মায়ের অবস্থানের বিষয়ে তথ্য পান। ওইদিনই ফরিদপুর থেকেও একজন ফোন করে বোয়ালমারীতে তাদের কাছে রহিমার অবস্থানের তথ্য জানিয়েছিলেন।
মরিয়ম দাবি করেন, সে সময় তিনি মায়ের বান্দরবান যাওয়ার তথ্য অবিশ্বাস করেছিলেন। তবে এখন তিনি নিশ্চিত যে তার মা রহিমা বেগমের অপহৃত হননি, তিনি আত্মগোপনেই ছিলেন।
মরিয়মের মা রহিমা গত ২৭ আগস্ট খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশার বাড়ি থেকে গত ২৭ আগস্ট রাতে নিখোঁজ হন। মাকে খুঁজে পেতে বিভিন্ন সময় মানববন্ধন, সংবাদমাধ্যমে নানা সাক্ষাৎকার ও ফেসবুকে আবেগঘন পোস্ট দিয়ে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে আলোচনায় মরিয়ম মান্নান।
মায়ের নিখোঁজ হওয়ার পেছনে বরাবরই তিনি প্রতিবেশীদের সঙ্গে জমির বিরোধের বিষয়টিকে দায়ী করে আসছিলেন। রহিমা নিখোঁজের পরদিন দৌলতপুর থানায় অপহরণের মামলা করেন তার আরেক মেয়ে আদুরী আক্তার।
গত ২২ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহে ১২ দিন আগে উদ্ধার হওয়া এক নারীর মরদেহকে রহিমা বেগমের বলে দাবি করেন মরিয়ম। পরদিন শুক্রবার সকালে বোনদের নিয়ে ফুলপুর থানায় লাশ শনাক্ত করতে যান তিনি।
এরপর শনিবার রাতে ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার সৈয়দপুর গ্রামের কুদ্দুস মোল্লার বাড়ি থেকে রহিমা বেগমকে স্বাভাবিক অবস্থায় উদ্ধার করে পুলিশ।
তিনি বলেন, ‘ময়মনসিংহ থেকে আমরা ঢাকায় আসার পর, বান্দরবান থেকে মনি বেগম নামে এক নারী আমার ভাই মিরাজকে কল করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আপনার মা ভিক্ষা করতে করতে আমাদের কাছে এসেছিলেন। বিষয়টি আমাদের সন্দেহ হয়েছিল। নম্বরটি আমার ভাই র্যাবকে দিয়েছিল তদন্ত করতে।
‘এছাড়া ফরিদপুর থেকেও আমার ভাইয়ের মোবাইলে জানানো হয়েছিল, মা তাদের কাছে আছে। তবে মোবাইলটি আমার ভাইয়ের স্ত্রী রিসিভ করে বিরক্তি প্রকাশ করেছিলেন। সে সময়ে আমাদের মাথা ঠিক ছিল না। একেকজন ফোন করে একেক রকমের কথা বলছিলেন। তাই কোনটা সত্য বুঝতে পারছিলাম না।’
মা নিখোঁজ হননি, তিনি আত্মগোপনেই ছিলেন বলে জানিয়েছেন মরিয়ম।
‘মা ভীষণ কান্নাকাটি করছে। সে বলছে আমি তো চলেই গেছি, আমাকে কেন নিয়ে আসছো।’
আদালতে অপহরণ হয়েছেন দাবি করে যে জবানবন্দি রহিমা দিয়েছিলেন, এখন সেটিও বদলাতে চান মরিয়ম। তিনি বলেন, ‘সে আদালতে যা বলেছে তা গ্র্যান্ট করার কিছু নাই। মায়ের এই স্টেটমেন্টটা আমরা নিচ্ছি না। আইন-আদালত কেউ নেবে না। তার যদি মাথা ঠিক থাকত তাহলে ছেলে-মেয়েদের রেখে এসব করত না। সে একা একা চলে যেত না।
‘তার জন্য আমরা হেনস্তার শিকার হয়েছি। এই দায় মাকে দিচ্ছি না, আমরাই নিচ্ছি। মায়ের জবানবন্দি আদালতে অবশ্যই পরিবর্তন করাব। মাকে তো আমরা এখনি আদালতে নিতে পারছি না। পিবিআই তদন্ত করছে, তারা যখন ডাকবে, তখন আদালতে স্টেটমেন্ট পরিবর্তন করাব। তাকে সাপোর্ট দেয়ার এখানে কিছুই নাই।’
অপহরণের অভিযোগে করা মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিষয়ে তাহলে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হবে কিনা? জানতে চাইলে মরিয়ম বলেন, ‘আমরা মামলায় কারও নাম দেই নাই। সন্দেহদের নাম দিয়েছিলাম। তাদেরকে সন্দেহের যথেষ্ট কারণ ছিল। পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করেছে।
‘আমি ইতোমধ্যে আইনজীবীকে বলে দিয়েছি, মামলাটি তুলে নিতে। তখন তাদের প্রতি সন্দেহ হওয়ার যথেষ্ট কারণ ছিল। এখন তো মনে হচ্ছে মা আত্মগোপনে ছিলেন। তাই মামলাটি তুলে নেব। এছাড়া বিষয়টি নিয়ে আদালতের কাছে ক্ষমাও চাইব।’
সৎ বাবাকে কেন গ্রেপ্তার করা হলো, তার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ তোলা হয়েছিল? এর জবাবে মরিয়ম বলেন, ‘মা নিখোঁজ হওয়ার পরে বেল্লাল ঘটক প্রথমে আমাদের বলেছিলেন, তোমার মা আর নাই। তোমার মাকে মেরে ফেলছে। পরে তিনি আবার বলছিলেন আমি কিছু জানি না তোমাদের মা কোথায় গেছে।
‘তার দুই ধরনের কথায় সন্দেহ হওয়ায় পুলিশকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে বলেছিলাম। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদে নিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করেছে।’
মরিয়ম বলেন, ‘মা এখন আমাদের কাছে থাকতে চাচ্ছেন না। যদিও আদালত আমার বোন আদুরীর জিম্মায় মাকে মুক্তি দিয়েছেন। এখন পরবর্তীতে পিবিআই যখন মাকে আদালতে নেবে, তখন বিষয়টা দেখা যাবে। তবে মা চাইলে তো তাকে একা ছেড়ে দেয়া যায় না। সে তো মা।’
অপহরণ মামলার তদন্তের অগ্রগতি কতদূর, জানতে চাইলে খুলনা পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘তদন্তে নেমে প্রায় সব তথ্য-প্রমাণ আমাদের হাতে এসেছে। যে সময় রহিমা আত্মগোপনে যান, সে সময়ে তার স্বামী বেল্লাল হাওলাদার কাছেই ছিলেন। যে কারণে বেল্লাল হাওলাদারকে জিজ্ঞাসাবাদ করা একান্ত প্রয়োজন।
‘তাকে আমরা রিমান্ডের আবেদন জানিয়েছি। ৪ অক্টোবর তার শুনানি হবে। তারপর রহিমার আত্মগোপনে কারা জড়িত জানা যাবে।’