বয়স বাড়ানোর উদ্যোগ নেই, হতাশায় চাকরিপ্রার্থীরা
সোহরাব নাজমুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কয়েকটি পরীক্ষায় টিকেছেনও। চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে চাকরি হয়ে যাবে বলেও বিশ্বাস ছিল তার। কিন্তু করোনাভাইরাস তার সবকিছু ওলট-পালট করে দিয়েছে। এখন চাকরি না পেলে ভবিষ্যতে কী হবে, তা নিয়ে চিন্তিত তিনি।
সোহরাব নাজমুল তীব্র হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘সামনের জানুয়ারি মাসে বয়স শেষ হয়ে যাবে। প্রস্তুতিও শেষ করে এনেছিলাম। কিন্তু করোনার কারণে সব শেষ হয়ে গেল। একদিকে বয়স শেষের দিকে, অন্যদিকে করোনায় চাকরির বিজ্ঞপ্তি বন্ধ। এখন চাকরির বয়স না বাড়ালে আমার সব আশা শেষ হয়ে যাবে।’
গত বছরের শেষদিকে বিশ্বে করোনাভাইরাসের বিস্তার শুরু হয়। বাংলাদেশে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় চলতি বছরের মার্চে। এরপর বন্ধ করে দেওয়া হয় সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কার্যক্রম সীমিত বা বন্ধ হয়ে যায় সরকারি ও বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের। ফলে নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়াও বন্ধ হয়ে যায়।
জানা গেছে, চলতি বছরের শুরুর দু‘তিন মাসে কয়েকটি চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ পেলেও মার্চ থেকে প্রায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। সরকারি চাকরির হাতেগোনা কয়েকটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ পেলেও তাতে সবার আবেদন করার সুযোগ ছিল না। আর বেসরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তি তো বন্ধ হয়েছেই, সঙ্গে ব্যাপকভাবে ছাটাই শুরু হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠান ছাটাই না করলেও অর্ধেক বেতন দিয়ে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে নিচ্ছে।
এ অবস্থায় ভবিষ্যত নিয়ে চরম দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়ে গেছেন চাকরিপ্রার্থীরা। তারা বলছেন, অনেকে চাকরির জন্য তাদের সব প্রস্তুতি শেষ করে এনেছিলেন। চলতি বছর চাকরি পাবেন বলেও আশায় ছিলেন। কিন্তু করোনাভাইরাস তাদের সব আশা শেষ করে দিয়েছে। নতুন চাকরির বিজ্ঞপ্তি না পেলে তাদের আর কিছু করার থাকবে না।
চাকরিপ্রার্থীরা বলেন, করোনাকালে অনেকের বয়স শেষ হয়ে যাবে। এ অবস্থায় মহামারির কথা বিবেচনা করে বয়স না বাড়ালে তাদের হতাশার শেষ থাকবে না। অনেককে চাকরি না পেলে বাড়িতে ফিরে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে তাদের সামাজিক মর্যাদা নষ্ট হবে বলেও জানিয়েছেন তারা।
চাকরিপ্রার্থী এনায়েত আনু বলেন, ‘করোনার কারণে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে গেল। একেতো সার্কুলার নেই, অন্যদিকে অনেকে বয়স শেষের দিকে। করোনায় যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে সরকার দুইভাবে সমাধান করতে পারে। হয় আগামী ছয় মাস থেকে এক বছরের সার্কুলার ২০১৯-২০ সাল ধরে দিতে হবে। অথবা চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়িয়ে দিতে হবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত চাকরিপ্রার্থীরা পুষিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবেন।’
করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে বিশ্বের সব দেশ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে কর্মসংস্থানে। বাংলাদেশে করোনার প্রভাব বেশি পড়েছে তরুণ (১৫-২৪ বছর) জনগোষ্ঠীর ওপর। দেশের প্রায় ২৮ লাখ তরুণ কর্মসংস্থান হারিয়েছে বলে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) যৌথ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
‘ট্যাকলিং দ্য কভিড-১৯ ইয়ুথ ইমপ্লয়মেন্ট ক্রাইসিস ইন এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিক’ শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, করোনা মহামারিতে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তরুণ জনগোষ্ঠী মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। এ অঞ্চলের ২২ কোটি তরুণের কর্মসংস্থান ও জীবনযাত্রা ঝুঁকিতে রয়েছে।
প্রতিবেদনের তথ্যমতে, করোনা ও লকডাউনে বাংলাদেশে ১১ লাখ ১৭ হাজার তরুণ স্বল্প মেয়াদে কর্মসংস্থান হারিয়েছেন। পরবর্তীতে ১৬ লাখ ৭৫ হাজার কর্মসংস্থান হারানোর প্রক্রিয়ায় আছেন। সবমিলিয়ে দেশে করোনায় বেকার হয়েছেন বা সে প্রক্রিয়ায় আছেন ২৭ লাখ ৯২ হাজার তরুণ।
এদিকে সব ধরনের চাকরিতে প্রবেশের বয়সসমী ৩৫ বছর করতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছে বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদ। করোনাকালে সরকারকে ২৮ দিনের আল্টিমেটামও দিয়েছিলেন তারা। তবে সে দাবি পূরণ হয়নি। ফলে আগের দাবির সাথে আরও দুই দাবি যোগ করে কঠোর আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন চাকরিপ্রার্থীরা। এরমধ্যে বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৪০ বছর এবং শিক্ষক নিবন্ধনের বয়স ৪৫ বছর করার দাবি রয়েছে।
বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র পরিষদের সভাপতি ইমতিয়াজ হোসেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘করোনাকালে অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি আরো জোরালো হয়েছে। কিন্তু সরকারের এ বিষয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এ কারণে আমরা আন্দোলন জোরালো করছি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা রংপুরে ইতোমধ্যে কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েছি। পর্যায়ক্রমে সব বিভাগে কর্মসূচী পালন করা হবে। সবশেষে ঢাকার শাহবাগে বৃহৎ কর্মসূচী পালন করা হবে। এবার আমরা সরকারকে জোরালো বার্তা দিতে চাই। দাবি আদায় না করে ফিরছি না। কারণ একটা যৌক্তিক দাবিতে বছরের পর বছর আন্দোলন করা যায় না। আমরা চাই, সরকার দ্রুত আমাদের দাবি মেনে নিক।’
এ আন্দোলন দীর্ঘদিন ধরে চললেও তা জাতীয় সংসদে কণ্ঠভোটে নাকচ হয়ে যায়। তখন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেছিলেন, পড়াশোনা শেষ করার পর একজন ছাত্র অন্তত সাত বছর সময় পেয়েছে। এটা অনেক সময়। তাছাড়া এর আগে চাকরির বয়স ২৫ বছর ছিল, সেখান থেকে ২৭ ও পরবর্তীতে ৩০ বছর করা হয়। সে হিসেবে এখন বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই।
যদিও করোনার কারণে সুর কিছুটা নরম করেছিলেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। তিনি জানিয়েছিলেন, করোনার মধ্যে চাকরিপ্রার্থীদের ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে দেওয়া যায়, সে ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে আলাপ করবেন তিনি। তবে পরে সরকারের কোনো মহলে বিষয়টি নিয়ে নিয়ে আর আলোচনা হতে দেখা যায়নি।