রংপুর রাইডার্সকে কি ‘মিনি জাতীয় দল’ বললে ভুল হবে?
বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল) এখন কড়া নাড়ছে দরজায়। সময়ের পরিক্রমায় নানা বিতর্কে জড়িয়ে থাকা টুর্নামেন্টকে অনেকেই মজা করে ‘বিতর্ক প্রিমিয়ার লিগ’ও বলেন। সময় বদলায়, আসর বাড়ে, কিন্তু বদলায় না একটাই জিনিস— বিতর্কের ছায়া। অবশ্য, এসব বিতর্ক-সমালোচনা একপাশে রেখে প্রতিবারই ভালো কিছুর স্বপ্ন বোনেন ক্রীড়াপ্রেমীরা। বিপিএলের জন্য মুখিয়ে থাকেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। ক্রিকেটাররাও অপেক্ষায় থাকেন ঘরোয়া ক্রিকেটের সবচেয়ে জনপ্রিয় এই টুর্নামেন্টের।
বিপিএলের এবারের নিলাম জমজমাট পরিবেশেই হয়েছে। দেশি ১৫৮ ও বিদেশি ২৮৭ ক্রিকেটারের মধ্য থেকে নিজেদের স্কোয়াড গুছিয়ে নেয় ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো। নিলামে সবচেয়ে বড় চমক ছিলেন নাঈম শেখ, দেশিদের মধ্যে তাকে সর্বোচ্চ ১ কোটি ১০ লাখ টাকায় দলে নেয় চট্টগ্রাম রয়্যালস। অন্যদিকে বিদেশিদের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫৫ হাজার ডলারে দাসুন শানাকাকে দলে ভেড়াল ঢাকা ক্যাপিটালস।
বিপিএলের আসন্ন আসর ঘিরে প্রতিটি দলের দিকে নজর ক্রীড়াপ্রেমীদের। অবশ্য গত ৩০ নভেম্বর নিলাম শেষ হওয়ায় এখন স্পষ্ট, কোন ফ্র্যাঞ্চাইজি কেমন স্কোয়াড গঠন করেছে এবং কোন দল কতটা শক্তিশালী। নিলামের পর ৬ দলের চূড়ান্ত খেলোয়াড় তালিকা, ব্যাটিং–বোলিং শক্তিমত্তা, সম্ভাব্য একাদশ এবং সামগ্রিক প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় আজ থাকছে রংপুর রাইডার্স।
এবার নিলামে বেশ কৌশলীভাবে দল সাজায় রংপুর রাইডার্স। যদিও নিলামের আগেই ডিরেক্ট সাইনিংয়ে নুরুল হাসান সোহান ও হেভিওয়েট মোস্তাফিজুর রহমানকে দলে টেনেছিল রংপুর। ঘরোয়া টুর্নামেন্টে দীর্ঘদিন ধরেই মোস্তাফিজের নির্ভরযোগ্য পারফরম্যান্স; ডেথ ওভারে অসাধারণ বিচিত্র, নতুন বলে সুইং এবং অভিজ্ঞতা—সব মিলিয়ে যেকোনো দলের জন্য মূল্যবান সম্পদ কাটার-মাস্টার। বিপিএলে পাঁচটি ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে ৮২ ইনিংসে ৭ দশমিক ১৪ ইকোনমিতে ১০৫ উইকেট শিকার করেছেন মোস্তাফিজ। কাটার-স্লোয়ারে দলীয় প্রয়োজনে ম্যাচের মোড় ঘুরিয়ে দিতে তার বিকল্প নেই।
অন্যদিকে ব্যাট হাতে ঝড় তোলার পাশাপাশি অধিনায়ত্বের গুণ বরাবরই প্রশংসা কুড়ান সোহান। উইকেটের পেছনেও অনন্য তিনি। তাকেই দেশের অন্যতম সেরা উইকেটকিপার হিসেবে বিবেচনায় করা হয়। একসময়ে জাতীয় দলের এই নিয়মিত মুখ বিপিএলে ৮টি ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে ১০০ ইনিংসে ১২৩ দশমিক ০৫ স্ট্রাইক রেট আর ২০ দশমিক ৪৫ গড়ে ১ হাজার ৪৫২ রানের মালিক। যেখানে গত তিনটি আসরের পর এবারও রংপুরের জার্সিতে তাকে দেখা যাবে। বিপিএলে শিরোপার আক্ষেপ থাকলেও সোহানের হাত ধরেই জিএসএলে প্রথমবারের শিরোপার স্বাদ নেয় রাইডার্সরা।
নিলামে টপ-অর্ডার ব্যাটার ও ফিনিশারদের দিকে বাড়তি মনোযোগ দিয়েছিল দলটি। যেখানে টপ-অর্ডারে অভিজ্ঞ লিটন কুমার দাসের অন্তর্ভুক্তি দলের ব্যাটিং লাইন-আপে যেমন বাড়াবে গভীরতা, তেমনই বাড়াবে কিপিং অপশনও। জাতীয় টি-টোয়েন্টি দলের অধিনায়ক লিটন নিঃসন্দেহে অন্যতম টি-টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট। রান তোলার গতি যেমন বাড়াতে পারেন, প্রয়োজনে ধ্রুপদী স্টাইলে উইকেট আঁকড়েও থাকতে পারেন। এছাড়া মিডল-অর্ডারে দলটির আস্থার নাম অভিজ্ঞ মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ এবং তরুণ তাওহীদ হৃদয়। দুজনই দলের শক্তি ও গভীরতা বাড়াবে তা বলাই যায়।
হৃদয়ের বছরটা ভালো না কাটলেও আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে সদ্য সমাপ্ত আয়ারল্যান্ড সিরিজে ফর্মে ফেরার বার্তা দিয়েছেন, প্রয়োজনে তিনি জ্বলে উঠতে পারেন তা সহজেই অনুমেয়। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক রিয়াদকে দলে নিয়ে রংপুর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। রিয়াদের অভিজ্ঞতা ও পার্ট-টাইম বোলিং অবশ্যই রংপুরকে এগিয়ে রাখবে। অনেকে মনে করেন, রিয়াদ বুড়িয়ে গেছেন, ফুরিয়ে গেছেন। তবে রিয়াদের বিপিএল অভিজ্ঞতা ও রেকর্ড কিন্তু মোটেও খারাপ নয়।
তাদের সঙ্গে দুই বিদেশি খাজা নাফে ও সুফিয়ান মুকিমকেও সরাসরি চুক্তিতে দলে টানে রংপুর। স্পিন উইকেটে আলো ছড়াতে সর্বদা প্রস্তুত পাকিস্তানি স্পিনার সুফিয়ান। উইকেটে স্পিন জালের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে দলে অপরিহার্য ভূমিকা রাখতে পারেন তিনি।
এদিকে বোলিং ইউনিটও তরুণদের নিয়েই গড়েছে রংপুর। অনূর্ধ্ব -১৯ বিশ্বকাপজয়ী স্পিনার রাকিবুল হাসানের সঙ্গে রহস্যময় স্পিনার আলিস আল ইসলাম রয়েছেন। রাকিব প্রয়োজনে ভালো ব্যাটিংও পারেন। তার বাঁহাতি স্পিন দেশের উইকেটে দারুণ কার্যকর হতে পারে। পাশাপাশি, মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী এবং স্পিডস্টার নাহিদ রানার মতো পেসাররা থাকায় এই ইউনিটও বেশ বৈচিত্র্যপূর্ণ। এনসিএল টি-টোয়েন্টিতে আলো ছড়ানো ইফতেখার হোসেন ইফতির পাশাপাশি নাঈম হাসান, পেসার কামরুল ইসলাম রাব্বি, তরুণ আবদুল হালিম এবং মেহেদী হাসান সোহাগকেও দলে রেখেছে রাইডার্সরা। দেশি খেলোয়াড়দের মধ্যে এই তারকাদের সংমিশ্রণে এক শক্তিশালী ও হেভিওয়েট দল রংপুর।
তবে নিলামে বিদেশিদের শক্তি বিবেচনায় বাকিদের চেয়ে কিছুটা পিছিয়ে রংপুর। নিলাম থেকে এমিলিও গে এবং মোহাম্মদ আখলাককে নেয় তারা। পিএসএলের নানা দলের হয়ে নানা সময়ে আলো ছড়িয়েছেন পাকিস্তানি উইকেটরক্ষক ব্যাটার আখলাক। এ ছাড়া গে ইতালির ব্যাটার। আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো খেলতে যাচ্ছে গে'র দল। তবে খাজা নাফের ওপেনিংয়ের ঝড় এবং সুফিয়ান মুকিমের স্পিন মিললে অতটা খারাপও নয় রংপুরের বিদেশি স্কোয়াড।
যদিও নিলামের পর একের পর এক চমক নিয়ে হাজির হচ্ছে রংপুর। এই তালিকায় খুশদিল শাহ ছাড়াও ফাহিম আশরাফ, ইফতিখার আহমেদ, ডেভিড মালান রয়েছেন। তবে কে কতদিন বিপিএলে খেলতে পারবেন, তা নিয়ে নানা অনিশ্চয়তা রয়েছেন। নিলামের পর নেওয়া ফাহিম গত মৌসুমে বরিশালের হয়ে খেলেছিলেন। বাকিরাও বিপিএলে জনপ্রিয় মুখ।
সবমিলিয়ে এখনো বিপিএলে শিরোপা জিততে না পারলেও প্রতিবারের মত এবারও শিরোপা জেতার মত দলই গড়েছে রংপুর। এবার মাঠে ক্রিকেটাররা নিজেদের সেরাটা দিতে পারলেই হয়। আর নুরুল হাসান সোহানের নেতৃত্বে দারুণ শক্তিশালী রংপুরকে মিনি জাতীয় দল বললেও খুব একটা ভুল হবে না।
রংপুর রাইডার্সের পূর্ণাঙ্গ স্কোয়াড:
সরাসরি চুক্তি: নুরুল হাসান সোহান, মোস্তাফিজুর রহমান, খাওয়াজা নাফে (পাকিস্তান), সুফিয়ান মুকিম (পাকিস্তান)।
নিলাম থেকে: লিটন কুমার দাস, তাওহীদ হৃদয়, নাহিদ রানা, রকিবুল হাসান, আলিস আল ইসলাম, মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরি, নাঈম হাসান, কামরুল ইসলাম রাব্বি, মেহেদী হাসান সোহাগ, ইফতেখার হোসেন ইফতি, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, আব্দুল হালিম, এমিলো গে (ইতালি), মোহাম্মদ আখলাক (পাকিস্তান)।
নিলামের পর: খুশদিল শাহ (পাকিস্তান), ফাহিম আশরাফ (পাকিস্তান), ইফতিখার আহমেদ (পাকিস্তান), ডেভিড মালান (ইংল্যান্ড)।