পর্যটন মৌসুমেও জাহাজ নেই সেন্টমার্টিনে, জীবিকা হারিয়ে বিপর্যস্ত দ্বীপের জনজীবন
অনিন্দ্যসুন্দর দ্বীপ। নেই কোলাহল কিংবা চিরচেনা ব্যস্ততা। বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনের পরিবেশ রক্ষায় গেল মৌসুমের ফেব্রুয়ারি থেকে বন্ধ রয়েছে পর্যটক যাতায়াত। আর দ্বীপটির ‘ছেঁড়াদিয়া’ ও ‘ডিয়ার মাথা’ খ্যাত মিনি সুন্দরবন ফিরে পেয়েছে নতুন প্রাণ। কিন্তু সাগরে মাছ শিকার কিংবা পর্যটন ঘিরে যাদের জীবিকা, সেসব মানুষ আছেন চরম সংকটে। পর্যটন বন্ধ থাকায় জীবিকার প্রধান উৎস হারিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন দ্বীপের প্রায় ১১ থেকে ১২ হাজার বাসিন্দা।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার স্বার্থে গত ১ ফেব্রুয়ারি থেকে সরকার পর্যটকদের জন্য দ্বীপে প্রবেশ বন্ধ ঘোষণা করে। এর পর থেকেই বন্ধ হয়ে যায় হোটেল, রেস্টুরেন্ট, ট্যুর গাইডিংসহ যাবতীয় ব্যবসা-বাণিজ্য। চলতি মাসে কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন নৌরুটে দুটি জাহাজকে প্রশাসন চলাচলের অনুমতি দিলেও গত ২ সপ্তাহেও যায়নি কোনো জাহাজ। ফলে জমছে না ব্যবসা-বাণিজ্য। খাঁ-খাঁ করছে জেটিঘাট। এতে সংকট বেড়েছে দ্বীপে। হতাশ দ্বীপবাসির দাবি, বিধি-নিষেধ শিথিল করা না হলে আর্থিক সংকট আরো বাড়বে মানুষের।
দ্বীপবাসীর অভিযোগ, আগে অক্টোবর থেকেই পর্যটক আসা শুরু হলেও গত বছর থেকে পরিবেশ রক্ষার নামে নানা বিধিনিষেধে থমকে গেছে সেন্টমার্টিন। এবারও নভেম্বরের শুরুতে ভ্রমণ উন্মুক্ত হলেও জাহাজ চলাচল না করায় দেখা নেই পর্যটকের। আগে চার মাস ব্যবসা করে সারা বছর সংসার চললেও এখন মাত্র দুই মাসের আয়েই টিকে থাকতে হচ্ছে। অভাব-অনটনে অনেকেই জীবিকার খোঁজে দ্বীপ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন।
আরও পড়ুন: পর্যটকদের জন্য সেন্ট মার্টিন খুললেও ছেড়ে যায়নি কোনো জাহাজ
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গত মৌসুমে ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ মাসের জন্য বন্ধ হয়ে যায় পর্যটক যাতায়াত। যা অক্টোবর পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে। প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন নানা অনিয়মের কারণে হুমকির মুখে ছিল এখানকার পরিবেশ। অন্যসময় বছরে পর্যটকদের জন্য খোলা থাকতো ৬ মাস। এই মৌসুম থেকে মাত্র ৪ মাসের জন্য খোলা রাখার সিদ্ধান্ত সরকারের। তাও আবার সীমিত পরিসরে। দ্বীপের শত শত পরিবার পেশা হারিয়ে নিদারুণ কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। অধিকাংশ হোটেল ও কটেজের দরজায় তালা ঝুলছে। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন হাজারও কর্মচারী। বাজারে নেই আগের মতো ক্রেতার ভিড়, ব্যবসাও নেই বললেই চলে।
চলতি মাসের ১ তারিখ থেকে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছিল প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিন। পরিকল্পনা ছিল, কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছড়ার বিআইডব্লিউটিএ ঘাট থেকে কর্ণফুলি এক্সপ্রেস ও বার-আউলিয়া নামে দুটি জাহাজ পর্যটকদের নিয়ে দ্বীপটিতে যাবে। তবে শেষ মুহূর্তে মালিকপক্ষ এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছেন। সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক হোসাইন ইসলাম বাহাদুর বলেন, ট্যুরিজম বোর্ডের সফটওয়্যার এখনও চালু হয়নি। আবার দিনে গিয়ে দিনে ফিরে আসার নিয়মে পর্যটক পাওয়া যাবে না। এ কারণে ১ নভেম্বর থেকে কোনো জাহাজ সেন্টমার্টিনে যায়নি। তিনি জানান, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে জাহাজ চালানোর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, নভেম্বর মাসে কেবল দিনের বেলায় ভ্রমণের অনুমতি থাকবে, রাতে থাকা নিষিদ্ধ। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে সীমিত পরিসরে রাত্রিযাপন সম্ভব হবে, আর ফেব্রুয়ারিতে সম্পূর্ণভাবে পর্যটক যাতায়াত বন্ধ থাকবে। প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুইহাজার পর্যটকই দ্বীপে ভ্রমণ করতে পারবেন।
আরও পড়ুন: সেন্ট মার্টিন ভ্রমণে নিয়মনীতির বেড়াজালে হতাশ দ্বীপবাসী
আরও বলা হয়, সেন্টমার্টিনের নাজুক পরিবেশ রক্ষায় একাধিক বিধিনিষেধ জারি করা হয়েছে। দ্বীপে রাতে সৈকতে আলো জ্বালানো, উচ্চ শব্দ সৃষ্টি, বারবিকিউ পার্টি, কেয়া বনে প্রবেশ বা ফল সংগ্রহ ও বিক্রয়, কাছিম-পাখি-প্রবালসহ জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এছাড়া সৈকতে মোটরসাইকেল, সি-বাইক বা অন্য কোনো মোটরচালিত যান চলবে না। নিষিদ্ধ পলিথিন বহন করা যাবে না এবং একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকজাত সামগ্রী- যেমন চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিক চামচ, স্ট্র, সাবান ও শ্যাম্পুর মিনিপ্যাক, ৫০০ ও ১০০০ মিলিলিটারের বোতল-বহন নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পর্যটকদের নিজস্ব পানির ফ্লাস্ক সঙ্গে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
তবে কষ্টে আছেন দ্বীপের বাসিন্দারা। দ্বীপের শত শত পরিবার জীবিকার অনিশ্চয়তায় দিশেহারা। নেই কাজকর্ম, দরজা বন্ধ হোটেল, কটেজ ও রেস্টুরেন্টগুলোর। আবার মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। যার কারণে জেলে পরিবারগুলোর অবস্থাও খারাপ। সবমিলিয়ে নানামুখী সংকটে দ্বীপের বাসিন্দারা। ভ্রমণের মৌসুমে সেন্টমার্টিনের জেটিঘাট মুখর থাকে পর্যটকে। তাদের নিয়ে কর্মব্যস্ত থাকেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কিন্তু এ মৌসুমে ভ্রমণ সীমিত থাকায় বেকার দিন যাচ্ছে তাদের। গত ফেব্রুয়ারির পর থেকে চলাচল বন্ধ রয়েছে সেন্টমার্টিনে। ফলে পর্যটকের ওপর নির্ভর করে চলা স্থানীয় বাসিন্দারা এখন বেকার হয়ে পড়েছেন। সেন্টমার্টিনে পর্যটক না থাকায় কাজও থেমে গেছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। অর্থ সংকটেও এখন দিন যাচ্ছে তাদের। খাবার সংকটে রয়েছে সেখানকার কুকুর ও পোষাপ্রাণীগুলো।
সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দা আরিফুর রহমান জানান, ভালো নাই সেন্টমার্টিন দ্বীপের মানুষ। দিনের খাবার দিনেও পেটে জুটছে না মানুষের। এমন অনেক পরিবার আছে যারা এক বেলা খেলে আরেক বেলা খাবার জুটে না। এই দ্বীপে বসবাসকারী ৩০-৪০ শতাংশ মানুষ এক বেলা খেতে পারলেও আরেক বেলা খেতে পারছে না। আমাদের কান্না দেখার কেউ নাই। পর্যটক আসলে হয়ত কিছুটা স্বস্তি পেতাম। সরকার কি আমাদের কান্না শুনতে পায় না? অভাবের তাড়নায় শিশুরা স্কুল ছাড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উপস্থিতি কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে।
আরও পড়ুন: সেন্ট মার্টিন যেতে পর্যটকদের দিতে হবে ‘ফি’
রফিক আলম নামে দ্বীপের আরেক বাসিন্দা জানান, জীববৈচিত্র্য রক্ষার নামে আমাদের জীবন ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। কাউকে কিছু বলতে পারি না। ইচ্ছে করে বিষ খেয়ে মরতে। এমন জীবন আর ভালো লাগে না। অনেকে গরু-ছাগল, সোনা-গয়না বিক্রি করে বেঁচে আছে। এত খারাপ সময় কখনো আসেনি। মানুষ কাজ না পেয়ে না খেয়ে মরার পথে। এভাবে চলতে থাকলে এখানে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। দ্বীপের মানুষ পুরোপুরি পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল, কিন্তু সেটা এখন বন্ধ।
‘সেভেন স্টার’ রিসোর্টের মালিক দেলোয়ার হোসাইন জানান, এ বছর রিসোর্ট খোলার সম্ভাবনা তেমন নাই। কারণ একটা রিসোর্ট দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর মডিফাই করে খুলতে গেলে মোটা অঙ্কের টাকার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সরকার দুইমাস পর্যটক আসার সুযোগ দিলেও এই অল্প সময়ে লাভ তো দূরের কথা মডিফাই এর জন্য খরচ হওয়া টাকাও তুলতে পারব না। আর এমনভাবে চলতে থাকলে সেন্টমার্টিন বসবাসরত বাসিন্দাদের পাশাপাশি রিসোর্ট মালিকদের রিসোর্ট ছেড়ে দিয়ে চলে আসা ছাড়া বিকল্প কোনো পথ নাই।
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ফয়েজুল ইসলাম জানান, সেন্টমার্টিন এর অবস্থা তেমন ভাল না। স্থানীয়রা দিনে এনে দিনে খাচ্ছে। আয় রোজগার নেই। অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছে। হাটবাজারে লোকজন নেই। আগের মত ব্যবসায়ীদের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে মানবেতর দিনযাপন করছে দ্বীপের মানুষ।
তিনি আরও জানান, মূলত সেন্টিমার্টিনের মানুষের ইনকামের বড় একটা অংশ আসে পর্যটকদের কাছ থেকে। দীর্ঘ নয় মাস দ্বীপে পর্যটক আসা-যাওয়া বন্ধ। খালি পড়ে আছে রিসোর্ট ও হোটেল-মোটেল। নেই কোনো ইনকাম। চলতি মাস থেকে পর্যটক আসার কথা থাকলেও রাত্রে যাপনে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে সরকার। আর রাত্রি যাপন করতে না পারলে স্বাভাবিকভাবে আবাসিক রিসোর্টগুলো আগের মতই অকেজো পড়ে থাকবে। আর পরের দুইমাস রাত্রিযাপন এর নিয়ম থাকলেও, এত অল্প সময়ে সারা বছর এর আয় রোজগার টেনে আনতে হিমশিম খাবে দ্বীপের মানুষ।
প্রসঙ্গত, ৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের দ্বীপটির জনসংখ্যা ১১ থেকে ১২ হাজার। দ্বীপবাসীর জীবিকার অনেকটাই পর্যটন ঘিরে। প্রকৃতি রক্ষার সঙ্গে নিশ্চিত হবে জীবিকার সুরক্ষা। যৌক্তিক সিদ্ধান্তে সগৌরবে টিকে থাকবে অনিন্দ্যসুন্দর সেন্টমার্টিন, স্থানীয়দের চাওয়া এতটুকুই।