চাকরিহীনদের অসহায়ত্ব অপেক্ষা আরও বাড়ছে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৯-১০ শিক্ষাবর্ষের ছাত্র ছিলেন তরিকুল ইসলাম (ছদ্মনাম)। পাস করে বের হন ২০১৫ সালে। এরপর থেকেই ছুটছেন চাকরি নামের সোনার হরিণের পেছনে। পাঁচ বছরের বেশি সময়ের চেষ্টায় কর্মসংস্থান না হওয়ায় বেশ হতাশ দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের এ গ্র্যাজুয়েট। করোনার প্রাদুর্ভাব তরিকুলের সে হতাশা বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। কারণ সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা অনুযায়ী তরিকুলের হাতে আছে শুধু চলতি বছরটাই। আর অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের আশা ছেড়ে দিয়েছেন এ যুবক।
তার ভাষ্যে, ‘গত কয়েক বছর বেশ কিছু লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছি। কয়েকটি ভাইভাও দিয়েছি। তবে কোনো চাকরিই ভাগ্যে জোটেনি। এ বছরটা ছিল আমার শেষ চেষ্টার সুযোগ। তবে করোনার এ বন্ধ যে কবে নাগাদ শেষ হবে? কেউ বলতে পারছে না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও কবে নতুন চাকরির বিজ্ঞপ্তি হবে, কবে পরীক্ষা! আর বেসরকারি খাত থেকে শুধু লোকজন ছাটাইয়ের কথা শুনছি। সেখানে নতুন নিয়োগের আশা দেখছি না।’
২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হওয়া আফজাল হোসেনের (ছদ্মনাম) গল্পও ভিন্ন নয়। চাকরি না পাওয়ার হতাশায় গত কয়েক বছর ধরে ঈদেও বাড়ি যাননি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এ গ্র্যাজুয়েট। তবে করোনার বন্ধ মা-বাবার কাছের যেতে বাধ্য করেছে তাকে। বাড়ি ফিরে পরিবারের অর্থ কষ্ট আফজালের দুশ্চিন্তা গভীরতর হয়েছে ।
কেবল তরিকুল কিংবা আফজাল নয়; হতাশার এ গল্প দেশের লাখো চাকরিহীন যুবকের। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও’র সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বেকারত্বে এশিয়ায় প্রথম অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান, দ্বিতীয় বাংলাদেশ। দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের হার প্রায় ১১ ভাগ, যা এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০০২ থেকে ১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ চারটি শ্রমশক্তি জরিপ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গত ১৫ বছরে ১ কোটি ৪৫ লাখ লোক কাজ পেয়েছে। এখনও প্রায় ১ কোটি লোক বেকার বা ছদ্মবেকার। তার ওপর প্রতিবছর ২০-২২ লাখ মানুষ কাজের খোঁজে শ্রমবাজারে ঢুকছেন।
বিবিএসের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, ২০১৭ সালে দেশে ৬ কোটি ৩৫ লক্ষ কর্মক্ষম (১৫-৬৫ বছর বয়সী) মানুষ ছিলেন। এর মধ্যে ২৭ লাখ ছিলেন বেকার। সেইসঙ্গে কর্মক্ষম ছদ্মবেকারের সংখ্যাও প্রায় ৬৬ লাখ।
অপেক্ষাকৃত তরুণ ছদ্মবেকারেরা পছন্দমতো কাজ না পাওয়ায় টিউশন, রাইড শেয়ারিং, বিক্রয়কর্মী, কল সেন্টারে কর্মীসহ বিভিন্ন ধরনের খণ্ডকালীন কাজ করছেন। তবে করোনার এ পরিস্থিতিতে এ শ্রেণীর তরুণরাও বেশ অর্থকষ্টে রয়েছে। চলমান অচলাবস্থায় টিউশন ও রাইডশেয়ারিংয়ের মতো অনেক পেশা এখন বন্ধ।
এদিকে আইএলও বলছে, করোনার প্রভাবে বিশ্বে প্রায় বিশ কোটি লোক বেকার হবে। জাতিসংঘের শ্রমবিষয়ক সংস্থাটি বলছে, নভেল করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে বিভিন্ন কর্মক্ষেত্র আংশিক কিংবা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিশ্বের মোট শ্রমশক্তির চার-পঞ্চমাংশের (৮১ শতাংশ) ওপর মহামারির প্রভাব পড়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে অনেক প্রতিষ্ঠান আংশিক অথবা সম্পূর্ণভাবে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিচ্ছে। এই মহামারিতে ১৯ কোটি ৫০ লাখ মানুষ পূর্ণকালীন চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে আছে। পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে বৈশ্বিক মোট কর্মঘণ্টা নষ্ট হবে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ।
সম্প্রতি কয়েকটি দেশিবিদেশি কোম্পানি বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নেয়া বা সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে তাদের কর্মীদের কাছে। কর্মী-শ্রমিকদের দেনাপাওনা পরিশোধের সম্ভাব্য উপায় খুঁজছেন তার। অনেকগুলো কারখানা-অফিস ধাপে ধাপে বন্ধ হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন শিল্প ও করপোরেট সংশ্লিষ্টরা। এমন পরিস্থিতিতে যারা টিকে থাকবেন তাদের পক্ষেও নতুন কর্মসংস্থান করা কঠিন হবে। ব্যবসা কমে যাওয়ায় আর্থিক সক্ষমতাও অনেকের কমে যাচ্ছে। কৃষি ও ভোগ্যপণ্যের উৎপাদন ও সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। আর্থিক লেনদেন কমে যাচ্ছে। বাণিজ্যিক বিনিয়োগ কমবে। বিদেশি রেমিট্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব। বৈশ্বিক বাণিজ্যে শ্লথগতির কারণে রপ্তানিতে ধস নামছে। এমন পরিস্থিতিতে যেখানে অভিজ্ঞ-পুরনোদের টিকে থাকার লড়াই তীব্র হবে সেখানে নতুনদের জন্য জায়গা করে নেয়া কঠিন।
কর্পোরেট লিগ্যাল অ্যাফেয়ার্স পরামর্শ দেন এমন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের একাধিত কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, তাদের অনেক ক্লায়েন্ট কীভাবে কম খরচে কর্মী-শ্রমিকদের ছাটাই করা যায় এবং কীভাবে ব্যবসা গুটিয়ে (লে অফ) নেয়া যায় সে পরামর্শ চাচ্ছেন। এটি নি:সন্দেহে চাকরিজীবি ও চাকরিপ্রত্যাশীদের জন্য দু:সংবাদ।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সত্যি কথা বলতে এখন কেউ কর্মসংস্থান নিয়ে চিন্তা করছে না। বরং লোক ছাটাই নিয়ে কথা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সব দেশের কয়েক কোটি মানুষ আনুষ্ঠানিকভাবে চাকরি হারাচ্ছে। সে হিসাবে আমাদের বেকার যুব সমাজের দীর্ঘশ্বাস আরো ভারি হবে- এটাই স্বাভাবিক। করোনার প্রাদুর্ভাব বন্ধ হলেও চাকরির বাজারের পরিস্থিতি খুব দ্রুতই পরিবর্তন হবে না। বিনিয়োগ ফিরে না আসলে চাকরির বাজারের এ সংকট আরো তীব্র হবে।