সেই ‘ট্রমা’ এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন হেলিকপ্টার থেকে ছোড়া গুলিতে আহত ঢাকা সিটি কলেজের আইমান
গত বছরের জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন তা নিভৃত করতে ছাত্র-জনতার ওপর সরাসরি গুলি করেছে তৎকালীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এতে হাজার দুয়েক ছাত্র-জনতা শহীদ হওয়ার পাশাপাশি অগণিত হয়েছেন গুলিবিদ্ধ, কেউ হারিয়েছেন চোখ কেউ বা শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তেমনি একজন ঢাকা সিটি কলেজের শিক্ষার্থী আইমান উদ্দিন।
সেদিন ছিল শুক্রবার। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই। রাজধানী ঢাকার সাইন্সল্যাব মোড়সহ আশপাশের এলাকায় চলছিল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার সাথে পুলিশের ধাওয়া ও পাল্টা ধাওয়া এবং গোলাগুলি। পুলিশের ছোঁড়া টিয়ারশেলে আশপাশের এলাকা ছিল অন্ধকার। সকাল থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত চলে একটানা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও গোলাগুলি।
এসময় বাইরের পরিস্থিতি দেখার জন্য আশপাশের বাসার সবাইকে ছাদে যেতে দেখে উৎসুক হয়ে নাছিমা আক্তার রাজধানীর ধানমন্ডির ১ নম্বর রোডে নিজ ভাইয়ের বাসার ১০ তলা ছাদে যান তার দুই ভাতিজাকে নিয়ে। তখন ঠিক বিকেল সাড়ে ৫টা। ঢাকার আকাশ জুড়ে হেলিকপ্টারের উড্ডয়ন। আর সেই হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া হয় গুলি। আর সেই গুলিতে গুলিবিদ্ধ হয় আইমান উদ্দিন (২০) ও নোয়াখালী থেকে বেড়াতে আসা তার ফুফু নাছিমা আক্তার (২৪)।
ওই সময় হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া একটা গুলি আইমানের বুকের ডানপাশ দিয়ে ঢুকে বেরিয়ে/ভেদ করে বুলেটটি পেছনে থাকা তার ফুফু নাছিমা আক্তার (২৪) এর গালের ভেতর দিয়ে গলার খাদ্যনালিতে ঢুকে যায়। পরে তাদের উদ্ধার করে রাজধানীর পপুলার হাসপাতালে নিয়ে গেলে পরদিন (২০ জুলাই) বিকেলে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নাছিমা আক্তার। ১৫ দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে শঙ্কামুক্ত হলে ৫ই আগস্ট ছাড়পত্র পায় আইমান। এর আগে ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) সায়েন্সল্যাবে কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন আইমান।
সম্প্রতি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস প্রতিবেদককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত আইমান উদ্দিন এসব কথা বলেন।
তিনি আরো বলেন, ‘জুলাইয়ের ওই ট্রমাগুলো এবং আমার পরিবারের ওপর যে ঝড় বইছে সে ট্রমাগুলো এখনো বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। সেদিন গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর মনে হচ্ছিল তখন মৃত্যুর খুব কাছাকাছি চলে এসেছি। মৃত্যুর পূর্বে শেষবার মাকে দেখার ইচ্ছে হয়েছিল। প্রায় ১৫-১৬ লাখ টাকা খরচ করতে হয়েছিল পরিবারের। এখন শারীরিকভাবে পুরোপুরি ফিট না। এখনো বুকে খুব ব্যথা পাই।’
জানা যায়, আইমান উদ্দিন নোয়াখালী পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ড মাইজদী বাজার এলাকার স্পেন প্রবাসী হেলাল উদ্দিন সোলায়মান এর বড় ছেলে। তিনি গেল বছর ঢাকা সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেছেন। অন্যদিকে নিহত নাছিমা আক্তার (২৪) স্পেন প্রবাসী হেলাল উদ্দিনের ছোট বোন। মৃত্যুর আগে তার বিয়ের আলাপ চলছিল। কিন্তু মেহেদী রাঙানোর সৌভাগ্য আর হয়নি নাছিমার।
আইমানের মা রেহানা আক্তার দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘সেদিন ঘটনা শুনে আমি চিৎকার শুরু করি। আশেপাশের বাসার মানুষ এসে আমার ছেলে ও ননদকে পপুলার হাসপাতালে নিয়ে যায়। হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে তাদের রাখার পর সেখানকার লোকজন যখন বলতে লাগলো আপনার ছেলে বাঁচবে না। তখন চিৎকার করে করে কাঁদতে থাকি। সে সময়ে কোনো ইন্টারনেট ছিল না। কোথাও কারোর সাথে যোগাযোগও করতে পারছিলাম না। পরে আমার ছেলের চিকিৎসা শুরু হয়। চিকিৎসকরা অনেক চেষ্টা করে আমার ছেলেকে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু ননদকে বাঁচাতে পারেননি।’
আইমানের পিতা হেলাল উদ্দিন সোলায়মান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘যারা শহীদ হয়েছেন বা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন যারা অনেকে সহযোগিতা পেয়েছেন। আমরাও কিছু পেয়েছি। কিন্তু আমরা অনেক জায়গায় ভোগান্তির শিকার হচ্ছি, হয়রানির শিকার হচ্ছি। যারা শহীদ হয়েছেন তাদের ডেড সার্টিফিকেট আছে, তাদের সব কাগজপত্র, ডকুমেন্টস অনলাইনে আছে।‘
‘‘সব থাকা সত্ত্বেও যখন কোনো কাজে যাই তখন বলা হয় এই কাগজ লাগবে, ওই কাগজ লাগবে। এটা দিলে বলে ওটা লাগবে। এতে ব্যাপক হয়রানি হতে হচ্ছে। আমরা চাই যে, কেউ যাতে এরকম হয়রানির শিকার না হয়। তিনি দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হওয়া আমার ছোট বোনের সঞ্চয়পত্র আমরা এখনো পাইনি।’’