দেশে করোনায় চাকরি গেছে এক কোটি মানুষের, ভবিষ্যৎ গন্তব্য অজানা
করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরুর পর দেশে অন্তত এক কোটি মানুষ তাদের চাকরি হারিয়েছেন। এছাড়া শ্রমজীবী বা বিভিন্ন কর্মে নিয়োজিত লাখ লাখ মানুষও বেকার। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কোচিং সেন্টার, আবাসন ব্যবসা, হোটেল, রেস্তোরাঁ, শপিংমল, ব্যাংক ও বীমা, পরিবহন খাতের সিংহভাগই এখন বেকার। আর শুধু পর্যটন খাতের ক্ষতির শিকার হয়েছেন ৪০ লাখ কর্মী। ভবিষ্যতে কী অপেক্ষা করছে, জানেন না তাদের অনেকে।
জানা গেছে, করোনার সময়কাল দীর্ঘ হওয়ায় এবং অনিশ্চয়তার কারণে বেকারত্বের হার বাড়ছে। অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছেন প্রায় পাঁচ কোটি শ্রমিকও। অনেকে ছাঁটাই না হলেও বেতন কর্তনসহ অন্য সুবিধা ছাড়াই কাজ করছেন। সবমিলিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে প্রায় এক কোটি মানুষ চাকরির সুবিধা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন বলে জানা গেছে।
জিলকদ হোসেন নামে এক বেসরকারি ব্যাংকের কর্মী জানান, করোনার সংক্রমণ শুরুর পর গত এপ্রিল থেকে থার্ড পার্টির মাধ্যমে কাজ বন্ধ করে দেয় ব্যাংকটি। লেখাপড়া শেষ করে চাকরিটা জোগাড় করে বেকারত্ব ঘোচান তিনি। কিন্তু দুই বছর পর আবার চাকরি হারিয়ে তিনি এখন বেকার। করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় শিগগিরই চাকরিতে যোগ দেওয়ার আশাও তিনি দেখছেন না।
এদিকে এক জরিপ প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনার কারণে গ্রামের মানুষের ৬২ শতাংশ ও শহরের মানুষের আয় ৭৫ শতাংশ কমে গেছে। নতুন করে দরিদ্র হয়ে পড়েছের তিন কোটি ৬৯ লাখ ৪৪ হাজার মানুষ। আগেই দরিদ্র ছিল তিন কোটি ৩০ লাখ মানুষ। সব মিলিয়ে সাত কোটি দরিদ্র মানুষ ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। রেস্তোরাঁ কর্মীদের আয় কমেছে ৯৯ শতাংশ। ভাঙাড়ি ওয়ার্কারদের রোজগার কমেছে ৮৮ শতাংশ। রিকশাচালকদের আয় কমে গেছে ৮৪ শতাংশ।
এছাড়া দিনমজুর ও শিল্পীদের আয় কমেছে ৮৩ শতাংশ। মালী ও কারখানা কর্মীদের কমেছে ৮০ শতাংশ। এ ছাড়া পোশাককর্মীদের আয় ৪৯ শতাংশ, কৃষকের ৪৪ শতাংশ, পিয়ন ও নিরাপত্তারক্ষীর ৪৩ শতাংশ, পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের আয় ২৭ শতাংশ কমেছে। পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) এ জরিপ চালায়।
জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতিতে চাকরি থাকলেও বেতনসহ অনেক সুবিধা পাচ্ছেন না প্রায় ১০ লাখ কর্মী। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বেসিক বেতন বা তার অর্ধেক বেতন দেওয়া হচ্ছে। এদিকে ব্র্যাক ও পিপিআরআইয়ের গবেষণা অনুসারে, পূর্ণাঙ্গ সুবিধা পাচ্ছেন না প্রায় ৭৫ লাখ শ্রমিক। এর মধ্যে চার লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক বেতন ছাড়াই চাকরি করে যাচ্ছেন। এর বাইরে ছাড়া ভাসমান ব্যবসায়ী রয়েছেন প্রায় ৬০ লাখ। লকডাউনের কারণে তাদের ব্যবসাও বন্ধ।
বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. হেলাল উদ্দীন বলেন, ফুটপাতের বা অতিক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর সংখ্যা দেশে প্রায় ৬০ লাখ। তাদের কোনো লাইসেন্স নেই। কম পুঁজি দিয়ে দিনে আয় করেন। এমন ব্যবসায়ীরা বেশি বিপদে রয়েছেন। চার মাসে কেউ-ই ব্যবসা করতে পারেননি, উল্টো পুঁজি ভেঙে খেতে হচ্ছে।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে টেনে তুলতে এসএমই খাতে দিকে নজর দিতে হবে। লাখ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছেন, অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন। তাদের জন্য সুযোগ করে দিতে হবে। সরকারকে বড় বড় ব্যবসায়ীর পাশাপাশি এসব ছোট ব্যবসায়ীদের পাশেও দাঁড়াতে হবে।’
করোনার সংক্রমণে বড় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে পর্যটন খাত। অভ্যন্তরীণ পর্যটনকেন্দ্রগুলো জনশূন্য। ফলে পর্যটনকেন্দ্রগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা চরম অনিশ্চয়তায় দিনাতিপাত করছেন। হোটেল-মোটেল সব শূন্য। পাঁচ তারকা মানের হোটেলও বিপাকে, অধিকাংশ কক্ষ খালি থাকছে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, পর্যটন খাত ভেঙে পড়েছে, এ ক্ষতি সবার। পর্যটন করপোরেশনের হোটেল করোনার চিকিৎসায় হাসপাতাল হিসেবে ব্যবহার করতে দিয়েছি। ইন্টারকন্টিনেন্টাল, সোনারগাঁওসহ সর্বত্র করোনার ছাপ। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও খারাপ অবস্থায় রয়েছে বলেও জানান তিনি।
করোনায় পর্যটনশিল্পে অন্তত পাঁচ হাজার ৭০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছে ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব)। করোনার প্রাদুর্ভাব শেষে দেশের পর্যটনের প্রচার, ব্র্যান্ডিং ও বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে ৫০০ কোটি টাকার তহবিল চান সংশ্লিষ্টরা। পর্যটন খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ খাতের অন্তত ৪০ লাখ কর্মী জীবিকা নিয়ে গভীর অনিশ্চয়তায় রয়েছেন।
টোয়াব সভাপতি মো. রাফেউজ্জামান বলেন, পর্যটন খাতে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বেশি সময় লাগবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে মানুষ ঘুরতে বের হবেন না। সে কারণে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে অন্তত দুই বছর লাগতে পারে। অনেকে আয়হীন হয়ে মানবেতর দিনযাপন করছেন। সরকার বিশেষ নজর না দিলে এ খাতের অনেক উদ্যোক্তা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন না।