আবেদন ফি: মেধার চেয়ে টাকা বড়!
- তৌহিদুর রহমান
- প্রকাশ: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৯:৫৫ AM , আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ০৩:৫২ PM
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড। দেশের একমাত্র জ্বালানি তেল শোধনাগারটিতে সম্প্রতি ম্যানেজমেন্ট প্রফেশনাল পদে নিয়োগের জন্য চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে অনলাইনের মাধ্যমে দরখাস্ত আহ্বান করা হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত গুরুত্বপূর্ণ এ প্রতিষ্ঠানটিতে চাকরি উচ্চশিক্ষিত বেকারদের জন্য ভালো সুযোগ নিঃসন্দেহে। তবে আবেদন করতে গিয়ে তাদের চক্ষু চড়কগাছ। আবেদন ফি চাওয়া হয়েছে দেড় হাজার টাকা! অথচ বিসিএসে আবেদন করতেও প্রয়োজন হয় ৭০০ টাকা। শুধু ইস্টার্ন রিফাইনারিই নয়, শীর্ষস্থানীয় রাষ্ট্রায়ত্ত অনেক প্রতিষ্ঠানই চাকরির আবেদন ফি’র নামে বেকার চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে আদায় করছে গলাকাটা অর্থ।
ব্যাপারটা যেন মেধার চেয়ে টাকা বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যার টাকা আছে, তিনি সব প্রতিষ্ঠানে আবেদন করতে পারছেন। যার নেই, তিনি পারছেন না। চাকরির আবেদন ফি জোটাতে টাকা ধারের জন্যও অনেককে দ্বারস্থ হতে হয় অন্যের। যেসব বিজ্ঞপ্তিতে পদ বেশি থাকে, তাতেই আবেদন করেন অনেকে। লোক কম নেওয়া হলে জেনেশুনে আবেদন ফি জলে ফেলতে নারাজ তারা। এভাবেই অনেক চাকরিতে আবেদন করা হয়ে ওঠে না অনেকেরই, কেবল পকেটে প্রয়োজনীয় টাকা না থাকায়।
অসহায় চাকরিপ্রার্থীরা জানিয়েছেন, দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোতে এক থেকে নবম গ্রেড পর্যন্ত (প্রথম শ্রেণি) চাকরির আবেদন ফি সর্বনিম্ন ৫০০ থেকে দেড়-দুই হাজার টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে। ফলে সরকারি চাকরির আবেদন প্রক্রিয়া তাদের জন্য চরম মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু তা-ই নয়, এসব চাকরির পরীক্ষার সিংহভাগই ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়। ফলে যারা ঢাকার বাইরে থাকেন, তাদের একটি পরীক্ষা দিতে অতিরিক্ত আরও দুই থেকে তিন হাজার টাকা খরচ হয়ে যাচ্ছে।
দেশের কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্প্রতি উচ্চশিক্ষা শেষ করেছেন- এমন কয়েকজন চাকরিপ্রার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই মধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত শ্রেণির। অনেকে চরম দারিদ্র্যকে পাশ কাটিয়ে উচ্চশিক্ষা শেষ করেন টিউশনি বা খণ্ডকালীন চাকরি করে। এ অবস্থায় তাদের দ্রুত চাকরি পাওয়াটা প্রত্যাশিত। সেখানে চাকরির বাজারে ঢোকার আগেই বড় ধরনের ধাক্কা খাচ্ছেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য স্নাতক শেষ করা অন্তত পাঁচ শিক্ষার্থীর সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়। তারা জানান, টিউশনি করে এবং বাড়ি থেকে সামান্য অর্থ নিয়ে তারা উচ্চশিক্ষা শেষ করেছেন। প্রত্যাশা ছিল দ্রুত চাকরি নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মুখে হাসি ফোটাবেন। কিন্তু চাকরির আবেদন করতে এসে তারা বড় বিপদে পড়ে গেছেন। এমনিতে তাদের স্বাভাবিক খরচ মেটাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে, সেখানে এক মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা খরচ করে চাকরির আবেদন করা একেবারেই অসম্ভব।
গত ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ১০-১২টি সরকারি চাকরির আবেদন করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ শেষ করা আশিকুর রহমান। এজন্য তার প্রায় সাত হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। তিনি হতাশার সুরে বলেন, ‘বাড়ি থেকে টাকা এনে এখনও নিজের খরচ চালাতে হয়। সেখানে মোটা অঙ্কের টাকা চাকরির আবেদনে ব্যয় হওয়ায় চাপ বাড়ছে। গত দুই মাসে স্বাভাবিকের তুলনায় কয়েক হাজার টাকা বাড়তি নিতে হয়েছে শুধু চাকরির আবেদন করার জন্য। কয়েকটিতে আবেদনও করতে পারিনি। অথচ এ সময়ে বাড়ির দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল- পরিবারের সবার প্রত্যাশাও তেমনি।’ সরকারি চাকরির আবেদন ফি সর্বোচ্চ ২০০ টাকা করা যুক্তিযুক্ত বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ মধ্যবিত্ত শ্রেণির কিংবা একেবারেই নিম্ন আয়ের পরিবারের। যেখানে তাদের সন্তানের লেখাপড়ার খরচ চালাতেই হিমশিম খেতে হয়, সেখানে সরকারি চাকরির আবেদনে এত বিপুল ফি থাকা যৌক্তিক নয়। সরকারি-বেসরকারি সব পর্যায়ের চাকরির আবেদন ফি সব শ্রেণি-পেশার মানুষের নাগালে থাকা জরুরি। সম্ভব হলে ফি ছাড়াই পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গত বছরের ডিসেম্বর ও চলতি বছরের জানুয়ারি- এ দুই মাসে বেশ কয়েকটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরির জন্য আবেদন চাওয়া হয়েছে প্রার্থীদের কাছ থেকে। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) সহকারী ব্যবস্থাপক পদের বিপরীতে আবেদন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার টাকা। এছাড়া সদ্য শেষ হওয়া ৪১তম বিসিএসের জন্য আবেদন ফি নেওয়া হয় ৭০০ টাকা।
গত ১৩ জানুয়ারি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ১৩ পদে (বেতন বিভাগ-ষষ্ঠ প্রশাসন) চাকরির জন্য আবেদন চাওয়া হয়েছে। এ পদের জন্য আবেদন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে এক হাজার ১১১ টাকা। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন, জীবন বীমা করপোরেশনসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির জন্য আবেদন ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ টাকা করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করা শারমিন সুলতানা পিংকি বলেন, ‘এখন চাকরির আবেদন করতে গিয়ে প্রায়ই তীব্র সমস্যার মধ্যে পড়ছি। ফি বেশি হওয়ায় ইচ্ছা থাকলেও অনেক চাকরির আবেদন করতে পারছি না। গেল মাসে একাধিক চাকরির আবেদন ফি ছিল এক হাজার টাকার ওপরে, যা চরম অমানবিক।’ এ ফি যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার দাবি জানান তিনি।
এদিকে চাকরির গলাকাটা আবেদন ফি কমানোর দাবিতে কয়েক বছর ধরেই সোচ্চার সাধারণ চাকরিপ্রার্থীরা। এ নিয়ে গত ২৯ জানুয়ারি সহস্রাধিক চাকরিপ্রার্থীর উপস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। সেখানে চাকরির আবেদন ফি যৌক্তিক পর্যায়ে আনার দাবি জানিয়েছেন তারা। এতে সমর্থন জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সহ-সভাপতি (ভিপি) নুরুল হক নুর ও সাধারণ সম্পাদক (জিএস) গোলাম রাব্বানী।
ওই কর্মসূচির দাবি অনুযায়ী, নবম গ্রেড পর্যন্ত আবেদন ফি ২০০ টাকা, ১০ম গ্রেডের জন্য ১৫০ টাকা, ১১ থেকে ১৪তম গ্রেডের জন্য সর্বোচ্চ ১০০ টাকা এবং ১৫ থেকে ২০তম গ্রেডের জন্য আবেদন ফি সর্বোচ্চ ৫০ টাকা নির্ধারণের আহ্বান জানিয়েছেন তারা। এ দাবি না মানা হলে শিগগিরই বৃহৎ আন্দোলনের ঘোষণা আসতে পারে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন চাকরিপ্রার্থীরা।
সরকারি চাকরির আবেদনে এভাবে বাড়তি ফি নেওয়াকে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম। তিনি বলেন, ‘এত ফি নেওয়া জনস্বার্থবিরোধী। কারণ, তারা একদিকে যেমন বেকার, অন্যদিকে তাদের থাকা-খাওয়া, যাতায়াতসহ আরও অনেক খরচ রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘সরকারি চাকরির আবেদন ফি না নেওয়াটাই সবচেয়ে ভালো হয়। আর নিলেও সেটি সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ১০০ টাকা হতে পারে। কিন্তু সরকার এদিকে নজর না দিয়ে অন্যান্য অনুৎপাদনশীল খাতে নজর দিচ্ছে।’
এ বিষয়ে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘সরকারি পরীক্ষাগুলো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হয়। এখানে পরিচালনা ব্যয় মুখ্য বিষয় নয়। রাষ্ট্রের সব ব্যয়ই তো জনগণের করের অর্থে মেটানো হয়। আর বিত্তশালী পরিবারের কেউ সরকারি চাকরি করে না।’
তিনি বলেন, ‘বিসিএস ও রাষ্ট্রীয় সব নিয়োগে সমাজের সাধারণ ও নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা শিক্ষার্থীরা আবেদন করেন। যেখানে পড়ালেখা চালিয়ে যেতেই তাদের হিমশিম খেতে হয়, সেখানে তাদের কাছ থেকে পরীক্ষার ফি নেওয়া উচিত নয় বলেই মনে করি। আর যদি ফি নেওয়াও হয়, তবে তা যৌক্তিক করা উচিত।’