কীভাবে সহজে চাকরি পাবেন?
করোনাভাইরাসে সৃষ্ট মহামারির করাল থাবায় গোটা বিশ্ব আজ অন্ধকারে নিমজ্জিত। আমাদের চাওয়া— অচিরেই এই অন্ধকার দূর হয়ে আলো উদ্ভাসিত হবে; শেষ হবে লকডাউন ও হোম-কোয়ারেন্টিন জীবন। যদিও এই কোয়ারেন্টিন সময়টা সবচেয়ে বেশি উপকারে আসতে পারে চাকরিপ্রত্যাশীদের জন্য। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস পাঠকদের জন্য লিখেছেন ৩৬তম বিসিএস ক্যাডার— মোঃ ইকবাল হোসাইন
স্বীকার করতেই হবে, করোনার প্রভাবে বাংলাদেশ তো বটেই গোটা বিশ্ব-অর্থনীতিতেই মন্দা, সরকারি-বেসরকারি নিয়োগ কমে যাবে বহুলাংশে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে বেসরকারি ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য জব সার্কুলার যেমন কমে যাবে, তেমনি বেড়ে যাবে বেকারদের হাহাকার, চাকরির গুরুত্ব ও প্রতিযোগিতার মাত্রা। তবে এক্ষেত্রে অপেক্ষমান জব সার্কুলার যেমন— ৪১তম বিসিএস, বাংলাদেশ ব্যাংক, ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির অধীনে বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ, অডিটর ও জুনিয়র অডিটরসহ সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষা লকডাউন শেষে অনুষ্ঠিত হবে। তাই এই লকডাউন-ই হতে পারে চাকরির প্রস্তুতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এই সময়ে যে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়বে, চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রেও তার সম্ভাবনা কমে যাবে। সুতরাং করোনাকালীন সময়ে কোয়ারেন্টিনে থেকে এই মুহূর্তেই শুরু করুন নতুন উদ্যোমে।
এবার মূল প্রসঙ্গে ফিরি। আজ থাকছে চাকরি প্রস্তুতির প্রথম ধাপ অর্থাৎ প্রাথমিক বাছাইপর্ব নিয়ে পরার্শ। এক্ষেত্রে প্রথমেই জানতে হবে—
★ প্রস্তুতি শুরুর পূর্বে কী কী অবশ্যই জানতে হবে?
★ কখন কীভাবে শুরু করবেন প্রস্তুতি?
★ বিসিএস, ব্যাংক ও অন্যান্য সরকারি চাকরির প্রস্তুতির মধ্যে সাদৃশ্য-বৈশাদৃশ্য কী?
★ নতুন চাকরি প্রত্যাশীদের জন্য করণীয় বিষয় কী?
★ প্রস্তুতির জন্য সহায়ক হিসেবে কোন কোন বই পছন্দের তালিকায় রাখবেন?
★ সাফল্য প্রাপ্তিতে অধ্যয়নকালীন অবশ্য অনুকরণীয় মানদণ্ডসমূহ কী কী?
★ পস্তুতি শুরুর পূর্বে যা যা অবশ্যই জানতে হবে?
প্রথমেই জেনে নিতে হবে কোন কোন বিষয়ে প্রশ্ন হয়ে থাকে, বিষয়ের নম্বর বন্টন ও নিয়োগ প্রক্রিয়ার ধাপসমূহ। সাধারণত বাংলা, ইংরেজ, গণিত ও মানসিক দক্ষতা, সাধারণ জ্ঞান, ও সাধারণ বিজ্ঞান, কম্পিউটার ও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশ্ন হয়ে থাকে। বিসিএস প্রিলিমিনারী-২০০ নম্বরের হয়ে থাকে। যেখানে, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য-৩৫, ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য-৩৫, গণিত ও মানসিক দক্ষতা-১৫+১৫=৩০, সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়-৩০+২০=৫০, সাধারণ বিজ্ঞান-১৫, কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি-১৫, নৈতিকতা ও সুশাসন+ভূগোল-১০+১০=২০, মোট ২০০ নম্বর।
পরীক্ষায় প্রতি সঠিক উত্তরের জন্য ১ নম্বর এবং ভুল উত্তরের জন্য ০.৫০ নম্বর কর্তন। ব্যাংক জবের ক্ষত্রে সাধারণত বাংলা-১৫, ইংরেজি-২০/২৫, গনিত ও মানসিক দক্ষতা-৩০, সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক-২০, কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি-১০/১৫ নিয়ে মোট ১০০ নম্বরের পরীক্ষা হয়। প্রতি সঠিক উত্তরের জন্য ১ নম্বর এবং ভুল উত্তরের জন্য ০.২৫ নম্বর কর্তন। আবার অনেক ক্ষেত্রে নেগেটিভ মার্কিং না ও থাকতে পারে। অধিকাংশ জবের ক্ষেত্রে ৩টি ধাপ- বিসিএসের ক্ষেত্রে ১ম ধাপ প্রাথমিক বাছাইপর্ব-২০০, ২য় ধাপ লিখিত-৯০০, ৩য় ধাপ মৌখিক-২০০। অন্যদিকে ব্যাংক জবের ক্ষেত্রে ১ম ধাপ প্রাথমিক বাছাইপর্ব-১০০, ২য় ধাপ লিখিত-২০০, ৩য় ধাপ মৌখিক-২৫
কখন কিভাবে শুরু করবেন প্রস্তুতি?
কালক্ষেপন না করে দ্রুতই প্রস্তুতি শুরু করুন। সবকিছু স্বাভাবিক হলে আগস্টের শেষ কিংবা সেপ্টেম্বরের শুরুতেই নিয়োগ পরীক্ষা হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। সুতরাং এই ৪ মাসের মধ্যে ৩ মাসের একটি পাঠ পরিকল্পনা করুন এবং সব বিষয়ের প্রস্তুতি দৈনিক ও মাসিকভিত্তিতে নির্দিষ্ট করুন। বাকি ১ মাস বরাদ্দ রাখুন রিভিশনের জন্য। যা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হবে। বিশেষ করে গণিত ও ইংরেজির জন্য বেশি সময় বরাদ্দ রাখুন; যা আপনাকে করবে বেশি আত্মবিশ্বাসী।
বিসিএস, ব্যাংক ও অন্যান্য সরকারি চাকরি প্রস্তুতির মধ্যে সাদৃশ্য-বৈশাদৃশ্য কী?
মূলত বিসিএস ও ব্যাংক জব প্রস্তুতির মধ্যে সদৃশ্য বলতে প্রায় কমবেশি ৮০% মিল রয়েছে। বাকি ২০% বৈশাদৃশ্য রয়েছে; যা ব্যাংক জবে ইংরেজি ও গণিতের ক্ষেত্রে। ব্যাংক জব প্রস্তুতির ক্ষেত্রে এই ২০% গুরুত্ব ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে দিতে হবে।
নতুন চাকরি প্রত্যাশীদের জন্য করণীয় কী?
চাকরির বাজারে যারা নবাগত অর্থাৎ সদ্য গ্রাজুয়েটসম্পন্ন; তাদের প্রতিটি বিষয়ের মৌলিক জ্ঞান এবং দক্ষতা অর্জন ও শাণিত করে নিতে হবে। এজন্য বাংলার ক্ষেত্রে ব্যাকরণ ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক ৩টি বই তথা ৯ম-১০ম শ্রেণির ব্যাকরণ বোর্ড বই, হুমায়ুন আজাদের লাল নীল দীপাবলি ও কতো নদী সরোবর পড়ে নিতে হবে। ইংরেজির ক্ষেত্রে Basic Grammar শেখার জন্য যেকোনো একটি বই যেমন- PC Das এর English Grammar। মূল উদ্দেশ্য Basic Grammar বিশেষ করে Tense, Voice, Parts of Speech ইত্যাদি টপিকগুলো ভালোভাবে শিখে নেয়া। গণিতের ক্ষেত্রে ৬ষ্ঠ-৯ম শ্রেণির বোর্ড বইয়ের অংকগুলো কষতে হবে। সাধারণ জ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তি সম্পর্কে কিছু মৌলিক বই পড়ে নিতে হবে। তারপর মূল প্রস্তুতি শুরু করতে হবে।
*প্রস্তুতির জন্য সহায়ক হিসেবে কোন কোন বই অবশ্যই পছন্দের তালিকায় রাখতে হবে। মনে রাখবেন বেশি বই না পড়ে কিছু বই ভালোভাবে আত্মস্থ করাটা বেশি ফলপ্রসু।বিসিএস এর জন্য-প্রথমেই বিসিএস প্রশ্নব্যাংক (১০ম-৪০তম), বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জন্য- ৯ম-১০ম শ্রেণির ব্যাকরণ/হায়াৎ মাহমুদ স্যারের বাংলা ব্যাকরণ, MP3 বাংলা ও সৌমিত্র শেখর স্যারের বাংলা সাহিত্য ও জিজ্ঞাসা বইয়ের সাহিত্য অংশ। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের জন্য- English Assurance Guide বই, Saifur's vocabulary, সাহিত্যের জন্য র্যাডিকাল ইংরেজি সাহিত্য গাইড বই। গণিতের জন্য জর্জ MP3 গণিত, মানসিক দক্ষতার জন্য জর্জ MP3 মানসিক দক্ষতা, সাধারণ বিজ্ঞানের জন্য-MP3 বিজ্ঞান, সাধারণ জ্ঞান বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক- MP3 ও Professor দুটোই সঙ্গে রিসেন্ট ভিউ, কম্পিউটার ও তথ্য প্রযুক্তি জন্য Self Suggestion প্রকাশনী, নৈতিকা সুশাসন ও ভূগোলের জন্য Assurance Guide। ব্যাংক জবের জন্য সংগ্রহে রাখতে পারেন প্রশ্নব্যাংক (২০১৫-২০১৯ সালের সরকারি বেসরকারি MCQ প্রশ্ন সম্বলিত যে কোনো প্রকাশনির বই), বাংলার জন্য-MP3 বাংলা/Professor's বাংলা, সাধারণ জ্ঞানের জন্য-MP3/Professor's বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী সাথে সাম্প্রতিক তথ্যের জন্য রিসেন্ট ভিউ, কম্পিউটারের জন্য Self Suggestion, গণিতের জন্য Saifur's Math, ইংরেজি Saifur's vocabulary, Baron's TOEFL/Clif's TOEFL এর Grammar অংশ।
সাফল্য প্রাপ্তিতে অধ্যয়নকালীন অবশ্য অনুকরণীয় মানদণ্ডসমূহ-
(i) বিগত সালের প্রশ্নব্যাংকগুলো গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ুন ও বিশ্লেষণ করুন। কোন কোন টপিক থেকে বিভিন্ন সালের প্রশ্নের পুনারাবৃত্তি হয়েছে সেগুলো লক্ষ্য রাখুন এবং নোট করুন। যে সকল টপিক থেকে প্রশ্ন কয়েক বছরে একটা বা দুইটা হয়; সে সকল টপিক পাঠ্য পরিকল্পনা থেকে বাদ দিবেন। এতে আপনার প্রস্ততি সহজ ও কার্যকরী হবে।
(ii) প্রশ্ন বিশ্লেষণ ও সমাধানের সময় কোন টপিকগুলো আপনার বুঝতে সমস্যা হচ্ছে এবং মনে সংশয় তৈরি করছে সেগুলো নোট করুন এবং অধ্যয়নকালীন এগুলোর প্রতি বেশি গুরুত্ব দিন। ফলে পরীক্ষার হলে আপনার সৃষ্ট কনফিউশন দূর হবে।
(iii )প্রত্যেক বিষয়ে কোন কোন টপিকগুলো পড়বেন এটা জানা যেমন গুরুত্বপূর্ণ; তেমনই কোন কোন টপিকগুলো বাদ দেবেন, সেগুলো জানাও তেমনটা গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ আপনার মধ্যে টপিক বাদ দেয়ার প্রবণতা থাকতে হবে। যা আপনার প্রস্তুতিকে অন্যের থেকে আলাদা ও কার্যকরী করবে। উদাহরণস্বরূপ- বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলী অংশের বিভিন্ন টপিক যেমন- পুরস্কার ও সম্মাননা (নোবেল পুরস্কার, পুলিৎজার, ম্যাগসেস, চলচ্চিত্, একুশে পদক ইত্যাদি); খেলাধুলা (অলিম্পিক, টেনিস ইত্যাদি) থেকে বড়জোর ১টি প্রশ্ন হয়; তাও আবার এটি সাম্প্রতিক অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি আসে; যা বিগত সালের প্রশ্ন বিশ্লেষণ করলে অনুমান করা যায়। তাই অধ্যয়নের সময় এই বড় দুইটি অধ্যায় আপনাদের বাদ দেয়ার প্রবণতা থাকতে হবে। বাংলার ক্ষেত্রে সকল সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্ম না পড়ে PSC কর্তৃক নির্ধারিত শুধু ১১ জন সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্ম নিয়ে পড়ুন। অযথা পরিশ্রমেরে অভ্যাস ত্যাগ করুন এবং "Industry is the key to success" এই মামুলি প্রবাদটি না মেনে "Proper industry is the key to success" এই প্রবাদে অভ্যস্ত হতে শিখুন। অর্থাৎ আপনাকে অবশ্যই কৌশলি হতে হবে।
(iv) প্রত্যেক বিষয়ের গুরুত্বপূর্ণ, বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও বাদ দেয়া টপিকগুলো নিয়ে একটা ডাটাবেজ বা গাইডলাইন তৈরি করে ফেলুন; যা আপনার প্রস্তুতিকে অনেক বেশি শাণিত করবে।
(v)পরিকল্পনা করুন কতটুকু সময়ে কতটুকু পড়া শেষ করবেন; যা আপনাকে সময়মত কাঙ্ক্ষিত সাফল্য লাভে সাহায্য করবে।
(vi) ব্যাংক জবের ক্ষেত্রে ইংরেজি ও গণিতের ইনটেনসিভ কেয়ার বা নিবিড় পরিচর্যা করুন। কারন এ দুটি বিষয় জব্দ করতে পারলে চাকরি আপনার হাতের নাগালে চলে আসবে। গুরুত্বপূর্ণ সাম্প্রতিক তথ্যসমূহ সংরক্ষণ করুন এবং আপডেট করুন। আনকমন ও অপ্রয়োজনীয় টপিক পড়ার বদ অভ্যাস পরিত্যাগ করুন।
সবশেষে আশান্বিত হওয়ার বিষয় হলো— আমার পরিচিতজন যারা চাকুরি প্রস্তুতি নিয়েছেন, কিছুদিন আগে বা পরে হলেও প্রায় ৯৮ শতাংশই সফল হয়েছেন। তাই আত্মবিশ্বাস রাখুন। এই আত্মবিশ্বাসই হবে আপনার চাকরি প্রাপ্তিযুদ্ধের প্রথম ও বলিষ্ঠ হাতিয়ার।
মোঃ ইকবাল হোসাইন
৩৬তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা)
প্রাক্তন কর্মকর্তা (বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক)
বি.এ, এম.এ (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
মেইল: qbalshaon@gmail.com