ইন্টারভিউ, চাকরি এবং বিসিএস নিয়ে কিছু কথা
আমার দেশের (বা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে যেকোনো দেশের) চাকরির নিয়ম হওয়া উচিত মেধা ও যোগ্যতাভিত্তিক। কোনো অ্যাকাউন্ট্যান্টকে আমি চাকরিতে নিলে আমি পরীক্ষা করব ওর অ্যাকাউন্টিং বিদ্যা কত দূর। ‘প্রোডাক্টের ওপর ডিসকাউন্ট কি রেভেন্যু থেকে কাটা যাবে নাকি কষ্ট অফ গুডস সোল্ড অ্যাকাউন্ট থেকে?’ এই বিষয়ে ওর পড়াশোনা কত দূর, কী কী সার্টিফিকেট আছে ইত্যাদি ইত্যাদি যাচাই–বাছাই করব। সেটাই স্বাভাবিক নিয়ম হওয়া উচিত। এ ছাড়া ও আমার কর্পোরেট কালচারের সঙ্গে মানাতে পারবে কি না, ওকে ম্যানেজ করা কঠিন হবে কি না, ইত্যাদি বিষয় বুঝে নিতে হবে কথাবার্তার ধরণ থেকে। এইটাই সভ্য দেশে স্বাভাবিক ইন্টারভিউর নিয়ম।
যেমন আমি এ মাস থেকেই নতুন কোম্পানিতে নতুন চাকরি শুরু করেছি। আগের কোম্পানির সঙ্গে সাড়ে সাত বছরের মধুর সম্পর্কের সমাপ্তি আমি নিজেই টেনেছি। কেন? কারণ, আমার আগের কোম্পানি অন্য আরেকটা কোম্পানির কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। কর্পোরেট আমেরিকার অতি সাধারণ ঘটনা। বড় মাছ ছোট মাছকে খেয়ে ফেলে। এত দিন আমরা অন্য কোম্পানিকে কিনতে কিনতে বড় হয়েছি, এবার আমরাই শিকার হয়েছি।
তা এসব ক্ষেত্রে প্রথমেই যে ব্যাপারটা ঘটে তা হচ্ছে, নতুন ম্যানেজমেন্ট এসে কিছু পুরোনো কর্মী ছাঁটাই করে। ওপরের লেভেলের ম্যানেজমেন্ট অদলবদল করে। আপনি খুবই ভাগ্যবান হলে আপনার চাকরির কিছু হবে না। কিন্তু সেটা অনেকটা ভাগ্য নিয়ে লটারির মতো হয়ে যায়। এ জন্য আমি আমার ইমোশনকে কাবু করে নতুন চাকরি খুঁজে সরে পড়েছি। এ ছাড়া এটাও মাথায় রাখতে হবে, এই মুহূর্তে ইকোনমির অবস্থা খুব খারাপ। চাইলেই চাকরি খুঁজে পাওয়া যায় না। আমি সাড়ে সাত বছরের প্রেম দেখিয়ে অফিসের সঙ্গে থেকে গেলাম, তারপর ওরা আমাকে বিদায় বলে দিল, তখন চাকরি খুঁজে পাওয়া কঠিন হতেও পারে। এই রিস্কে আর গেলাম না।
তা আমার চাকরির ইন্টারভিউ হয়েছে ফোনে। করোনা মহামারির কারণে স্বাভাবিকভাবেই এখন সবাই বাড়ি থেকে কাজ করছে। সাধারণত লোকজন জুম ইন্টারভিউ করে। কিন্তু যেদিন আমার ইন্টারভিউ ছিল, সেদিন ডালাসে তুষার ঝড়ে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় ফোনে ইন্টারভিউ হয়েছে।
তরুণদের জন্য চাকরির বাজার বাড়ছে না। তবে প্রতিবছর হাজারো চাকরিপ্রত্যাশী তরুণের মধ্যে কেউ কেউ দক্ষতা দেখিয়ে চাকরি পেলেও একটি বড় অংশ দরকারি নানা দক্ষতার অভাবে চাকরি পাচ্ছে না।
তরুণদের জন্য চাকরির বাজার বাড়ছে না। তবে প্রতিবছর হাজারো চাকরিপ্রত্যাশী তরুণের মধ্যে কেউ কেউ দক্ষতা দেখিয়ে চাকরি পেলেও একটি বড় অংশ দরকারি নানা দক্ষতার অভাবে চাকরি পাচ্ছে না।
নানা বিষয় নিয়ে কথা হলো। তাঁরা কী কী সফটওয়্যার দিয়ে কাজ করে, আমরা কী কী দিয়ে কাজ করি, ওদের অফিস পরিবেশ কেমন, আমারটা কেমন ইত্যাদি ইত্যাদি। যেহেতু এখন অনেকেই চাকরির ইন্টারভিউ দেন বা নেন, সেহেতু নিজের অভিজ্ঞতার কিছু জরুরি অংশ শেয়ার করছি। আশা করি কাজে আসবে। আমার এসেছে। আলহামদুলিল্লাহ! সবই আল্লাহর ইচ্ছা। এই পুরো ঘটনা নিয়ে আলাদা করে আরেকটা লেখা লিখবো। আপাতত এই আজকের বিষয়ে ফোকাসড থাকি। তা মাত্র দুটি ইন্টারভিউ দিয়েই একটাতে পেয়ে গেছি। অপরটিতে ঠিক ফেইল করিনি। ম্যানেজার সরাসরিই বলেছেন, ‘তোমাকে আমার খুব ভালো লেগেছে, কিন্তু আমরা এমন অ্যাকাউন্ট্যান্ট চাইছি, যার সফটওয়্যার ডেভেলপারদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে। সহজ ভাষায় একাউন্টেন্ট+বিজনেস এনালিস্ট।’
ইদানীং এই অভিজ্ঞতার লোকদের খুব ডিমান্ড আছে। কেউ যদি এখনো পড়াশোনা শেষ না করে থাকেন, তাহলে বলব অ্যাকাউন্টিং ফাইন্যান্সের সঙ্গে টুকটাক কম্পিউটার রিলেটেড কোর্সও মাইনর হিসেবে করে নিতে পারেন। SQL কোড ল্যাঙ্গুয়েজ শিখে ফেলুন। এই ফিল্ডের ভবিষ্যৎ ওদিকেই যাচ্ছে।
ইন্টারভিউর একটি অতি কমন প্রশ্ন হলো, ‘তোমার সম্পর্কে কিছু বলো।’
আপাতদৃষ্টিতে অতি নিষ্পাপ প্রশ্ন মনে হলেও এখানে একটি ট্রিক থাকে। আপনি যদি আপনার বউ–বাচ্চা পোষা প্রাণী সংসারের আলাপ শুরু করে দেন, তাহলে কিন্তু আপনি বাদ। আপনাকে আপনার সম্পর্কে বলতে হলে অবশ্যই আপনার প্রফেশন নিয়ে বলতে হবে। আপনার পড়াশোনা, ক্যারিয়ার, সফলতা, ব্যর্থতা এবং ব্যর্থতা কীভাবে কাটিয়ে উঠেছেন ইত্যাদি নিয়ে বলতে হবে। ভুলেও ব্যক্তিগত আলাপ শুরু করে দিয়েন না। এমন কিছু বলবেন না যা কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। যেমন আপনি ফিকশন রাইটার, বাজারে আপনার বই আছে। আপনার গল্প লোকজন মেরে দিয়েছে। কিন্তু তার সঙ্গে অ্যাকাউন্টিংয়ের কোনোই যোগাযোগ নেই। ম্যানেজারের কিছুই যায় আসে না তাতে। তাই এই বিষয়টা তোলার প্রয়োজন নেই। তবে হ্যাঁ, যদি ম্যানেজার নিজে থেকেই বলেন যে তিনি ফিকশন বই পড়তে পছন্দ করেন, তখন এই প্রসঙ্গ তুলতে যেন না ভোলেন।
আবার আপনি এতই পণ্ডিত ব্যক্তি যে অ্যাকাউন্টিংয়ের ওপর কোনো বই লিখেছেন ‘সহজ ভাষায় অ্যাকাউন্টিং’ ‘অ্যাকাউন্টিংয়ের খুঁটিনাটি’ বা এই জাতীয় কিছু। তখন কিন্তু আপনার প্রাইমারি ফোকাসই হবে এই বইয়ের প্রসঙ্গ তোলা এবং এই নিয়ে গল্প করা। কারণ ‘আপনাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ’!
বোঝাতে পেরেছি?
আরেকটি সাধারণ প্রশ্ন তোমার স্ট্রেন্থ এবং উইকনেসেস কী?
আপনি যদি বলেন, আমার কোনো দুর্বলতা নেই, তাহলে এরা ধরেই নেবে আপনি আপনার দুর্বলতা স্বীকার করতেই ইচ্ছুক না। কাজেই আপনি বাদ। আপনাকে অবশ্যই আপনার দুর্বলতা (প্রফেশনাল হতে হবে, যদি বলে বসেন ‘সুন্দরী নারীর হাসিই আমার দুর্বলতা’ তাহলে পত্রপাঠ বিদায়) স্বীকার করতে হবে এবং একই সঙ্গে সেই দুর্বলতা ঢাকতে আপনি কী কী কাজ করেছেন, সেটা বলতে হবে। যেমন আপনি বলতে পারেন, আমি অমুক তমুক সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করিনি কখনো। তাই আমি কিছু ক্লাস নিয়েছি, শিখছি এবং আশা করি আগামী কয়েক সপ্তাহেই আমি আয়ত্ত করে ফেলব।
‘শক্তি’ কী? সেটার জবাব দেবেন ওরা কী চাইছে, সেটার ওপর ভিত্তি করে। যেমন ওরা চাইছে এমন কাউকে যে এক্সেলে ওস্তাদ। আপনি এক্সেলের ফর্মুলা, পিভট ইত্যাদি ভাজা ভাজা করা পাবলিক। আপনি সেটা ধরেই এগোবেন। ওরা চাইছে টিম প্লেয়ার। আপনি নিজেও দলবদ্ধভাবে কাজ করতে পছন্দ করেন। আপনি সেটা বলবেন। পারবেন না? জব রিকোয়ারমেন্ট ভালো করে পড়ে নেবেন এ ক্ষেত্রে।
আরেকটি সাধারণ প্রশ্ন, আমাদের এখানে কেন জয়েন করতে চান?
এর উত্তরে জীবনেও বলবেন না যে, আমার একটা চাকরি দরকার। বাড়িতে অসুস্থ মা, অবিবাহিত বোন, রিটায়ার্ড পিতা আছে। সংসারের হাল আমার কাঁধে। আজকে সকালে নাশতা করে আসিনি...। এসব ইমোশনাল কথাবার্তা ইন্ডিয়ান আইডল জাতীয় অনুষ্ঠানের পাবলিক খুব খায়, প্রফেশনাল জগতে এর ভ্যালু শূন্য।
আমি শুনেছি তোমরা নাকি ভালো বেতন-ভাতা দাও...এই জাতীয় কথাবার্তাও বলবেন না। আপনাকে ভাববে লোভী। সুযোগ পেলেই অন্য কোথাও দৌড় দেবেন।
এ প্রশ্নের জবাবটা দেবেন এভাবে, ‘আমার ধারণা আমার অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা দুইটাই এই কাজের জন্য যথোপযুক্ত। কারণ...। ‘‘আমি এই প্রতিষ্ঠানে চাকরির ব্যাপারে উচ্ছ্বসিত কারণ এটা আমাকে (এইটা সেটা) করার সুযোগ দেবে...(প্রফেশন রিলেটেড যেন কারণ হয়। যদি বলেন এই চাকরির পাশাপাশি আমি নাটক থিয়েটার লেখালেখি করতে পারব, তাহলে বিদায়।)’’ ঠিক এই কারণেই ইন্টারভিউর আগে অবশ্যই কোম্পানি সম্পর্কেও কিছু ধারণা নিয়ে যাবেন। গুগলের যুগে যা খুবই সহজ। আর পরিচিত কেউ যদি কোম্পানিতে কাজ করে, তাহলে তো কথাই নেই।’
আপনাকে প্রশ্ন করতে বললে বলবেন, ‘আমাকে হায়ার করলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে আমার থেকে তোমার কি এক্সপেক্টেশন?’ তারপরের প্রশ্ন করবেন, ‘কী করলে এই পদে দ্রুত উন্নতি করা যায়?’
কোম্পানির শেয়ারের মূল্য, প্রোডাক্ট ইত্যাদি নিয়ে কথাবার্তা বলতে পারেন। তাহলে বুঝবে আপনি ভালোই রিসার্চ করা সিরিয়াস পাবলিক। যেমন এক এইটিন হুইলার (বিশালাকৃতির ট্রাক) তৈরির কোম্পানিতে একবার শখের বসে ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘দুনিয়া এখন শিফট করছে ইলেকট্রিক গাড়ির দিকে। তোমাদের এই সম্পর্কে পদক্ষেপ কী? তোমরা কি এখনো ডিজেলের ইঞ্জিনই বানাবে? নাকি তোমরাও ব্যাটারিচালিত মোটরের পরিকল্পনা করছ?’
ইন্টারভিউ নিচ্ছিলেন অ্যাকাউন্টিং ম্যানেজার। এই প্রশ্নের গভীরতায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে। এই আঁতলামি প্রশ্ন সে আশা করেনি। আমিও শুধু শুধুই জিজ্ঞেস করেছি। আমার কি ঠ্যাকা কে ব্যাটারি গাড়ি বানাইল আর কে ডিজেলের? কিন্তু ইন্টারভিউতে এসব দেখাতে হবে।
উত্তরে সে বলেছে, ‘ব্রাদার আস্কড এ ভেরি গুড কোয়েশ্চেন! সঠিক উত্তরটা আমার জানা নেই।’
এই প্রশ্নটাই চাকরির দৌড়ে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। শুধু ওয়াশিংটনে তিন মাস গিয়ে ট্রেনিং নিতে হবে যখন আমার বউ প্রেগন্যান্ট, তাই ওটাতে আর এগোনো হয়নি। আর ঠিক তখনই আমার তখনকার কোম্পানি আমাকে আরও কিছু নতুন দায়িত্ব দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল আমাকে নিয়ে তাঁদের দীর্ঘ পরিকল্পনা আছে। তাই আমিও মার্কেট থেকে নিজেকে সরিয়ে ফেলেছিলাম।
তরুণদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে ব্যাংকের চাকরি
আমার কারেন্ট বস আমাকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করল। ‘আমাদের দলে বেশির ভাগই মেয়ে। তোমার কোনো অসুবিধা নেই তো মেয়েদের সঙ্গে কাজের ব্যাপারে?’
সে এই প্রশ্নটা করেছে, তার মানে এই বিষয়ে তাঁকে এর আগে ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। এবং সেই সঙ্গে এটি ‘বিহেভিয়র’ প্রশ্নও বটে। যেমন অনেকেই সিচুয়েশন দিয়ে বলবে, ‘ধর কোনো এমপ্লয়ির সঙ্গে তোমার বনে না। কিন্তু তোমাদের একই টিমে কাজ করতে হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে তুমি হলে কী করবে?’
এ ব্যাপারে কিছু কথা বলার আছে আমার।
আমার আগের অফিসের আগের বস ছিল একটা মেয়ে। বয়সে আমার চেয়ে কম, কিন্তু অভিজ্ঞতায় আমার চেয়ে অনেক বেশি। আমি করপোরেট অ্যাকাউন্টিংয়ের মাত্র একটি শাখায় কাজ করে অভ্যস্ত। আর সে পাবলিক অ্যাকাউন্টিং করায় বিভিন্ন কোম্পানির বিভিন্ন শাখায় কাজ করার অভিজ্ঞতা রাখে। এখন আমার জায়গায় এমন অনেকেই আছে, যারা এই বিষয়টাকে না মেনে কেবল বয়স এবং লিঙ্গের ওপর ফোকাস করে বলবে, ‘আজকে আমি সুন্দরী ব্লন্ড হলে আমার প্রমোশন হতো।’
‘একটা মেয়ের আন্ডারে কাজ করতে হবে?’
কিংবা আরও নোংরা কিছু বলত।
শুধু দেশিদের এই দোষ দেব না। আমাদের সঙ্গেই কাজ করত এক শ্বেতাঙ্গিনী মহিলা, তাঁরও এ স্বভাব ছিল। তাঁর চেয়ে কম বয়সী একটি মেয়ে কীভাবে তাঁর আগে প্রমোশন পেয়ে গেল, সেটা মানতে পারছিল না। এইটা সব যুগে সব সমাজের মানুষের মাঝেই বিদ্যমান।
‘আজ আমার গায়ের রং সাদা না বলে...’
‘আজ আমি হিন্দু/মুসলিম/খ্রিষ্টান/বৌদ্ধ বলে...’
‘আজ আমি পুরুষ/নারী বলে...’
ঘটনার শুরু সেই আদম-ইবলিস যুগে। হজরত আদমকে (আ.) তাঁর জ্ঞান ও অন্যান্য নানা গুণের কারণে সম্মান করতে বলায় ইবলিস কী বলেছিল?
‘আমি আগুনের তৈরি আর ও মাটির!’
চাকরির ক্ষেত্রে এই ব্যাপারগুলো আপনাকে মানতেই হবে। যদি দেখেন চাকরিতে আপনার প্রমোশন হয়নি, তাহলে অভিযোগ তোলার আগে চিন্তা করবেন কী করলে আপনার প্রমোশন হতো। যেমন ধরেন আমি নিজেই আপাতত ম্যানেজমেন্টে যেতে আগ্রহী না। আরও তিন–চার বছর অপেক্ষা করতে চাই। প্রধান কারণ আমার দুই বাচ্চাই ছোট। সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টার বেশি কাজ করতে গেলে এই দুইটাকে সময় দিতে পারব না। ম্যানেজারের দায়িত্ব হচ্ছে নিজের অধীন কর্মচারীদের কাজগুলো ঠিকঠাকমতো হচ্ছে কি না, সেটা নিশ্চিত করা। মানে নিজের কাজের পাশাপাশি অন্যের কাজও করা। আপনি খুব লাকি হলে আপনার অধীন কর্মচারীরা খুব চৌকস হবে। আপনার ওপরও লোড কম থাকবে।
কিন্তু যদি কেউ দুর্বল হয়, তখন? তখন দ্বিগুণ সময় নষ্ট হবে এর পেছনে। আর দিন শেষে যদি আপনার টিমের কোনো ভুলত্রুটি হয়, সেটার জন্য দোষী কিন্তু আপনি। এই কারণেই দেখবেন বিদেশে একটা সড়ক/নৌ দুর্ঘটনার কারণেও মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত পদত্যাগ করে ফেলে। আর আমাদের অভ্যাস হচ্ছে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে হাত ধুয়ে ফেলা। সেটা করতে পারবেন না। আপনার দায়িত্ব হচ্ছে কাজ শেষ করা। প্রয়োজনে আপনাকে দিন–রাত ২৪ ঘণ্টা কাজ করে হলেও সেটা শেষ করতে হবে। না হলে বিদায়।
আমি সপ্তাহে ৪০–৫০ ঘণ্টা কাজ করতেই বিরক্ত হয়ে যাই, যেখানে আমার নিজেরই বন্ধুবান্ধব আছে, যারা ৭০–৮০–৯০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করে।
আপনাকে দেখতে হবে যে প্রমোশন পেল, সে কি এসব করতে রাজি আছে কি না। আমার এক ভিপি, সিনিয়র ভিপি দুইটাই ছিল কাজপাগলা। এতটাই যে সংসার পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছে। আপনি সেই কমিটমেন্টের জন্য প্রস্তুত কি না। ‘আমি বাঙালি বলে আমার প্রমোশন হয়নি’— জাতীয় আহ্লাদী কথাবার্তা খুবই ফালতু শোনায়। গুগল, মাইক্রোসফট, মাস্টারকার্ড, এলবার্টসন্স, পেপসির (সাবেক) ইত্যাদির সিইও সব ভারতীয়। ওরাও মাইনরিটি। আপনার সঙ্গে ওদের পার্থক্য হচ্ছে, তাঁরা এই আহ্লাদী না করে কাজে ফোকাস করেছে, ফল পেয়েছে।
ইন্টারভিউর সময় আমার পরামর্শ হচ্ছে, আপনি সৎ থাকার চেষ্টা করবেন। অনেকেই অনেক কুপরামর্শ দিয়ে বোঝাবে যে চাপা মারতে, কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বলি, কেউ যদি কোনো এক্সপার্টের সামনে চাপা মারতে শুরু করে, তাহলে খুব সহজেই ধরা পড়ে এবং তখন আপনার অন্যান্য বিষয়ে দুনিয়া উল্টে ফেলা ক্রেডিট থাকলেও আপনাকে ওরা একটা বাটপার হিসেবেই দেখবে এবং বাদ দেবে।
ধরেন, আপনি জীবনেও এপিকর নিয়ে কাজ করেননি। জব রিকোয়ার্মেন্টে দেখলেন আমরা এপিকর এক্সপার্ট খুঁজছি। আপনি সেটা দেখেই রেজুমেতে লিখে বসলেন আপনার দুই বছরের অভিজ্ঞতা আছে এপিকর নিয়ে কাজ করার। আমরা আপনাকে ইন্টারভিউতে ডাকলাম। আমি স্পেসিফিক্যালি আপনাকে প্রশ্ন করব জানুয়ারি ২০২০ সালে একটা ইনভয়েস রেকর্ড করা হয়েছে কি না, সেটা কীভাবে খুঁজে বের করবেন?
আপনার অভিজ্ঞতা থাকলে আপনি সহজেই বলতে পারবেন তারিখ উল্লেখ করে ‘মাল্টি কোম্পানি জার্নাল ডিটেইল’ থেকে বের করে ফেলবেন। আর আপনি চাপাবাজ হলে ভুগিচুগি বোঝানোর চেষ্টা করবেন, যা বুঝতে আমার বিন্দুমাত্র সময় লাগবে না। মাঝ দিয়ে আপনি আমার এবং আপনার সময় নষ্ট করবেন।
বরং এই ধরণের প্রশ্নের উত্তরে বলবেন, ‘এপিকর নিয়ে কাজ আমি করিনি, তবে আমি ইও৩৬০ দিয়ে কাজ করেছি। সেখানে আমরা এইভাবে বের করতাম। আমি নিশ্চিত, এপিকরেও সেভাবেই কোনো উপায় আছে, কারণ আমি মনে করি প্রতিটা সফটওয়্যারই মোটামুটি কাছাকাছি প্রোগ্রামিং ও লজিক দিয়েই তৈরি হয়। শুধু বাটনগুলো এখানে ওখানে আলাদা আলাদা ট্যাবে থাকে।’
তাহলে ম্যানেজার বুঝে নেবেন আপনাকে কাজ শেখাতে তাঁর কতটুকু পরিশ্রম লাগবে। তিনি আপনাকে এই অভিজ্ঞতার কারণে নিয়ে নিতেও পারেন। যদি না অন্যান্য ক্যান্ডিডেটদের মধ্যে কারোর সরাসরি এপিকরে কাজ করার অভিজ্ঞতা না থাকে।
এটুকু বোঝাতে পেরেছি?
আরও অনেকে অনেক প্রশ্ন পেয়ে থাকেন। কমেন্টে সেসব লিখতে পারেন। যদি কমন পড়ে, অবশ্যই উত্তর দেব। না পারলে আমি নিজেই শিখতে আগ্রহী হব।
আমার দেশের একটা ব্যাপারে আমার খুব আফসোস হয়। চাকরির ক্ষেত্রে আমরা ধর্ম, আচার, রীতিনীতি, সাধারণ জ্ঞান ইত্যাদি বাহ্যিক বিষয় নিয়ে এত বেশি মেতে থাকি যে মূল বিষয়টাতেই ফোকাস করতে পারি না। যে করবে কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ের কাজ, ইন্টারভিউতে তাঁকে জিজ্ঞেস করি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাবির নাম কী ছিল। যে করবে ফাইন্যান্সের চাকরি, যাকে জিন্দেগিতে ক্লায়েন্ট ফেস করতে হবে না, তাঁর স্পোকেন ইংলিশ পরীক্ষা করি। আরে ভাই, আমেরিকাতেই স্পোকেন ইংলিশ নিয়ে ঝামেলায় পড়তে হয় না যতটা বাংলাদেশে ইন্টারভিউ দিতে গেলে পড়তে হয়। আমরা মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়ে দিলাম, তারপর উর্দুর বদলে ইংলিশকে এলিট ক্লাসের ভাষা বানায় ফেললাম। বাংলার তকদির সেই বায়ান্নতে যা ছিল, তাই থেকে গেল! অদ্ভুত!
হালের সেনসেশন বিসিএস নিয়ে কিছু বলার ইচ্ছাও নেই। যে পাঁচ বছর কষ্ট করে মেডিকেল পড়ল, যে বুয়েটসহ অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ল, সে কোনো নদীর কয়টা শাখা নদী আর কোনো প্রাচীন পাণ্ডুলিপি কোনো গোয়ালঘরে পাওয়া গেল ইত্যাদি মুখস্থ করে আমলা পদে অ্যাপ্লাই করে! একজন সরকারি মেডিকেল ডাক্তার, যে রোগীর চিকিৎসা করবে, সে পদ্মা নদীর উৎস, গতিপথ ইত্যাদি জেনে কী করবে? আমাকে লজিক্যালি বোঝানোর একটু চেষ্টা করুন, দেখি বুঝতে পারি কি না। রোগীর রোগের সঙ্গে গঙ্গোত্রীর সম্পর্কটা ঠিক কোথায়? ঠিক এ কারণেই মেধা থাকার পরও আমরা জ্ঞান–বিজ্ঞানে বিশ্বে অনেক পিছিয়ে আছি। কেন? কারণ আমরা মুখস্থ বিদ্যা দিয়ে মস্তিষ্কের ক্ষমতা ক্ষয় করি, উদ্ভাবনী বা সৃজনশীলতা দিয়ে নয়। শার্লক হোমসের সেই বিখ্যাত যুক্তি আমরা ভুলে যাই। ‘মানুষের মস্তিষ্ক একটি খালি কামরার মতো। বুদ্ধিমান ব্যক্তি সেই ঘরে সুন্দর সুন্দর আসবাব দিয়ে সাজায়। আর মূর্খ সেটাকে আলতুফালতু জঞ্জাল দিয়ে গুদামঘর বানিয়ে ফেলে।’
এনি ওয়েজ, যার দেশে যেমন রীতি। সবাই ভালো থাকলেই হলো।
মনজুর চৌধুরী, ডালাস, আমেরিকা