করোনায় আটকে আছে সরকারি ৬০ হাজার নিয়োগ

করোনায় হতাশ চাকরি প্রার্থী
করোনায় হতাশ চাকরি প্রার্থী  © ফাইল ছবি

করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকেই চাকরির বাজারে চলছে মন্দা। এই সময়ে সরকারি ও বেসরকারি চাকরির নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ ও পরীক্ষা গ্রহণ হচ্ছে না বললেই চলে। বিশেষ করে, সরকারি চাকরির বেশ কয়েকটি পদের নিয়োগ পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হলেও করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় সেসব স্থগিত করেছে নিজ নিজ নিয়োগ কর্তৃপক্ষ।

দেখা গেছে, করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের প্রায় ৬০ হাজার ২২৮টি পদের নিয়োগ আটকে আছে। এ নিয়ে চরম হতাশায় আছেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। তাদের অধিকাংশই বেকারত্বের বোঝা টানতে টানতে এখন ক্লান্ত। এই করোনায় চার বিসিএসসহ আটকে আছে নন-ক্যাডার ও অন্যান্য নিয়োগ।

চার বিসিএস আটকে

৪০তম বিসিএস: ৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয় গত ২৭ জানুয়ারি। এই বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল গত ১৬ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় মৌখিক পরীক্ষা এখনও শুরু হয়নি। এ বিসিএসে শূন্য পদ ছিল ১ হাজার ৯০৩।

৪১তম বিসিএস: চলতি বছরের ১৯ মার্চ দেশের আটটি বিভাগীয় শহরে একযোগে ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। তবে এখনও প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল প্রকাশ হয়নি। এই বিসিএসে পদের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ১৬৬টি।

৪২তম বিসিএস: স্বাস্থ্য ক্যাডারে সহকারী সার্জন নিয়োগের জন্য ৪২তম (বিশেষ) বিসিএস পরীক্ষা আয়োজন করা হয়। কিন্তু এই নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষা আটকে আছে করোনার কারণে। ৬ জুন থেকে মৌখিক পরীক্ষা শুরু হলেও স্থগিত করা হয় ২৭ জুন থেকে। বিশেষ এই বিসিএসে পদের সংখ্যা ২ হাজার।

৪৩তম বিসিএস: ৪৩তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় গত বছরের ৩০ নভেম্বর। এই বিসিএসের মাধ্যমে বিভিন্ন ক্যাডারে ১ হাজার ৮১৪ জনকে নিয়োগ দেয়ার কথা। ইতোমধ্যে এই বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেছে পিএসসি। এক দফা পিছিয়ে প্রিলির তারিখ নির্ধারণ করা হয় আগামী ২৯ অক্টোবর।

আটকে থাকা বিসিএসগুলো নিয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (ক্যাডার) নূর আহমদ বলেন, করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় তিনটি বিসিএসের কার্যক্রম আটকে আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই যত দ্রুত সম্ভব এ বিসিএসগুলোর কার্যক্রম শেষ করা হবে। আর অফিস খুললেই দ্রুততম সময়ের মধ্যে ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফল দেয়া হবে।

পরীক্ষা না হওয়ায় হতাশ হয়ে পড়েছেন চাকরিপ্রত্যাশী অনেকেই।

নন-ক্যাডারে নিয়োগ

সিনিয়র স্টাফ নার্স: স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের সিনিয়র স্টাফ নার্স পদের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় গত ২৮ জানুয়ারি। এতে উত্তীর্ণ হন ১৫ হাজার ২২৮ জন। এরপর গত ১১ জুন উত্তীর্ণদের লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এখনও লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়নি। প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে সিনিয়র স্টাফ নার্সে পদের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৫০০। তবে সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, আড়াই হাজার নয়, সিনিয়র স্টাফ নার্স পদে পিএসসিতে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে ৮ হাজার ৫৩৪ জনের জন্য।

এ ছাড়া, সরকারি কর্মচারী হাসপাতালের ৫৪ জন সিনিয়র স্টাফ নার্স নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয় গত ২ মে। এ পদের মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল ২৬ জুন ও ৩ জুলাই। কিন্তু গত ২৩ মে মৌখিক পরীক্ষা স্থগিত করে পিএসসি।

এর বাইরেও পরিবেশ অধিদপ্তরের সাতটি সিনিয়র টেকনিশিয়ান পদের লিখিত পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল গত ৮ জুলাই। কিন্তু গত ২৩ জুন এই পরীক্ষা স্থগিত করে পিএসসি।

এ ছাড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তোষাখানা ইউনিটের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা পদের সাঁটলিপি ও কম্পিউটার মুদ্রাক্ষর গতি পরীক্ষা এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীন বস্ত্র অধিদপ্তরের ফোরম্যান নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষাও স্থগিত করেছে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক (নন ক্যাডার) মো. নজরুল ইসলাম বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের সিনিয়র স্টাফ নার্স পদের লিখিত পরীক্ষার খাতা দেখা হচ্ছে। আর বেশ কয়েকটি মৌখিক ও লিখিত পরীক্ষা করোনা সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় স্থগিত করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই স্থগিত পরীক্ষাগুলোর নতুন তারিখ ঘোষণা করা হবে।

অন্যান্য চাকরিতে নিয়োগ

জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) সহকারী পরিচালকসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয় গত ১ জানুয়ারি। বিজ্ঞপ্তিতে মোট ৯৯০ জন নিয়োগের কথা বলা হয়েছে।

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় গত বছরের ২০ অক্টোবর। বিজ্ঞপ্তিতে ৩২ হাজার ৫৭৭ জন সহকারী শিক্ষক নিয়োগের কথা বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতির কারণে সবকিছু আটকে আছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই পরীক্ষা নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। আমরা ইতোমধ্যে পরীক্ষা নেয়ার জন্য বেশ কিছু কাজ শেষ করে রেখেছি।’

মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর গত বছরের ২২ অক্টোবর প্রদর্শক, গবেষণা সহকারীসহ মোট ৪ হাজার ৩২টি পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেয়। এ বিজ্ঞপ্তি থেকে চারটি পদের (বুক স্টার ৪৬টি পদ, নিরাপত্তা প্রহরী ২৫৫, মালী ১০০, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ১৬৩) পরীক্ষা এ বছরের ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়। এখনও ৩ হাজার ৪৬৮টি পদের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়নি।

আটকে থাকা পরীক্ষাগুলো নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই পর্যায়ক্রমে পরীক্ষাগুলো নেয়া হবে।

খাদ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় ২০১৮ সালের ১১ জুলাই। বিজ্ঞপ্তিতে উপ-খাদ্য পরিদর্শকসহ বিভিন্ন পদে মোট ১ হাজার ১৬৬ জন নিয়োগের কথা উল্লেখ ছিল। এর মধ্যে ১৩১টি পদের পরীক্ষা নেয়া হয় গত বছরের ৩১ অক্টোবর। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় বাকি ১০ পদের ১ হাজার ৩৫টি নিয়োগের পরীক্ষা এখনও নেয়া সম্ভব হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘করোনা পরিস্থিতি অবনতি হওয়ার কারণে ১ হাজার ৩৫টি পদের পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি। পরীক্ষা নেয়ার জন্য আমাদের সকল প্রস্তুতিই সম্পন্ন করা হয়েছে।’

সিলেট গ্যাসফিল্ডের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় গত বছরের ২৪ আগস্ট। বিজ্ঞপ্তিতে সহকারী ব্যবস্থাপকসহ বিভিন্ন পদে মোট ১০৪ জন নিয়োগের কথা উল্লেখ রয়েছে।

পেট্রোবাংলায় বিভিন্ন পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় চলতি বছরের ১৬ মে। বিজ্ঞপ্তিতে সহকারী ব্যবস্থাপকসহ মোট ১১৫টি পদের কথা উল্লেখ রয়েছে।

তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি সহকারী কর্মকর্তা পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর। বিজ্ঞপ্তিতে মোট ২২ পদে নিয়োগের কথা বলা হয়েছে।

কম্পটোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেলের কার্যালয়ের অডিটর নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৮ তারিখ। বিজ্ঞপ্তিতে অডিটরসহ মোট ৩২৩টি পদে নিয়োগের কথা বলা হয়। এ বছরের ২৬ জুন এ নিয়োগ পরীক্ষা নেয়ার সব কার্যক্রম শেষ করলেও পরবর্তী সময়ে করোনার কারণে তা স্থগিত করা হয়।

হিসাব মহানিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের অডিটর, জুনিয়র অডিটরসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় গত বছরের ৫ এপ্রিল। বিজ্ঞপ্তিতে বিভিন্ন পদে মোট ১ হাজার ৯০১টি পদের কথা উল্লেখ রয়েছে।

বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় চলতি বছরের ৩ মে। বিজ্ঞপ্তিতে মোট ৩১৭ পদে লোক নিয়োগের কথা বলা হয়েছে।

শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষকসহ ১২টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর। বিজ্ঞপ্তিতে মোট ১ হাজার ১৯৪টি পদে লোক নিয়োগের কথা বলা হয়েছে।

বাংলাদেশ জুডিশিয়ারি সার্ভিস কমিশন গত ১৯ জানুয়ারি সহকারী জজ পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিজ্ঞপ্তিতে মোট ১০০টি পদের কথা উল্লেখ করা হয়।

বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ গত ২১ মে কয়েকটি পদে ১০টি গ্রুপে মোট ১ হাজার ৬০৪টি পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি করা হয়। বরাবরের মতো এবারও বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে একাধিক গ্রুপ আছে। গ্রুপ অনুসারে আলাদা পরীক্ষা হবে।

এসব পরীক্ষার সবগুলোর ক্ষেত্রেই বলা হচ্ছে, চলমান করোনা পরিস্থিতির কারণে নিয়োগ কার্যক্রম এগিয়ে নেয়া যাচ্ছে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই শুরু হবে নিয়োগ কার্যক্রম।

এদিকে সূত্র মতে, প্রশাসনের ১৮ লাখ ৮৫ হাজার ৮৬৮টি পদের মধ্যে ৩ লাখ ৮০ হাজার ৯৫৫টি পদ শূন্য। জনপ্রশাসন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিসংখ্যান নিয়ে প্রকাশিত স্ট্যাটিসটিকস অফ সিভিল অফিসার্স অ্যান্ড স্টাফস-২০২০ বই থেকে এ তথ্য জানা যায়।

সংগৃহীত

 


সর্বশেষ সংবাদ