মানসিক ভারসাম্য হারালেও কোরআন ভোলেননি রাশিদুল
গাইবান্ধার এক প্রত্যন্ত গ্রামে এক আশ্চর্য মানুষের গল্প। যিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন, কিন্তু ভোলেননি মুখস্থ করা পবিত্র কোরআন। তার সুমধুর তেলাওয়াত আজও মুগ্ধ করে এলাকাবাসীকে। একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা তাকে করে তুলেছে ‘পাগল হাফেজ’ হিসেবে পরিচিত।
রাশিদুল ইসলামের বাবা মৃত জবেদ আলী ও মা রাশেদা বেগম। আশির দশকের শেষভাগে তিস্তা নদীর ভাঙনে তাদের ভিটেমাটি বিলীন হয়ে যায়। জীবিকার সন্ধানে তারা গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমান। সেখানে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন জবেদ আলী। দারিদ্র্যের মধ্যেও তিনি তাঁর তিন ছেলেকেই ভর্তি করিয়েছিলেন একটি হাফেজিয়া মাদরাসায়। স্বপ্ন ছিল ছেলেরা হাফেজ হবে।
রাশিদুল ছিলেন বড় ছেলে। তিনি ও তাঁর দুই ভাই মাদরাসায় পড়াশোনা করছিলেন। রাশিদুল ইতিমধ্যেই কোরআনের বেশ কিছু পারা মুখস্থও করেছিলেন। কিন্তু একদিন ছোট্ট একটি দুর্ঘটনা বদলে দেয় তাঁর জীবন।
এক সকালে বাড়িতে তিন ভাই দুষ্টুমি করছিলেন। এতে রাগান্বিত হয়ে বাবা জবেদ আলী রাশিদুলের পিঠে একটি পিঁড়ি (ছোট বেঞ্চ) দিয়ে আঘাত করেন। কিন্তু সেটি পিঠে না লেগে সরাসরি লাগে তাঁর মাথায়। এই আঘাতই তাঁর জীবনের জন্য হয়ে দাঁড়ায় অভিশাপ।
এরপর থেকেই রাশিদুল মানসিক ভারসাম্য হারান। তাঁকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় এবং কয়েক মাস চিকিৎসার পর তিনি কিছুটা সুস্থও হন। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণে ধারাবাহিকভাবে ওষুধ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে ওষুধ বন্ধ হলেই তাঁর অবস্থার আবার অবনতি ঘটে।
বর্তমানে রাশিদুলের জীবনযাপন দেখলে যে কেউ কষ্ট পাবেন। ফজরের নামাজের পর তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে যান। সারাদিন পথে পথে ঘুরে বেড়ান। তাঁর হাতে সব সময় থাকে একটি ছেঁড়া পুরনো কোরআন শরিফ। যখন-তখন, যেখানে-সেখানে তিনি বসে পড়েন এবং সুললিত কণ্ঠে তেলাওয়াত শুরু করেন। তাঁর এই তেলাওয়াত শুনে পথচারীরা পর্যন্ত মুগ্ধ হন।
সন্ধ্যা কিংবা গভীর রাত পর্যন্ত তিনি বাড়ি ফেরেন না। ফিরে মায়ের রেখে দেওয়া খাবার খেয়ে আবার কোরআন তেলাওয়াত শুরু করেন। একটি ছেঁড়া মশারির নিচে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি।
তাঁর ছোট ভাই মাসুদ বলেন, ‘আমার ভাই কারও কোনো ক্ষতি করে না। তার এ দুরবস্থা দেখে আমাদের খুব কষ্ট হয়। চিকিৎসা করানো খুব জরুরি, কিন্তু আমাদের অর্থাভাব।’
রাশিদুলের মা রাশেদা বেগম মনোবেদনায় ভেঙে পড়েছেন। তিনি বলেন, "ওর বাবার একটি আঘাতেই আমার ছেলের এমন হলো। পয়সা নেই বলে ভালো চিকিৎসাও করাতে পারছি না।"
প্রতিবেশীরা জানান, রাশিদুল নিয়মিত চিকিৎসা ও ওষুধ পেলে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন। তাঁরা আশা প্রকাশ করেন, যদি সরকারি বা বেসরকারিভাবে তাঁকে সাহায্য করা হয়, তাহলে তিনি শুধু নিজেই সুস্থ হবেন না, বরং তাঁর সুমধুর কণ্ঠে তেলাওয়াত শুনতে পাবে অনেকেই, এমনকি অন্যদের কোরআন শেখাবেনও।
রাশিদুল ইসলামের করুণ জীবন গল্প স্থানীয়ভাবে বেশ আলোচিত। মানসিক ভারসাম্য না থাকলেও আল্লাহর বাণী যে তিনি ভোলেননি, তা তাঁকে করে তুলেছে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব। তাঁর চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের জন্য এখন সহায়তা জরুরি।