ডাক্তারি-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে না গিয়ে কেন বিসিএসে তরুণরা?
দেশে মেডিক্যাল, বিশ্ববিদ্যালয় ও ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করা শিক্ষার্থীদের মাঝে বিসিএস দেওয়ার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু ডাক্তারি, শিক্ষকতা কিম্বা ইঞ্জিরিয়ারিংয়ের মতো সম্মানজনক পেশা বাদ দিয়ে কেন উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের মাঝে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার প্রবণতা বাড়ছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে সর্ব মহলে। অনেকেই জীবনে সফল হওয়া বলতেই বোঝেন ‘বিসিএস ক্যাডার’ হওয়া। দেশের চাকরির বাজারে চারদিকে এখন শুধু বিসিএসের জয়ধ্বনি! তাই, প্রশ্ন উঠছে কেন উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের মাঝে বিসিএস হিরিক বাড়ছে?
সম্প্রতি এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেইসবুকে উদ্বেগ জানিয়ে পোস্ট করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন। তিনি লিখেছেন, ‘যেই দেশে ডাক্তারি আর মাস্টারি ছেড়ে বিসিএস-এ যায় সেই দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের স্বাস্থ্য কেমন তা কি বলার দরকার আছে?’
বিসিএস করা বিভিন্ন পেশাজীবী গ্রুপের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, ৩৬তম বিসিএসে দুই হাজার ৩২৩ প্রার্থীকে ক্যাডার পদের জন্য সুপারিশ করে পিএসসি। এর মধ্যে শতাধিক ডাক্তার, প্রকৌশলী ও কৃষিবিদ নিজ পেশায় না গিয়ে প্রশাসন, পররাষ্ট্র বা পুলিশ ক্যাডারে যোগদান করেছেন। শতাংশের হিসাবে তা প্রায় ৪.৩০। ৩৭তম বিসিএসে এক হাজার ৩১৪ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়, যাঁদের মধ্যে বিশেষায়িত শিক্ষাগ্রহণকারী প্রায় ৮০ জন অন্য ক্যাডারে সুপারিশ পেয়েছেন, যা মোট সুপারিশপ্রাপ্তের প্রায় ৬.০৮ শতাংশ। আর সর্বশেষ ৩৮তম বিসিএসে দুই হাজার ২০৪ জন প্রার্থীকে ক্যাডার পদের জন্য সুপারিশ করে পিএসসি। সাধারণ ক্যাডারের ৬১৩ জনের মধ্যে প্রায় ১৭০ জন ডাক্তার-প্রকৌশলী-কৃষিবিদসহ বিশেষায়িত প্রার্থী। মোট ক্যাডার পদের হিসাবে এই হার প্রায় ৭.৭১ শতাংশ।
৩৮তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশের পর দেখা যায়, ২৪টি ক্যাডারে দুই হাজার ২০৪ জনকে নিয়োগের সুপারিশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। এর মধ্যে পররাষ্ট্র ক্যাডারে যে ২৫ জন প্রার্থীকে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে সাতজনই বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাস করেছেন। আর ১৩ জন পাস করেছেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তাঁদের ১০ জনই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ছিলেন। অন্যদের মধ্যে একজন রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট), একজন খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) এবং আরেকজন অন্য একটি প্রকৌশল শিক্ষার প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সূত্র জানায়, একটি সাধারণ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একজন শিক্ষার্থীর পেছনে রাষ্ট্র অনেক বেশি ব্যয় করে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলে পাঁচ বছরের কোর্স। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীপ্রতি ব্যয় করেছিল তিন লাখ ৮০ হাজার টাকা। অন্যদিকে বুয়েটের ব্যয় ছিল দুই লাখ ৩২ হাজার টাকা। আর ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় ছিল যথাক্রমে এক লাখ ৮০ হাজার ও এক লাখ ২০ হাজার টাকা।
সূত্র মতে, এক প্রকৌশলীর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলে খরচ হয় তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা। অনেক সময় তার চাইতেও বেশি। এছাড়া সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় প্রতি শিক্ষার্থীদের পেছনে অন্তত ১০লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়।
তারপরও কেন মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা বিসিএস দিয়ে পেশা পরিবর্তন করছে? এবিষয়ে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমগুলোয় উঠে আসা তথ্যে জানা যায়, চাকরির নিরাপত্তা, বেতন-ভাতার সুবিধা, সামাজিক প্রভাব ও সম্মান বা পরিবারের ইচ্ছায় পেশা পরিবর্তন করছেন।
চিকিৎসক কেন হতে চান না
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে এক লাখের বেশি চিকিৎসক নিবন্ধন নিয়েছেন। বর্তমানে সরাসরি চিকিৎসা পেশায় যুক্ত এমন চিকিৎসকের সংখ্যা (সরকারি ও বেসরকারি) ৬০-৭০ হাজার। এর মধ্যে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক রয়েছেন মাত্র ২৫-৩০ হাজার। কিন্তু দেশের জনসংখ্যা ও রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় কমপক্ষে দুই লাখ চিকিৎসক প্রয়োজন।
সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ সূত্র অনুযায়ী, দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজে পাঁচ বছরের এমবিবিএস ডিগ্রি নিতে একজন শিক্ষার্থীর ব্যয় হয় ১৫-১৮ লাখ টাকা। সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে প্রতি শিক্ষার্থীর পেছনে সরকারের ব্যয় ১০ লাখ টাকার অধিক। এমন পরিস্থিতিতে মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের দিন দিন অন্য পেশায় চলে যাওয়া দেশের জন্য কোনোভাবেই মঙ্গলজনক নয়।
স্বাস্থ্য ক্যাডারের শুরুতে প্রথমে একজন ডাক্তারকে নিয়োগ দেওয়া হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখানে নেই কোনো গাড়ির সুবিধা, ভাড়ায় থাকতে হয় সরকারি কোয়ার্টারে। ব্যক্তিগত সহকারী ও আলাদা কোনো অফিস থাকে না। পদোন্নতির জন্য প্রয়োজন হয় পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রির, যা শেষ করতে লাগে ১৪-১৫ বছর।
অন্যদিকে প্রশাসন ক্যাডারে চাকরির শুরুতে মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব, ডিসি অফিসের কর্মকর্তা, এসি ল্যান্ড হিসেবে যোগদানের সুযোগ রয়েছে। রয়েছে ধারাবাহিক পদোন্নতির সুযোগ, গাড়ি-বাড়ির সুবিধা, গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণে মাসিক টাকাও পান তাঁরা। ব্যক্তিগত সহকারী, পাওয়া যায় আলাদা অফিসও। আর ইউএনও হলে সরকারি বাংলো ও গাড়ির সুবিধা তো রয়েছেই। পদোন্নতি পেলে মন্ত্রিপরিষদ সচিবও হতে পারেন। রয়েছে স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়ার সুযোগ, প্রেষণে আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজের সুযোগও রয়েছে।
এসব বৈষম্যের কারণে ডাক্তারদের স্বাস্থ্য ক্যাডার ছেড়ে অন্য ক্যাডারে যোগ দিতে বাধ্য করছে বা অন্যরা সহজেই প্রলুব্ধ হচ্ছেন বলে মনে করেন বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) মহাসচিব ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী।
চিকিৎসা পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় যাওয়াকে ‘স্বাভাবিক’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, চিকিৎসা পেশায় মেধাবী শিক্ষার্থীরা আসলেও তারা যথাযথ মর্যাদা পাচ্ছেন না। এ কারণে মেডিকেল শিক্ষার্থীরা চিকিৎসা পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। একজন প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তা বিসিএস পাস করে যোগ দেয়ার পর পর্যায়ক্রমে তার পদোন্নতি হতে থাকে। অথচ একজন চিকিৎসকের পোস্ট গ্রাজুয়েট না করলে পদোন্নতি হয় না। চার বছরের কোর্স শেষ করতে অনেক সময় আট থেকে দশ বছর লেগে যায়। এ কারণে বাধ্য হয়ে সে অন্য ক্যাডার বেছে নিচ্ছে।
চিকিৎসকরা মেধাবী শিক্ষার্থী হওয়ার পরও প্রশাসন ক্যাডারের অধীনস্থ হয়ে থাকতে হয় এটি তাদের জন্য অমর্যাদাপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ কারণে মেডিকেল শিক্ষার্থীরা সম্মানজনক পেশা বেছে নিচ্ছেন। একজন উপসচিব হয়ে যে সুযোগ-সুবিধা পাবেন, ৩০ বছর পর একজন চিকিৎসক অধ্যাপক হয়ে সে সুযোগ-সুবিধা পান না। এছাড়া বর্তমান করোনা মহামারির কারণে অনেকে এ পেশা থেকে সরে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন।
তিনি আরও বলেন, বিষয়টি নিয়ে এখনই চিন্তা করার সময় এসেছে। সরকার যদি এটাকে গুরুত্ব না দেয় তাহলে ভবিষ্যতে নিম্ন গ্রেডের শিক্ষার্থীরা চিকিৎসা পেশায় আসবেন। এতে দেশের মানুষ ভালো চিকিৎসক থেকে বঞ্চিত হবেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান খানের ভাষ্য মতে, বর্তমানে ৪০ হাজার ডাক্তারের তেমন কোনো চাকরি নেই। বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতেও ডাক্তারদের সুবিধা খুবই কম।
কেন ইঞ্জিনিয়ারিং পেশা ছাড়ছেন
কুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী তারেক লতিফ সামি গত ৩৮তম বিসিএস-এ পুলিশ ক্যাডার হিসেবে যোগ দিয়েছেন। তিনি কুয়েট থেকে পাস করার পর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেন। সেখানে কাজ করে তার উপলব্ধি হয় যে, এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নেই।
তিনি জানান, প্রতিষ্ঠান কখনও লোকসানের মুখে পড়লে ঢালাওভাবে সবার চাকরি যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, ছাঁটাই হয়। তা আপনি যতো ভালো কাজ করুন না কেন।
এতো ঝুঁকি মাথায় নিয়ে কাজ করা সত্ত্বেও মাস শেষে যে বেতন পেতেন তা যথেষ্ট ছিল না। তার সাথে পড়া অন্যান্য প্রকৌশলীদের অবস্থা ছিল আরও শোচনীয়।
তিনি বলেন, ‘আইটি-তে আগের চাইতে বেতন কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু সেটাও সরকারি চাকরির তুলনায় অনেক কম। তবে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়া অনেকেই দেখেছি মাত্র ১৫ হাজার টাকার বেতনে যোগ দিতে। কারণ কোনো চাকরি নেই।’
সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, ‘কম্পিউটার সায়েন্সে পড়া শিক্ষার্থীদের সামনে দুটো পথ থাকে। এক হল, তারা দেশের প্রাইভেট ফার্মগুলোয় কাজ করতে পারে। না হলে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়ে সেখানে সেটেল হতে পারে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দেশেই থাকবো।’
এমন বাস্তবতার মুখে পুলিশ ফার্স্ট চয়েস দিয়ে ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেন সামি। তিনি এখন একজন পুলিশ ক্যাডার।
সামি বলেন, ‘পুলিশের আইটি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এখন কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। বিশেষ করে সাইবার ক্রাইমে এই বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন হয়। আমি সেটাই করছি।’
বাংলাদেশে আইসিটি ক্যাডার পদে সুযোগ সৃষ্টির কথা বলা হলেও সেটা আজ পর্যন্ত চালু হয়নি। বরং টেলিকমিউনিকেশন ক্যাডার পদে নিয়োগের প্রক্রিয়া ২০০৭ সালেই বন্ধ করে দেয়া হয়। এমন অবস্থায় জেনারেল ক্যাডার বেছে নেন তিনি।
শিক্ষকতায় আগ্রহ কেন কম
পেশাগত সম্মানি, সামাজিক মর্যাদা ও নানাবিধ সুযোগ সুবিধায় অন্যান্য সরকারি চাকরির তুলনায় শিক্ষকতা এখনও অনেক অবহেলিত থাকায় দেশের মেধাবী তরুণরা এই পেশা আসছেন না। অন্যদিকে যারা এই পেশায় আসছেন তাদের জন্যও নেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ। এ কারণে শিক্ষকদের মানের ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। মানের পাশাপাশি আছে সম্মান আর সম্মানীর প্রশ্নও। বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে, মর্যাদার দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের শিক্ষকদের অবস্থান সবার নিচে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে শিক্ষকেরা মানে ও গুণে উপেক্ষিতই থাকছেন। বিসিএস -এ শিক্ষা ক্যাডার থাকলেও পছন্দের তালিকায় তা সবার নিচে অবস্থান করছে।
শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করেন, মান সম্পন্ন শিক্ষকের অভাব এবং শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত না করে শিক্ষার ক্ষতি পুষিয়ে উঠা সম্ভব হবে না। ব্রিটেনভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চের ২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা যায়, চীনের ৮১ শতাংশ শিক্ষার্থী বিশ্বাস করে, শিক্ষকদের সম্মান করতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে এই গড় মাত্র ৩৫ শতাংশ। চীন, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, রাশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, তুরস্ক, ভারত, নিউজিল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা অনেক ওপরে। আন্তর্জাতিকভাবে যেসব প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা হয়, সেখানে এসব দেশের শিক্ষার্থী সবচেয়ে ভালো করছে। তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, মর্যাদা আছে বলে ভালো শিক্ষক পাওয়া এবং ধরে রাখাও সহজ হয় এসব দেশে।
শিক্ষক, বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, মান ও মর্যাদা শব্দ দুটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মর্যাদা বেশি থাকলে মানসম্পন্নরা সেই পেশায় আসেন। কিন্তু দেশের প্রাথমিক শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। মাধ্যমিকের শিক্ষকরা তাঁদের বেতন-ভাতা নিয়ে মোটেই সন্তুষ্ট নন। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে হলে এখন দলীয়করণ, স্বজনপ্রীতি, আর্থিক লেনদেনই এক নম্বর যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়। ফলে মেধাবীদের শিক্ষকতা পেশায় আসার সুযোগ নেই বললেই চলে।
শিক্ষকতা পেশা মোটেই আকর্ষণীয় না হওয়ার কারণে দেশে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসছেন না। বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০-এ শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর কথা বলা হলেও গত ১১ বছরে তা বাস্তবায়ন করা হয়নি।
প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে তুলনা করলে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা বেতনের দিক থেকে বেশ পিছিয়ে আছেন। বাংলাদেশে একজন প্রভাষকের মূল বেতন ২২ হাজার টাকা, সহকারী অধ্যাপকের ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা, সহযোগী অধ্যাপকের ৫০ হাজার টাকা এবং অধ্যাপকের ৬৪ হাজার ৬০০ টাকা। তবে ভারতসহ পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে প্রভাষকের পদ নেই। সহকারী অধ্যাপকই শুরুর ধাপ। বেতন তুলনা ও ক্যারিয়ার সংস্থান বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘স্যালারি এক্সপ্লোরার’-এর তথ্য মতে, ভারতে একজন সহকারী অধ্যাপকের মূল বেতন ৪৭ হাজার ৩০৪ রুপি, সিনিয়র স্কেল প্রাপ্ত সহকারী অধ্যাপকের ৫৬ হাজার ৪৮০ রুপি, সহযোগী অধ্যাপকের এক লাখ সাত হাজার ৭৪৮ রুপি এবং অধ্যাপকদের এক লাখ ১৬ হাজার ৭০ রুপি। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন আরো বেশি।
সরকারি প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকরা এখনো তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। তাঁরা ১৩তম গ্রেডে ১১ হাজার টাকার স্কেলে বেতন পান সাকল্যে ১৯ হাজার টাকা। প্রতিবেশী ভারতে প্রাথমিকের এই পদমর্যাদার শিক্ষকদের বেতন বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। আর এমপিওভুক্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকরা শুরুতে ১১তম গ্রেডে ১২ হাজার ৫০০ টাকা মূল বেতনের সঙ্গে এক হাজার টাকা বাড়িভাড়া ও ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পান। প্রায় সাত হাজার নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষক-কর্মচারী, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ের কলেজের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষক এবং স্বতন্ত্র ইবতেদায়ি মাদরাসার প্রায় ২০ হাজার শিক্ষক সরকারি বেতন পান না।
২০১৮ সালে সর্বশেষ প্রকাশিত মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের একাডেমিক সুপারভিশন রিপোর্টে মাধ্যমিকের শিক্ষকদের দুরাবস্থার চিত্র ফুটে ওঠে। সেখানে বলা হয়, ৪০.৮১ শতাংশ শিক্ষক নিজেরা সৃজনশীল প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে পারেন না। ৫৯.১৯ শতাংশ শিক্ষক নিজেরা প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে পারেন। অন্য বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহায়তায় প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন ২৫.৯৯ শতাংশ শিক্ষক। আর বাইরে থেকে প্রশ্নপত্র কিনে আনেন ১৪.৮৩ শতাংশ শিক্ষক।
যার ফলে দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরা পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে নিচ্ছেন না। এর সামগ্রিক ক্ষতির শিকার হচ্ছে দেশের শিক্ষা খাত।