বাবা টিউশনি করেন, মা দর্জি— অভাব পেরিয়ে মেডিকেলে চান্স পাওয়া তাপস্বী ঘোর অন্ধকারে
চরম অর্থসংকটে জর্জরিত একটি পরিবার। নিত্যদিনের সংসার চালানোই যেখানে সংগ্রাম, সেখানে মেয়ে সুযোগ পেয়েছে মেডিকেল কলেজে পড়ার। ফলে মেয়ের ভর্তি এখন তাদের কাছে প্রায় অসম্ভব স্বপ্নের মত। শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার রাজনগর সাইনবোর্ড গ্রামের মেয়ে টিএম তাসনিম তাপস্বী সরকারি মেডিকেলে চান্স পেয়েও অর্থাভাবে এমন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে দাঁড়িয়ে আছেন।
অদম্য মেধা ও কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তাপস্বী ২০২৫-২০২৬ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় ৩৬৯২তম স্থান অর্জন করে কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য মনোনীত হয়েছেন। তবে ভর্তি ও পড়াশোনার প্রাথমিক খরচ জোগাড় করাই এখন তার পরিবারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
তাপস্বীর বাবা মো. মোশরাফুল ইসলাম একজন অবসরপ্রাপ্ত এনজিও কর্মী। সংসারের খরচ চালাতে বর্তমানে তিনি টিউশনি করান। মা মৌতিয়া খানম আফরোজা সেলাইয়ের কাজ করে পরিবারের আয়ের ক্ষুদ্র উৎস তৈরি করছেন। দুই সন্তান নিয়ে তাদের সংসারে তাপস্বী বড়।
শিক্ষাজীবন শুরু থেকেই তাপস্বীর সাফল্য ছিল ধারাবাহিক। পিতার চাকরির সুবাদে হবিগঞ্জ জেলায় অবস্থানকালে দ্য নিউ ব্লগার কিন্ডারগার্টেনের শিশু শ্রেণীতে পড়াশোনার সময় বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন অ্যাসোসিয়েশনের বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে তিনি ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি অর্জন করেন। ২০১৭ সালে কিশোরগঞ্জের জঙ্গলবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ হন। এরপর ২০২৩ সালে শেরপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ ও চলতি বছরে শেরপুর সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ অর্জন করে উত্তীর্ণ হন তাপস্বী। ধারাবাহিক এই সাফল্যের পথ ধরে ২০২৫-২০২৬ শিক্ষাবর্ষে মেডিকেল ও ডেন্টাল মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে মেধাতালিকায় স্থান করে নেন তিনি।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে আলাপকালে মোশরাফুল ইসলাম বলেন, মেয়েটা ছোটবেলা থেকেই খুব মেধাবী। ওর পড়ালেখার জন্য আমরা সব কষ্ট সহ্য করেছি। এখন সরকারি মেডিকেলে চান্স পেয়েও যদি শুধু টাকার অভাবে ভর্তি করাতে না পারি, এটা একজন বাবার জন্য সবচেয়ে বড় কষ্ট। আমি এখন টিউশনি দিয়ে সংসার চালাই, আর আমার স্ত্রী সেলাইয়ের কাজ করেন। মেডিকেলে ভর্তি ও পরবর্তীতে পড়াশোনার খরচ আমাদের সাধ্যের বাইরে। তবু আশা ছাড়তে চাই না। মানুষ যদি পাশে দাঁড়ায়, মেয়েটার স্বপ্নটা বাঁচতে পারে।
নিজের অনুভূতির কথা জানিয়ে তাপস্বী দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কলেজে যাওয়া-আসার বাইরে সময় পেলেই বইয়ের সঙ্গে থেকেছি। চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করাই আমার স্বপ্ন। আমার সাফল্যের পিছনে বড় ভূমিকা পালন করেছেন আমার বাবা-মা। আমাকে তারা সর্বোচ্চ সাপোর্ট দিয়েছেন।
তাপস্বীর পরিবারের অভিযোগ, নিকটাত্মীয়দের স্বার্থান্বেষী কর্মকাণ্ডের কারণে তারা দীর্ঘদিন ধরে হামলা, নির্যাতন, মিথ্যা মামলা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। একপর্যায়ে ভিটেবাড়ি জবরদখল ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার পর নিরাপত্তাহীনতার ভয়ে তারা শেরপুর শহরের একটি জরাজীর্ণ ভাড়া বাসায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।
তারা বলছেন, বর্তমানে চলমান মামলা, সামাজিক হয়রানি ও চরম দারিদ্র্যের কারণে মেডিকেল শিক্ষার খরচ বহন করা পরিবারের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে সরকারি মেডিকেলে চান্স পাওয়ার পরও একজন সম্ভাবনাময় চিকিৎসকের স্বপ্ন থমকে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পরিবারের প্রত্যাশা, প্রশাসন ও সমাজের সহানুভূতিশীল মানুষদের সহযোগিতা পেলে তাপস্বীর মত মেধাবী শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে একজন দক্ষ ও মানবিক চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করতে পারবেন।