বিসিএস: এক আসনের বিপরীতে ২২০ জন, ঝরে পড়াদের কী হবে?

শিক্ষার্থী
শিক্ষার্থী  © ফাইল ফটো

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস -বিসিএস পরীক্ষায় যারা ঝরে যান তাদের বেশিরভাগের বিকল্প ক্যারিয়ার পরিকল্পনা না থাকায় এক পর্যায়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এমন অবস্থায় কেবল বিসিএস-কেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা না রেখে নিজেকে অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোর জন্য প্রস্তুত করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশে উচ্চতর ডিগ্রী শেষে বেশিরভাগ তরুণদের ক্যারিয়ারের লক্ষ্য থাকে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস -বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে ক্যাডার হওয়া।

এবারে ৪১ তম বিসিএস-এ দুই হাজার ১৬৬ শূন্য পদের জন্য পরীক্ষা দিয়েছেন প্রায় পৌনে পাঁচ লাখ পরীক্ষার্থী, যা বিসিএসে রেকর্ড। অর্থাৎ একটি আসনের বিপরীতে গড়ে ২২০ জন পরীক্ষা দিয়েছেন। এসব শিক্ষার্থীর একটি বড় অংশ বিসিএস-এর প্রস্তুতি নিতে গিয়ে অন্য কোন দিকে ক্যারিয়ার এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন না। ফলে অকৃতকার্য হলে তারা দিশেহারা হয়ে পড়েন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নম্রতা তালুকদার তার অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার পরিবর্তে গত কয়েক বছর ধরে ৪১তম বিসিএস এর প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। এবারের চেষ্টায় ঝরে পড়লেও সামনের আরও তিন চার বছর এই বিসিএস এর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন মিস. তালুকদার। তিনি বলেন, ‘‘অন্যান্য পেশায় যারা আছে তারা বেতন, কাজের পরিবেশ নিয়ে বেশ হতাশ। আর বাংলাদেশে স্বচ্ছলভাবে, সম্মানের সাথে থাকতে গেলে বিসিএস বেস্ট অপশন। এটা ঠিক যে এখানে প্রতিযোগিতা, এজন্য আমাদের মাইন্ডসেট থাকে যে এর পেছনে নিরবিচ্ছিন্নভাবে তিন থেকে চার বছর লেগে থাকতে হবে।’’

মূলত ২০১৫ সালে সরকারি চাকরির নতুন বেতন স্কেল ঘোষণার পরই ভালো বেতন, চাকরির নিশ্চয়তা, অন্যান্য সুযোগ সুবিধা ও সম্মান-এমন আরও নানা দিক বিবেচনায় শিক্ষার্থীরা তাদের ক্যারিয়ারের মূল লক্ষ্য রাখছে বিসিএস-কে। তাদের মতে সরকারি চাকরির এসব সুবিধা বেসরকারি চাকরিতে নেই, আবার ব্যবসাতেও রয়েছে ঝুঁকি। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকৌশল, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, কৃষি ইত্যাদি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেও যারা শুধু বিসিএস এর পেছনে ছুটছেন তাদের পেছনে ব্যয়কৃত সরকারি খরচের পুরোটাই অপচয় হচ্ছে, এবং একে রাষ্ট্রীয় ক্ষতি হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।

তবে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্ততকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি- বিজিএমই-এর সভাপতি এবং স্টারলিং গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিদ্দিকুর রহমান বলছেন, কেউ দক্ষ হলে বাংলাদেশের সরকারি চাকরির মতো বেসরকারি সেক্টরেও ক্যারিয়ার এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের দেশে অনেক ইন্ডাস্ট্রি হচ্ছে। এসব খাতে আমাদের টেকনিক্যালি দক্ষ জনবলের প্রয়োজন হয়। এখানে বেতনও ভালো, সুযোগ সুবিধাও দেয়া হয়। কেউ যদি ওইসব পদের জন্য নিজেকে দক্ষ করে তোলে, তাহলে তাদের ক্যারিয়ারে এগিয়ে যাওয়া বলেন বা সম্মান সবটাই পাবে।’’

তবে কেউ যদি পড়াশোনা শেষে শুধুমাত্র বিসিএস এর প্রস্তুতি নেয়ার পেছনে দীর্ঘসময় পড়ে থাকে। এবং দিনশেষে অকৃতকার্য হয়ে, কিংবা মনোমতো পদ না পেয়ে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চেষ্টা করে, তাহলে তার কাজের ওই বিরতি ক্যারিয়ারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে জানান মি.রহমান। ‘‘কারও যদি লেখাপড়ার পর গ্যাপ হয়, সেটা কিন্তু নিয়োগদাতারা পছন্দ করে না। ধরে নেয়া হয় যে তার নিশ্চয়ই দক্ষতার অভাব আছে। যার কারণে সে এতদিন বেকার ছিল। এগুলো ম্যাটার করে। এ কারণে শিক্ষার্থীদের উচিত প্রাইভেট সেক্টরের জন্যও নিজেদের প্রস্তুত করে তোলা। যেন তার সময় নষ্ট না হয়।’’ তিনি বলেন।

বাংলাদেশের সরকারি কর্ম কমিশন-পিএসসি প্রতি বছর একটি বিসিএস শেষ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও এর পেছনে তিন থেকে চার বছর লেগে যাচ্ছে। এই সময়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা শেষে কাজে যোগ দেয়ার কথা থাকলেও এই দীর্ঘ সময় ধরেই তারা সবকিছু ছেড়ে বিসিএস এর প্রস্তুতি নিয়ে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি বাইরে টেবিল পেতে শিক্ষার্থীদের বিসিএস প্রস্তুতি সেটাই স্পষ্ট করে। তাদের মধ্যে যারা বিসিএসে সুযোগ পান না, তারা অন্য পেশাতেও পিছিয়ে হতাশ হয়ে পড়েন। তাই ক্যারিয়ারের লক্ষ্য শুধুমাত্র বিসিএস-কেন্দ্রিক না রেখে বেসরকারি আরও নানা ক্ষেত্রে নিজেকে যোগ্য করে তোলা কিংবা উদ্যোক্তা হওয়ার ব্যাপারে জোর দিয়েছেন ব্র্যাকের হিউম্যান রিসোর্সের পরিচালক শারমিন সুলতান জয়া। এক্ষেত্রে পরিবার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ভূমিকার রাখারও আহ্বান জানান তিনি।

একজন শিক্ষার্থীর উচিত থার্ড ইয়ার বা ফাইনাল ইয়ার থেকেই তাদের ক্যারিয়ার গোল ঠিক করা। বিশ্বে কোন ক্যারিয়ারের কদর বাড়ছে, বাংলাদেশের কোন খাতগুলো সম্ভাবনাময়, কোন কোন খাতে বিনিয়োগ বাড়বে, জনবল প্রয়োজন হবে, এসব তথ্য যাচাই বাছাই করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে তিনি জানান। মিস জয়া বলেন, ‘‘যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার মতো যোগ্য করে তোলা খুব জরুরি। এতে করে আপনি যদি বিসিএসে চান্স না-ও পান, আপনার হাতে অন্য অপশন আছে।’’ চাইলে কেউ নিজেই উদ্যোক্তা হতে পারেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের অনেক স্টার্টআপ কোম্পানি বিশ্বমানের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। যেমন, পাঠাও, ইভ্যালি। তাই সরকারি চাকরিই করতে হবে এই চিন্তাধারা থেকে বেরিয়ে যেকোনো কাজ করার ব্যাপারে নিজেকে দক্ষ করে তুলতে হবে।’’

গত বছরের এপ্রিলে ৪১তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে সেটি স্থগিত হয়ে যায়। এবারে সংক্রমণের উর্ধ্বমুখীতার মধ্যেই পরীক্ষা নেয়া হয়। এছাড়া ৪০তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে। গত ২৬শে ফেব্রুয়ারি হয়ে গেল ৪২তমের প্রিলিমিনারি।সামনের অগাস্ট মাসে ৪৩তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি হওয়ার কথা রয়েছে।-বিবিসি বাংলা


সর্বশেষ সংবাদ