কবে ফিরবে জেলেরা, নাফের পাড়ে অপেক্ষায় স্বজনরা
দুপুর দেড়টা। কক্সবাজারের টেকনাফের আকাশে তখন রোদের খাঁ খাঁ তাপ। নাফ নদীর পাড়ে বসে আছেন মাবিয়া খাতুন। পাশে তাঁর ছোট ছেলে চোখে উদ্বেগের ছাপ। দু’জনেই নদীর ওপারে তাকিয়ে আছেন। দূরে মিয়ানমারের পাহাড়ের রেখা। সেই রেখার ওপারে কোথাও বন্দী আছেন তাঁর স্বামী ও দুই ছেলে আরাকান আর্মির হাতে। শনিবার দুপুরে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ জালিয়া পাড়া নাফনদীর পাড়ে দেখা গেছে-এমন দৃশ্য।
নাফের তীরে মাবিয়া খাতুন কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন, ‘প্রতিদিনই এখানে এসে বসি। মনে হয়, হয়তো আজ ফিরবে তারা। নদীর ওই পারে ওদের খুঁজে বেড়ায় আমার চোখ। চোখে অনবরত প্রশ্ন কবে ফিরবে তারা?’ কিন্তু নদী কোনো উত্তর দেয় না। শুধু বাতাসে বয়ে আসে নোনাজল আর অপেক্ষার দীর্ঘশ্বাস।
তিনি আরও বলেন,’সেই দিন সকালে মাছ ধরতে গিয়েছিল। রাতে আর ফেরেনি। নৌকায় আমার স্বামীসহ দুই ছেলে রয়েছে। তাঁরা আরাকান আর্মির হাতে বন্দী রয়েছে। এখন জানি না বেঁচে আছে কি না!’ দুই মাস হয়ে গেছে। তাদের কোন খোঁজ পাচ্ছি না। আমি এখন নি:স্ব হয়ে গেছি। এখন প্রতিদিন দুপুরে তিনি এসে বসেন নাফের তীরে। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকেন নদীর ওপারে, তারপর ফিরে যান নিঃশব্দে। তার মতো অনেকে এখন নাফের পাড়ে অপেক্ষা থাকেন কখন ফিরবে আরাকান আর্মি হাতে বন্দী থাকা স্বজনরা।
স্থানীয় প্রশাসন ও জেলেদের ভাষ্যমতে, নাফনদী ও সাগরে মাছ শিকারের সময় আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে অন্তত ১১৬ জেলেকে আরাকান আর্মি অপহরণ করেছে। বিজিবির তথ্যমতে, চলতি বছরের ৯ মাসে ২৩৫ জেলেকে আটক করেছে আরাকান আর্মি। এর মধ্যে ১২৪ জন ফেরত এসেছেন। আটকা রয়েছেন আরও ১১১ জন, যাদের মধ্যে ৬২ জন রোহিঙ্গা।
র্সবশেষ গত ৩১ আগস্ট সেন্টমার্টিন থেকে তিনটি নৌকাসহ ১৮ জেলেকে অপহরণ করেছিল মিয়ানমারভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মি। তাদের মধ্য ৬৫ বছর বয়সী মদিনা খাতুনের দুই ছেলে ও দুই মেয়ের জামাইও রয়েছে। সেন্টমার্টিনের গলাচিপার বাসিন্দা মদিনা খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে জাহাঙ্গীর আর শাব্বিরকে নিয়ে গেছে আল্লাহ, আমার ছেলেদের ফিরিয়ে দাও। আমি ধন-দৌলত কিছুই চাই না, শুধু আমার ছেলেদের চাই। তার কান্নার সুরে ভেসে যায় সাগরের হাওয়া, আকাশ যেন ভারী হয়ে ওঠে মায়ের আহাজারিতে।
আরেক বন্দি জাহাঙ্গীর আলমের স্ত্রী হুমাইরা বেগম বলেন, ‘গর্ভবতী অবস্থায় আমি এখন চরম অসহায় জীবন কাটাচ্ছি। স্বামী মাছ শিকারে গেলে তবেই পেটে ভাত জোটে। না গেলে অনাহারে থাকতে হয়। তারা দ্রত না ফিরলে আমাদের না খেয়ে মরতে হবে। এখন আমাদের দেখাশোনার কেউ নেই।
এদিকে সাগরে ২২ দি সরকারি মাছ ধরার নিষেজ্ঞায় জেলেদের মাছে জেলে পল্লীদের অবসর সময় পার করছে। ফলে টেকনাফ পৌরসভার কাযুকখালিয়া ঘাট ও শাহপরীর দ্বীপ জালিয়াপাড়া-ঘোলারচর ঘাটে নৌঘাটগুলোতে সারি বেঁধে নোঙর করা হয়েছে মাছ ধরার নৌযান। ঘাটে জেলেদের পরিচিত ভিড়ও নেই। কয়েকজন শ্রমিক নৌযান পাহারা দিচ্ছেন। আর কিছু জেলেকে জাল মেরামত করতে দেখা যায়।
শাহপরীর দ্বীপ ঘাটে কথা হয় হাফেজ উল্লাহ নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে। তিনি বলেন, এখন মাছ ধরা বন্ধ কিন্তু আমাদের ভয় হচ্ছে মিয়ানমারের আরাকান আর্মির। তারা (আরাকান আর্মি) আমাদের প্রধান বাধা হয়ে দাড়িয়েছে। তাদের হাতে আমার বাবাসহ এখনো শতাধিকের বেশি জেলে বন্দী রয়েছে। যাদের ফেরা অনিশ্চিত হয়ে পরেছে। ফলে আমরা সবাই চিন্তিত রয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার স্ত্রী নিয়ে আমরা দুজই চট্রগ্রামে এশিয়ান গামেন্টে চাকরিজীবী ছিলাম। তখন দাদন নিয়ে বাবাকে একটা মাছ ধরার নৌকা কিনে দিয়েছিলাম। কিন্তু কিছু দিন যেতে না যেতে নৌকাসহ পরিবারের তিন সদস্যকে ধরে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি। এখন দাদনের টাকা দিতে না পেরে চাকরি চলে গেছে। এখন আমরার পুরো পরিবার পথে নেমে এসেছে। তার চেয়ে বড় কষ্ট হচ্ছে আরাকান আর্মি তাদের ছেড়ে দিচ্ছে না।
স্থানীয় জেলেরা জানান, এ ঘটনায় উপকূলজুড়ে আতঙ্ক বিরাজ করছে। পরিবারগুলো দিন কাটাচ্ছে অনিশ্চয়তায়। গত দুই মাস হয়ে গেলেও তাদের স্বজনরা জানে না আটকা রাখা জেলেরা কেমন আছেন। এ নিয়ে জেলেদের পরিবারের মাঝে আতঙ্কের দিন কাটচ্ছে।
টেকনাফ কায়ুকখালীয়া ফিশিং ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি সাজেদ আহমদ বলেন, ‘আরাকান আর্মির হাতে আমাদের শতাধিক জেলে আটকা রয়েছে। তাদের ফেরা নিয়ে আমরা খুব চিন্তিত। সরকারের কাছে আমাদের দাবি রয়েছে যাতে জেলেদের দ্রত ফেরত আনা হয়। পাশাপাশি সাগর আর নাফনদীতে যাতে মাছ শিকারের সময় এ ধরনের ঘটনা না ঘটে সেজন্য প্রদক্ষেন গ্রহন করা উচিত।
জানতে চাইলে টেকনাফের ইউএনও শেখ এহসান উদ্দিন বলেন, ‘আরাকান আর্মির হাতে আটক জেলেদের ফেরত আনার চেষ্টা চলছে। মিয়ানমারের জলসীমায় মূলত মাছ বেশি পাওয়া যায়, যে কারণে জেলেরা ওই সীমানায় ঢুকে পড়েন। এসময় জেলেদের আটক করা হয়। তাই আমরা এ বিষয়ে জেলেদের সচেতন করছি।
রামু বিজিবি সেক্টর কমান্ডার মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগে বাধা থাকায় জেলেদের ফেরাতে কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। তবে আমাদের চেষ্টা চলছে যাতে জেলেদের কিভাবে দ্রুত ফেরত আনা যায়।’