১৮ আগস্ট ২০২৫, ২০:৫০

শতভাগ পাশ, ৭০% জিপিএ-৫: হামদর্দ পাবলিক কলেজের এক দশকের সাফল্যের গল্প

হামদর্দ পাবলিক কলেজ  © সংগৃহীত

শিক্ষা অর্জন মানে শুধু ভালো ফলাফল নয়, শিক্ষা মানে একটি সুশৃঙ্খল মানবিক, নৈতিক ও দক্ষ জীবনযাত্রার অবিরাম প্রস্তুতি। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষ একটি প্রজন্ম গড়ে তোলার প্রত্যয়ে ২০১০ সালে মাত্র ১৪ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে হামদর্দ পাবলিক কলেজ। কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন হামদর্দ বাংলাদেশের প্রাণপুরুষ ড. হাকীম মোহাম্মদ ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া। যিনি বাংলাদেশে ইউনানী আয়ুর্বেদ শিল্পের শুধু একজন রুপকারই নন, তিনি একজন মানবহিতৈষী ও শিক্ষানুরাগী যোদ্ধা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে হামদর্দ পাবলিক কলেজ রচনা করে চলেছে একের পর এক সাফল্যের গল্প। 

রাজধানীর পান্থপথ সিগন্যালে কলেজটির কার্যক্রম। মাত্র ১৪ জন শিক্ষার্থী থেকে আজ কলেজের বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পড়ালেখা করা শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৯০০। রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুপরিসর ক্লাসরুম। কলেজের রুফটপে রয়েছে নান্দনিক ছাদ বাগান। 

কলেজের আছে এমন জাদুকরী কৌশল যা হামদর্দ পাবলিক কলেজকে শুধু রাজধানী জুড়ে নয়, বরং সারাদেশে একটি আদর্শিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কলেজের এই সফলতার সবচেয়ে বড় কারিগর এক ঝাঁক নিবেদিত, প্রতিশ্রুতিশীল ও দক্ষ শিক্ষকবৃন্দ। যারা শুধু পাঠদানের উদ্দেশ্যে শিক্ষকতা করেন না। বরং একজন শিক্ষার্থীর ক্ষুদ্রতম সম্ভাবনাটুকুও কাজে লাগানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। অনুপ্রেরণা দেন। বিষয়ভিত্তিক যে কোনো সমস্যায় সবার আগে বাড়িয়ে দেন সাহায্যের হাত। শিক্ষার্থীর মর্মে মূলে জ্ঞান অর্জনের চেতনা জাগাতে অবিরাম তারা যুদ্ধ করে চলেছেন। 

শিক্ষক হিসেবে তাদের সবচেয়ে বড় ভূমিকা হলো গাইড শিক্ষক কার্যক্রম। একজন গাইড শিক্ষক শুধু একজন শিক্ষকই নন। তিনি শিক্ষার্থীর পরম বন্ধু, দ্বিতীয় অভিভাবক এবং পড়ালেখাসহ ব্যক্তিগত নানা সমস্যার একনিষ্ঠ ভরসাস্থল। প্রতি ১৫ জন শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে একজন গাইড শিক্ষক। যিনি তার গাইডভুক্ত শিক্ষার্থীর পথ প্রদর্শক।  

ডিসিপ্লিনের ব্যাপারে কলেজ জিরো টলারেন্স নীতিতে বিশ্বাসী। সিসি ক্যামেরায় পুরো ক্যাম্পাসটি নিয়ন্ত্রণ করে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে চলেছে ডিসিপ্লিন কমিটি। শিক্ষার্থীদের সকাল ৮.০০ টার মধ্যে ক্লাসে উপস্থিত থাকতে হয়। প্রতিদিন সকালে শিক্ষার্থীরা লাইন ধরে সুশৃঙ্খলভাবে কলেজে প্রবেশ করে। ক্লাসে নিয়মিত উপস্থিতির বিষয়ে রয়েছে কঠোর নির্দেশনা। শিক্ষার্থীদের শতকরা ৮০ ভাগ উপস্থিতি বাধ্যতামূলক। এর ব্যত্যয় হলে তারা পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে পারে না। প্রতিটি শিক্ষাবর্ষের শুরুতে শিক্ষার্থীদের বেসিক টেস্টের মাধ্যমে মেধাভিত্তিক সেকশন বিন্যাস করা হয়। যার ফলে পাঠদান প্রক্রিয়া সহজতর হয়। এর মাধ্যমে অধিকতর মেধাবী শিক্ষার্থীদের নিয়ে এডমিশন ব্যাচ গঠন করে বুয়েট, মেডিকেল ও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির উপযোগী ক্লাস কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। 

বছরজুড়ে কলেজের রয়েছে মাসিক, অর্ধ-বার্ষিক, বার্ষিক, প্রাক নির্বাচনী, নির্বাচনী ও মডেল টেস্ট পরীক্ষা। প্রতিটি পরীক্ষায় অন্তত ৬০ শতাংশ নম্বর অর্জন করতে হয়। শিক্ষার্থীদের পড়াশুনাকে আরও শাণিত করতে এবং পরীক্ষায় ভালো ফলাফল অর্জনের জন্য রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। প্রতিদিন সকাল ৮.০০ টা থেকে প্রায় ১ ঘণ্টা ব্যাপী স্পেশাল ক্লাস এন্ড কুইজ নামক একটি ক্লাস অনুষ্ঠিত হয়। এটি এমনই এক বিশেষ ব্যবস্থা যেখানে একজন শিক্ষার্থী অধিক গুরুত্বপূর্ণ টপিকের নোটসহ এডমিশন প্রশ্নপত্রের সমাধান ও অনুশীলন করার সুযোগ পাচ্ছে এবং প্রতি রবি ও বুধবার রয়েছে উক্ত পঠিত বিষয়ের উপর ১৫ নম্বরের বিশেষ মূল্যায়ন। প্রতিটি সেকশনের জন্য প্রতিদিন অন্তত একটি ল্যাব বা প্রাকটিক্যাল ক্লাস রয়েছে। আর এই ক্লাসের জন্য কলেজের রয়েছে সমৃদ্ধ বিজ্ঞানাগার। পদার্থ, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন জটিল বিষয় হাতে কলমে শেখার পর্যাপ্ত আয়োজন রয়েছে ল্যাবগুলোতে। রয়েছে পর্যাপ্ত কম্পিউটার সন্নিবেশিত অত্যাধুনিক আইসিটি ল্যাব। 

পিছিয়ে পড়া দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে স্পেশাল ক্লাসের ব্যবস্থা। এমনকি শিক্ষার্থীর পঠিত বিষয়ে কোন অস্পষ্টতা থাকলে বা পড়া বুঝতে কোন সমস্যা থাকলে ছুটির পরও তারা বিষয় শিক্ষকের সাথে শিক্ষক মিলনায়তনে যোগাযোগ করে বিষয়ভিত্তিক সমস্যার সমাধান করতে পারেন। 

শুধুই কি পড়ালেখা? কলেজের সাফল্যের পিছনে পড়ালেখার পাশাপাশি রয়েছে বর্ণাঢ্য সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম। বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও অন্যান্য সহ-পাঠ্যক্রমিক কাজের জন্য রয়েছে তারুণ্যে ভরপুর অনেকগুলো ক্লাব। বিজ্ঞান, বিতর্ক, সাহিত্য, সংস্কৃতি, আর্টস এন্ড ক্রাফট, ফটোগ্রাফিক, স্পোর্টস, সমাজকল্যাণ, পরিবেশ, ল্যাঙ্গুয়েজ ক্লাবসহ ১৮টি ক্লাবের কার্যক্রম বছর জুড়ে চলমান। যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের শুধু সুপ্ত প্রতিভাই বিকশিত করছে না, অর্জন করছে নেতৃত্বেরও গুণাবলি। সমাজকল্যাণ ক্লাবের মাধ্যমে যেমন শিক্ষার্থীরা শীতবস্ত্র বিতরণ, ইফতার বিতরণের মতো কাজ করছে, তেমনি শিক্ষার্থীদের মননে দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধ জাগ্রত করতে চলছে নানা রকম সচেতনতামূলক কার্যক্রম। 

সে জন্য দেশের ক্রান্তিকালে শহরের ট্র্যাফিক নিয়ন্ত্রণ, রমনা পার্ক ও অমর একুশে বই মেলায় পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম, স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচির মতো সচেতনতামুলক কার্যক্রমেও অংশগ্রহণ করছে শিক্ষার্থীরা। কলেজের বিজ্ঞান ক্লাবের রয়েছে বিভিন্ন অলিম্পিয়াডের অসংখ্য পুরস্কার। যেমন জাতীয় বিজ্ঞান উৎসব-২০১৫ তে ১ম পুরস্কারসহ ৩ টি পুরস্কার, ২০২১ সালে ১৬ টি পুরস্কারসহ রয়েছে ১৫ টিরও অধিক অলিম্পিয়াডের গৌরবোজ্জ্বল অর্জন। 

শ্রান্তি বিনোদনের জন্য কলেজ নিয়মিত বিরতিতে বিভিন্ন ইভেন্টের আয়োজন করছে। প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে বার্ষিক শিক্ষা সফর যেখানে দিনব্যাপী বর্ণাঢ্য আনন্দ আয়োজন ও উচ্ছ্বাসে নিজেদেরকে বিকশিত করার সুযোগ পাচ্ছে তারা। পিকনিক ছাড়াও বছর জুড়ে বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা দিতে শিক্ষকবৃন্দ  তাদেরকে বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেলসহ বিভিন্ন বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঘুরতে নিয়ে যায়। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বিনোদনের অংশ হিসেবে মেট্রোরেল ভ্রমণ ও উত্তরা উত্তর স্টেশন সংলগ্ন পার্কে মিনি পিকনিকের ব্যবস্থাও করছে প্রতিষ্ঠানটি। রয়েছে বার্ষিক স্পোর্টস ডে। এই আয়োজনে তারকা খেলোয়াড়দের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয় ক্রিকেট, ফুটবলসহ খেলাধুলার বিভিন্ন ইভেন্ট। এছাড়াও রয়েছে চমকপ্রদ ফুটসাল। হামদর্দ পাবলিক কলেজ খেলাধুলার প্রতি সব সময় বিশেষ গুরুত্ব দেয়। তারই অংশ হিসেবে আয়োজন করা হয়েছিল ফুটসাল প্রীতি ফুটবল ম্যাচের।

কলেজের অভ্যন্তরে অনুষ্ঠিত হয় বইমেলা, পিঠামেলা, বৃক্ষমেলা, পহেলা বৈশাখসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবস। আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে আরও রয়েছে নবীন বরণ ও বিদায় অনুষ্ঠান, বিভিন্ন ক্লাস পার্টি, ইদ পুনর্মিলনী, ক্লাব ফেস্টিভালসহ আরো অনেক কিছু। যেখানে পুরোটা জুড়ে থাকছে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। 

এবার আসি কলেজের আবাসন সুবিধার দিকে। ঢাকার বাহিরে থেকে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে কলেজের নিজস্ব আবাসন সুবিধা। রয়েছে লিফট ও সিসি ক্যামেরা নিয়ন্ত্রিত ৯ তলা বিশিষ্ট একটি অত্যাধুনিক ছাত্রী হোস্টেল। ছাত্রদের জন্য রয়েছে তিনটি ছাত্র হোস্টেল। এখানে পড়ালেখার জন্য হোস্টেল সুপারের তত্ত্বাবধানে রয়েছে কঠোর মনিটরিং সিস্টেম। আবাসিক শিক্ষার্থীদের পড়াশুনার জন্য বিকেল বেলা হোস্টেলের অভ্যন্তরেই রয়েছে প্রাইভেট কেয়ারের ব্যবস্থা। যেখানে প্রতিদিন দুই ঘণ্টা ব্যাপী দুটি ক্লাস নেন কলেজের শিক্ষকবৃন্দ। এছাড়াও রয়েছে দৈনিক তিন বেলা স্বাস্থ্যসম্মত খাবার পরিবেশন, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, নিরাপদ পানি, খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা।

এ যেন শুধু একটি কলেজ নয়। এটি শিক্ষার্থীদের কল্যাণের জন্য গড়ে ওঠা এক  আলোক উদ্ভাসিত প্রতিষ্ঠান যার মহা কর্মযজ্ঞের মাধ্যমেই প্রতি বছর কলেজ অর্জন করে চলেছে একের পর এক সাফল্য। কলেজের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ২০১২ সাল থেকে সর্বশেষ ২০২৪ পর্যন্ত একটানা প্রতি বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলে কলেজটির পাশের হার শতভাগ এবং জিপিএ ফাইভ প্রাপ্তির হার প্রায় ৭০ শতাংশ। এমনকি এসএসসিতে কম জিপিএ নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েও বেশি জিপিএ নিয়ে বের হয় এখানকার শিক্ষার্থীরা। এই ব্যাপারে উল্লেখ করা যায় এমন তিনজন শিক্ষার্থীর কথা যাদের এসএসসিতে জিপিএ ৫ ছিল না। কিন্তু হামদর্দ পাবলিক কলেজ থেকে তারা এইচএসসিতে জিপিএ ৫ নিয়ে বের হয়েছিল এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটে পড়ার সুযোগ পেয়েছিল। 

গরীব, অসচ্ছল ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে বৃত্তির সুব্যবস্থা। শিক্ষার্থীর পরিবারের আর্থিক অবস্থা, মেধা, পরীক্ষার ফলাফল ও ডিসিপ্লিন বিবেচনা করে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে শিক্ষার্থীদের বছরজুড়ে এই বৃত্তি দেয়া হয়। যার পরিমাণ বছরে প্রায় ১ কোটি টাকা। 

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির ক্ষেত্রে কলেজের রয়েছে অভূতপূর্ব সাফল্য। প্রতি বছর রেকর্ড সংখ্যক শিক্ষার্থী বুয়েট, ঢাকা মেডিকেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সকল উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। কর্মক্ষেত্রেও রয়েছে তাদের চমকপ্রদ সাফল্য। হামদর্দ পাবলিক কলেজের  অনেক শিক্ষার্থী এখন দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কর্মরত। বাংলাদেশ বিমান, সেনা ও নৌ বাহিনীতে অফিসার হিসেবে যেমন তারা অংশগ্রহণ করছে, তেমনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দেশ গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। অনেক শিক্ষার্থী অন্যান্য প্রথম শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে কর্মরত আছে। এছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে এবং অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে লোভনীয় পদে চাকরি করছে। 

আমরা বিশ্বাস করি হামদর্দ পাবলিক কলেজের শিক্ষার্থীরা অদূর ভবিষ্যতে তারা নিজ নিজ কর্মস্থলে আরো অনেক দুরে এগিয়ে যাবে। দেশের জন্য কাজ করবে। আমাদের শিক্ষার্থীরা নীতি নৈতিকতায় অবিচল একজন আদর্শ নাগরিক হয়ে গড়ে উঠলেই আলোকিত হবে আমাদের প্রাণের প্রতিষ্ঠান হামদর্দ পাবলিক কলেজ। এটাই প্রতিষ্ঠাতা মহোদয় ও সভাপতি মহোদয়ের ঐকান্তিক প্রত্যাশা।